যুক্তরাষ্ট্রে গোলাপের ৯ বাড়ি, হাইকোর্টের তদন্তের নির্দেশ
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপের যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ লাখ ডলারের ৯টি বাড়ি থাকার অভিযোগ দুদককে তদন্ত করতে বলেছেন হাইকোর্ট। ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের এক রিটের প্রেক্ষিতে সোমবার এই আদেশ দেয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
হাইকোর্টের বিচারপতি বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ আগামী চার মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে দুদককে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন।
রিটে আবদুস সোবহান গোলাপ নামে পরিচিত মো. আবদুস সোবহান মিয়া এবং স্বরাষ্ট্র সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকেও বিবাদী করেছেন ব্যারিস্টার সুমন৷
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, "হাইকোর্টের নির্দেশের কারণে এটা আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করবো। তবে তদন্তে কতদিন লাগবে তা বলা যায় না।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, " অর্থ পাচারের একাধিক ঘটনায় হাইকোর্টের বার বার নির্দেশনা প্রমাণ করে যে, অর্থ পাচারের বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু এইসব ব্যাপারে দুদকসহ অন্যান্য সংস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে না।”
যুক্তরাষ্ট্রে আবদুস সোবহান গোলাপের বাড়ির তথ্য বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট' বা ওসিসিআরপির বরাত দিয়ে প্রথমে প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে মোট ৯টি বাড়ির মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের চেয়েও বেশি।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পাঁচটি কনডোমিনিয়াম কেনেন আবদুস সোবহান গোলাপ। সে সময় ওই সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ২৪ লাখ ডলার। এছাড়া তিনি আশপাশে ছয় লাখ ৮০ হাজার ডলার মূল্যের তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। ওইসব সম্পত্তি নগদ অর্থে কেনা। সম্পত্তি কেনা হয় তার স্ত্রী গুলশান আরার নামে।
আবদুস মোবহান গোলাপ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাদারীপুর-৩ (কালকীনি ও মাদারীপুর সদরের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আবদুস সোবহান গোলাপ নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আরো একটি কেনেন। যার তখনকার মূল্য ছিল প্রায় ১২ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। এর সাত মাস আগে বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত: ড. ইফতেখারুজ্জামান
আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ছাড়াও গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সস্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদও পান। এক সময় দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন গোলাপ। সোমবার তার যুক্তরাষ্ট্রের বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি একটি জনসভায় আছেন জানিয়ে পরে ফোন করতে বলেন। এরপর আর ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এর আগে ৪৫৯ জনের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ
গত জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ কেনার অভিযোগের বিষয়ে ৩০ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান করতে দুদকসহ চার সংস্থাকে নির্দেশ দেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়নি দুদক।
গত ১১ জানুয়ারি একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির এক হাজারের মতো সম্পত্তি আছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ওই ৪৫৯ বাংলাদেশি।
২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে বলে সেখানে দাবি করা হয়, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ইউএস ডলার।
গত ৯ জানুয়ারি হাাইকোর্টের ওই বেঞ্চ ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ি থাকার বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন।
দেড় বছর আগে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে সেখানে যারা সম্পদ গড়ে তুলেছেন তাদের একটি তালিকা দুদকের কাছে চায় হাইকোর্ট। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি এরকম মোট ৬৭ জনের তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয় দুদক। তবে ওই তালিকায় বিস্তারিত তথ্য না থাকায় আদালত তখন অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর আগেও আদালতের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর ২৯ ব্যক্তি ও ১৪ প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়।
১৫ জানুয়ারি একটি বাংলা দৈনিকের খবরে বলা হয়, লন্ডনের অভিজাত এলাকায় বাড়ি কেনায় বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে আছে। খবরে বলা হয়, প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বিদেশি এখন ৪০ শতাংশ। তাদের মধ্যে শীর্ষে আছেন বাংলাদেশিরা।
দুদকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান সেল্ফ স্টার্ট নেয় না, ধাক্কা দিতে হয়: ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের বিনিয়োগ কোটায় অভিবাসনসংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্টনস এই তথ্য জানিয়েছে। তারা বলছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ওই এলাকায় ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন বাংলাদেশিরা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে দুদক কোনো তদন্ত এখনো শুরু করেনি।
আর ২০২১ সালের জুন মাসে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল জানান যে কানাডায় ২৮ জন বাংলাদেশির বাড়ি কেনার তথ্য আছে তার কাছে। তিনি তখন জানান, ওই ২৮ জনের চারজন মাত্র রাজনীতিবিদ, বাকিরা সরকারি কর্মকর্তা। সে ব্যাপারেও দুদকের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।
