ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুসালেমের হাসপাতালগুলোর জন্য বরাদ্দ করা আড়াই কোটি মার্কিন ডলারের আর্থিক সহায়তা বাতিল করেছে ট্রাম্প প্রশাসন৷ এর ফলে ফিলিস্তিনিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানানো হয়, পূর্ব জেরুসালেমের হাসপাতালগুলোতে আড়াই কোটি মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা বাতিল করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে তা ব্যয় করা হবে৷
পূর্ব জেরুসালেমের মাকাস্সেদ হাসপাতালের পরিচালক বাসেম আবু লিবদেহ বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সহায়তায় পূর্ব জেরুসালেমেরযেসব হাসপাতালে চিকিৎসা হয়, অর্থ সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে সেখানকার রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়বে৷'' তিনি জানান, পূর্ব জেরুসালেমের ৬টি হাসপাতালের ৪০ শতাংশ খরচ চলে মার্কিন সহায়তায়৷ এই হাসপাতালগুলোতে মূলত পশ্চিম তীর এবং গাজার অধিবাসীরা চিকিৎসা নিতে আসেন৷
মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে, বাতিল করা অর্থ সহায়তার অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে খরচ করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ফিলিস্তিনিদের বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা হতো৷ যেমন, হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার, নবজাতকদের নিবিঢ় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা, শিশুদের ডায়ালাইসিস ইত্যাদি৷ এসব স্বাস্থ্যসেবা পশ্চিম তীর এবং গাজায় সহজলভ্য নয়৷
বিতর্কিত শহর জেরুসালেম
জেরুসালেম বিশ্বের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে বিতর্কিত শহরগুলির অন্যতম৷ ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিষ্টান, তিনটি ধর্মের মানুষের কাছে জেরুসালেম একটি পবিত্র শহর৷ এ কারণে জেরুসালেম নিয়ে বিরোধ ও বিতর্ক লেগেই আছে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/S. Qaq
রাজা ডেভিডের শহর
ওল্ড টেস্টামেন্টের বিবরণ অনুযায়ী, জুডাহ ও ইসরায়েলের রাজা ডেভিড যীশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে জেবুসাইটদের কাছ থেকে জেরুসালেম জয় করেন৷ ডেভিড জেরুসালেমকে তার রাজধানী করেন ও জেরুসালেম তাঁর রাজ্যের ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়৷ বাইবেলে কথিত আছে যে, ডেভিডের পুত্র রাজা সলোমন জেরুসালেমে ইসরায়েলের দেবতা ইয়াওয়েহ’র প্রথম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ও জেরুসালেম ইহুদি ধর্মের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়৷
ছবি: Imago/Leemage
পারস্যের শাসনে
নব্য ব্যাবিলোনিয়ান রাজা দ্বিতীয় নেবুচাডনেজার (বাম থেকে তৃতীয়) খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৭ ও ৫৮৬ সালে জেরুসালেম জয় করেন বলে বাইবেলে আছে৷ তিনি রাজা জেহোইয়াকিম (ডান থেকে পঞ্চম) ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ইহুদিদের বন্দি করে ব্যাবিলনে পাঠান ও ইয়াওয়েহ’র মন্দিরটি ধ্বংস করেন৷ পারস্যের রাজা সাইরাস দ্য গ্রেট ব্যাবিলন দখল করার পর নির্বাসিত ইহুদিদের জেরুসালেমে ফেরার ও মন্দিরটি পুনরায় গড়ে তোলার অনুমতি দেন৷
ছবি: picture-alliance/Mary Evans Picture Library
রোমক ও বাইজান্টাইন আমল
খ্রিষ্টজন্মের ৬৩ বছর পরে জেরুসালেম রোমক শাসনে আসে, কিন্তু জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ অব্যাহত থাকায় তার তিন বছর পরেই প্রথম ইহুদি-রোমক যুদ্ধের অবতারণা ঘটে৷ চার বছর যুদ্ধের পর রোমকরা জয়ী হয় ও ইহুদিদের মন্দিরটি পুনরায় ধ্বংস করা হয়৷ রোমক আর বাইজান্টাইনরা মিলে প্রায় ৬০০ বছর ধরে জেরুসালেম শাসন করে৷
ছবি: Historical Picture Archive/COR
আরব বিজয়
বৃহত্তর সিরিয়ায় ইসলামের জয়ের পর মুসলিম সেনাবাহিনী জেরুসালেমে পৌঁছায়৷ (ছবিতে) খলিফা উমরের আদেশে ৬৩৭ সালে দীর্ঘ অবরোধের পর জেরুসালেমের পতন ঘটে৷ মুসলিম শাসন চলাকালীন বিভিন্ন গোষ্ঠীর শাসকরা শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত চালান৷ জেরুসালেম একধিকবার অবরুদ্ধ ও বিজিত হয়৷
ছবি: Selva/Leemage
ক্রুসেড
