চারদিন আগে সিরিয়ায় শুরু করা অভিযান কতদিন চলবে, তা তুরস্কের কাছে জানতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ এর উত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ান৷
বিজ্ঞাপন
আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর দীর্ঘ উপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করে এর্দোয়ান বলেন, ‘‘তোমরা আফগানিস্তানে কতদিন ছিলে? ইরাকের বিষয়টি কি শেষ?''
এর আগে এর্দোয়ান আভাস দিয়েছিলেন যে, সিরিয়ার আফরিন এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত অভিযান চলতে পারে৷ এরপর আরেকটু পুবে সরে গিয়ে মানবিজ এলাকায়ও তুর্কি সেনারা প্রবেশ করতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি৷
উল্লেখ্য, শনিবার থেকে সিরিয়ার আফরিন এলাকায় ওয়াইপিজি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে তুরস্ক৷ ওয়াইপিজি'র পোশাকি নাম হচ্ছে ‘পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটস'৷ ওয়াইপিজিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে তুরস্ক৷ তারা ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি' বা পিকেকে'র সিরীয় অংশ বলে মনে করে তুরস্ক৷ উল্লেখ্য, পিকেকে ১৯৮৪ সাল থেকে তুর্কি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত আছে৷ পিকেকে-কে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন' বলে আখ্যায়িত করে তুরস্ক৷
তবে সিরিয়ায় তুরস্কের সাম্প্রতিক অভিযান নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কারণ, সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়তে যুক্তরাষ্ট্রওয়াইপিজি মিলিশিয়াদের সহায়তা নিয়েছে৷ এ কারণে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি বিশাল অংশ এখন ওয়াইপিজিদের নিয়ন্ত্রণে৷ তাই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন অভিযানের ব্যাপারে ‘উদ্বেগ' প্রকাশ করেছেন৷ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ তবে তুরস্কের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব করা কিংবা অভিযান বন্ধ করার কোনো দাবির কথা উঠেনি৷ এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন৷
সিরিয়ায় তুরস্ক ছাড়াও রাশিয়া ও ইরানের সামরিকউপস্থিতি রয়েছে৷ ঐ দেশ দুটিও তুরস্কের নতুন অভিযান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ তবে এর্দোয়ান বলেছেন, অভিযান নিয়ে আগেই মস্কোর সঙ্গে কথা হয়েছে, এবং মস্কোর এতে সম্মতি আছে৷
এদিকে, ব্রিটেন ভিত্তিক ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস' জানিয়েছে, সিরিয়ায় তুরস্কের অভিযানে এখন পর্যন্ত ২২ জন সাধারণ সিরীয় নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন৷ যদিও তুরস্ক এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে৷ তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই দাবিকে ‘বাজে প্রচারণা ও ভিত্তিহীন মিথ্যা' বলে আখ্যায়িত করেছেন৷
জেডএইচ/এসিবি (এএফপি)
সিরিয়ায় আসলে কারা, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ২০১১ সালের সেই আরব বসন্তের জেরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়৷ গত ছয় বছরে সেই সংঘাতের বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে, যোগ হয়েছে নতুন মিত্র, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো শত্রুতা৷
আসাদের প্রতি অনুগতরা
সিরিয়ার সেনাবাহিনী, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ান আরব আর্মি (এসএএ) হিসেবে পরিচিত, ২০১১ সালের শরতে তারা বড় এক জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়৷ সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে আসাদ বিরোধী ‘অ্যান্টি-আসাদ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ তবে এসএএকে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সসহ আসাদপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ সমর্থন দিচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/V. Sharifulin
মডারেট দল
আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিলে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়৷ জিহাদি নয়, এমন বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিলে তারা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে লড়াই করছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পথে সরকার গঠন করা৷ তবে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে হারার পর সেই দলের অনেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে চলে যায়৷
ছবি: Reuters
সন্ত্রাসের নতুন রূপ
সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সে দেশ এবং ইরাকের একটা বড় অংশ দখল করে নিজেদের তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)’৷ নিজের কালো পতাকাতলে ইসলামের উগ্রতম রূপ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য মানুষকে অত্যাচর এবং হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ রাকা শহরে গোষ্ঠীটি শক্ত অবস্থান গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এক পুরনো জিহাদ
তবে আইএসই সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া একমাত্র জঙ্গি গোষ্ঠী নয়৷ আল-কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-নুসরা ফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়ায় লড়ছে৷ আল-নুসরা ফ্রন্ট নিজেদের মধ্যে লড়াই ছাড়াও আসাদ এবং মডারেট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ সম্প্রতি জঙ্গি গোষ্ঠীটি সমমনা আরো কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিয়ে জোট গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Nusra Front on Twitter
আসাদের এক শক্তিশালী মিত্র
প্রেসিডেন্ট আসাদের শক্তিশালী মিত্র ক্রেমলিন৷ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে কয়েকবছর ধরে রসদ সরবরাহের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া সংঘাতে যোগ দেয় রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী৷ তবে রাশিয়ার বিমান হামলায় অনেক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে মাঝেমাঝেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে মস্কো৷
ছবি: picture-alliance/AP/Russian Defense Ministry
অনাগ্রহী পশ্চিম
আসাদের সমালোচনা এবং নীরবে মডারেট বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন জানালেও তাদের হয়ে আসাদের বিরুদ্ধে লড়তে পদাতিক বাহিনী পাঠাতে আগ্রহী নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ন্যাটোভুক্ত দেশ৷ তবে ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রায় ষাটটি দেশের মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক জোট সে দেশে ইসলামিক স্টেট এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/John Macdougall
সীমান্তে নিরাপত্তা
সিরিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত রক্ষার স্বার্থেই এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে৷ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটে থাকা তুরস্কও আসাদবিরোধী জোটকে সহায়তা করছে৷ তবে কুর্দি যোদ্ধাদের মার্কিনিদের সহায়তা নিয়ে সে দেশের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে তুরস্কের, কেননা কুর্দরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, যা তুরস্ক সমর্থন করে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/S. Suna
প্রক্সি ওয়ার
সিরিয়ার সংঘাতে কার্যত এক প্রক্সি লড়াইও চলছে, যেখানে একদিকে রয়েছে রাশিয়া এবং ইরান, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান৷ ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি সে দেশও কৌশলগত সহায়তা, সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং পদাতিক সেনা দিয়ে দামেস্ককে সহায়তা করছে৷
ছবি: Atta Kenare/AFP/Getty Images
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই
ছয় বছর হয়ে গেলেও সিরিয়ায় বহুমুখী লড়াই বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তৈরি বিভিন্ন শান্তি চুক্তি করা হলেও তা তেমন একটা সফল হয়নি৷ ফলে প্রতিদিন সে দেশে নানা হামলায় মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে শিশু, নারীসহ অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন৷