১০৭০ সাল থেকে মুসলিম নেতারা ক্রমেই খ্রিষ্টান জগতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেন৷ শেষমেষ পোপ দ্বিতীয় আর্বান ক্রুসেডের ডাক দেন৷ ২০০ বছরের মধ্যে মোট পাঁচটি ক্রুসেড জেরুসালেম জয়ের জন্য যাত্রা করে৷ কিন্তু ১২৪৪ সালে ক্রুসেডাররা শহরটির নিয়ন্ত্রণ হারায় ও জেরুসালেম পুনরায় মুসলিম শাসনে আসে৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
অটোমান ও ব্রিটিশ আমল
অটোমানরা মিশর ও আরব জয় করার পর ১৫৩৫ সালে জেরুসালেম একটি অটোমান জেলার প্রশাসনিক কার্যালয়ে পরিণত হয়৷ অটোমান শাসনের প্রথম কয়েক দশকে শহরটির প্রভূত উন্নতি ঘটে৷ ১৯১৭ সালে অটোমান সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের জয়ের পর ফিলিস্তিন ব্রিটিশ শাসনে আসে ও জেরুসালেম বিনাযুদ্ধে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়৷
ছবি: Gemeinfrei
বিভক্ত শহর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন তার ফিলিস্তিনি সনদ ছেড়ে দেয়৷ অপরদিকে জাতিসংঘ হলোকস্ট থেকে যেসব ইহুদি বেঁচেছেন, তাদের জন্য একটি স্বদেশ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে দেশবিভাগের সিদ্ধান্ত নেয়৷ অতঃপর কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ও অংশত জেরুসালেম দখল করে৷ ১৯৬৭ সাল অবধি জেরুসালেমের পশ্চিমাংশ ইসরায়েল ও পুবের অংশ জর্ডানের দখলে ছিল৷
ছবি: Gemeinfrei
পূর্ব জেরুসালেম ইসরায়েলের হাতে ফিরল
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের এক যুদ্ধে ইসরায়েল মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়৷ সাইনেয়াই, গাজা স্ট্রিপ, পশ্চিম তীর, গোলান হাইটস ও পূর্ব জেরুসালেমের দখল করে নেয় ইসরায়েল৷ ইসরায়েলের প্যারাট্রুপার সৈন্যরা ১৯৪৯ সাল যাবৎ প্রথমবারের মতো ইহুদিদের জেরুসালেমের ‘ওয়েলিং ওয়াল’-এ দাঁড়ায়৷ পূর্ব জেরুসালেমকে সরকারিভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগ না করা হলেও, সামগ্রিক প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
জেরুসালেমে মুসলিমদের পবিত্র স্থানগুলি মুসলিমদের জন্য খোলা৷ টেম্পল মাউন্ট একটি স্বশাসিত মুসলিম প্রশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ মুসলিমরা ডোম অফ দ্য রক ও তার সংলগ্ন আল-আকসা মসজিদটি দর্শন করতে পারেন ও সেখানে নামাজ পড়তে পারেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Gharabli
জেরুসালেম নিয়ে বিরোধ
আজ অবধি জেরুসালেমের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ মর্যাদা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তির পথে অন্তরায় হয়ে রয়েছে৷ ১৯৮০ সালে ইসরায়েল গোটা জেরুসালেমকে তার ‘‘চিরন্তন ও অবিভাজনযোগ্য রাজধানী’’ বলে ঘোষণা করে৷ ১৯৮৮ সালে জর্ডান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমের উপর তার দাবি পরিত্যাগ করার পর ফিলিস্তিন রাজ্য ঘোষিত হয়৷ ফিলিস্তিন রাজ্যও জেরুসালেমকে তাদের রাজধানী বলে গণ্য করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
10 ছবি1 | 10
ডিসেম্বরে জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একের পর এক এমন পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন, যা ফিলিস্তিনিদের মনে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাবকে আরো উসকে দিচ্ছে৷
মার্কিন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের পর ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র আহমাদ সামি সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘‘শান্তি আলোচনা চালানোর জন্য এটা কি কোনো ফর্মুলা হতে পারে? এটা একেবারেই অমানবিক এবং অনৈতিক পদক্ষেপ৷ এর মাধ্যমে ইসরায়েলের আগ্রাসনকে সমর্থন দেয়া হচ্ছে এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে৷ ''
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘এর ফলে শত শত ফিলিস্তিনির জীবন হুমকির মুখে পড়বে৷'' আরো বলা হয়েছে, ‘‘মার্কিন প্রশাসন যে বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে তারা সব ধরনের সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং তারা ফিলিস্তিনের মানুষের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে৷ এটা সব ধরনের মূল্যবোধের বিরোধী৷''