রিটকারী আইনজী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন জানান," এক মাস আগেই আমি যুক্তরাষ্ট্রে আবদুস সোবহান গোলাপের বাড়ির বিষয় তদন্ত করার জন্য দুদকে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ওই সময়ে দুদক বিষয়টি আমলেই নেয়নি। তাই আমি তদন্তের জন্য হাইকোর্টে রিট করি। আমি নিজেও আওয়ামী লীগ করি। তিনিও আওয়ামী লীগ করেন। তিনি একজন সংসদ সদস্য। আমার মনে হয়েছে এটা দল এবং দেশের স্বার্থে তদন্ত ও বিচারের আওতায় আসা উচিত।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, "দুদকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সেল্ফ স্টার্ট নেয় না। তাদের ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট করাতে হয়। তাই আমি রিটের আশ্রয় নিয়েছি। তা না হলে কবে তদন্ত হতো তা বলা অসম্ভব।”
তিনি বলেন," আমি আবেদনে ওসিসিআরপি ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের কপি জমা দিয়েছি। ৩০ ডলার জমা দিয়ে তার বাড়ির ঠিকানা ও ছবি সংগ্রহ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ ডলার জমা দিয়ে যেকোনো ব্যক্তির সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।”
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "আদালতের মাধ্যমে এই অর্থ পাচারের ঘটনা যে বার বার সামনে আসছে, আমি মনে করি এটা ভালো। এই বিষয়গুলো যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু দুদক সবগুলো আমলে নিতে পারছে না। এর কারণ হতে পারে এত বেশি ঘটনা যে তারা সব বিষয় আমলে নিতে পারে না। আবার তাদের জনবল ও দক্ষতারও প্রশ্ন আছে। তবে যারা এই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। সে কারণেও ব্যবস্থা নেয়া তাদের জন্য কঠিন হতে পারে।”
চার মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেবো: অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন," শুধু দুদক নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিআইডিসহ আরো কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এই অর্থ পাচারের ঘটনা দেখা। কিন্তু তাদের কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা দেখতে পাই না।”
‘আরো ওয়েট করতে হবে'
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম দাবি করেন, "কোনো ঘটনার তদন্ত সম্ভব, আবার কোনো ঘটনা সম্ভব নয়। আমাদের মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্সের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে তথ্য নিতে হয়। তথ্য না পেলে তো কিছু করার থাকে না।”
হাইকোর্টের আদেশ দিতে হয়; কিন্তু তার আগেই পত্রিকায় ছাপা হলে দুদক তা দেখে তদন্ত শুরু করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন," আমরা পত্রিকা দেখেও তদন্ত করি। কিন্তু সেটা তো সিরিয়ালি আসতে হবে। যেগুলো পেন্ডিং আছে, আগে তো সেগুলো শেষ করতে হবে। ব্যাস্টিার সায়েদুল ইসলাম সুমন আবেদন করেছিলেন। কিন্ত তার আগে তো আরো অনেক সিরিয়াল আছে। সেগুলো শেষ করে আমরা ধরতাম। আমরা এখন ২০২২ সালের আবেদনগুলো দেখছি। ওনাকে তো আরো ওয়েট করতে হবে।”
"তবে যেহেতু হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন তাই চার মাসের মধ্যে আমরা তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করবো। এই সময়ের মধ্যে না হলে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেবো,” জানান দুদকের এই আইনজীবী।
২০২২ সালের ছবিঘর
দুদকের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান
২০০৪ সালে দুদক যাত্রা শুরু করে৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ড. ইফতেখারুজ্জামানের দাবি, দুদক চুনোপুঁটিদের ধরে, রাঘব বোয়ালদের ধরে না৷ তবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলমের দাবি, বিএনপিপন্থিরা এসব কথা বলেন৷
ছবি: bdnews24.com
দুদকের মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে করা দুদকের মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার জজ আদালত৷ এরপর তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়৷ ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
সাংসদ বদিকে কারাগারে প্রেরণ
২০০৮ ও ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা সম্পদের বিবরণে মিথ্যা তথ্য দেয়া ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে মামলা করে দুদক৷ এই মামলায় আত্মসমর্পণের পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল৷ তিন সপ্তাহ জেলে থাকার পর জামিন পান বদি৷ এরপর বিচার শেষে ২০১৬ সালে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও দশ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়৷ সেবারও কদিন জেলে থেকে জামিন পান তিনি৷
ছবি: bdnews24
সচিবদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল
২০১৪ সালে দুদকের তদন্তে চার সচিব ও এক যুগ্ম-সচিবের ‘অবৈধ প্রক্রিয়ায়’ মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ এরপর তাদের সনদ বাতিল করা হয়৷ তারা হলেন নিয়াজ উদ্দিন মিয়া (স্বাস্থ্য সচিব), এ কে এম আমির হোসেন (পিএসসির সচিব), মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান (বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান) এবং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের দুই ওএসডি কর্মকর্তা মাসুদ সিদ্দিকী (সাবেক সচিব) ও আবুল কাসেম তালুকদার (সাবেক যুগ্ম সচিব)৷
ছবি: bdnews24.com
ফাঁদ মামলা
ঘুসখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের হাতেনাতে ধরতে দুদক ফাঁদ পেতে থাকে৷ এভাবে ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর করোনার কারণে এমন অভিযান বন্ধ হয়ে যায়৷ ২০১৯ সালে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ড. এস এম নাজমুল হককে (ছবি) ঘুস নেওয়ার সময় দুদক হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল৷ এছাড়া সাব রেজিস্ট্রার, ভূমি কর্মকর্তা, সিটি কর্পোরেশনের উপ-কর কর্মকর্তা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এভাবে গ্রেপ্তার হন৷
ছবি: bdnews24
পুলিশ ও দুদকের সাবেক কর্মকর্তার জেল
এক নারীকে জোর করে বিয়ের পর নির্যাতন চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালে পুলিশের তৎকালীন ডিআইজি মিজানুর রহমানকে (ডানে) বরখাস্ত করা হয়৷ এর চার মাস পর তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক৷ সেই দায়িত্ব পেয়েছিলেন দুদকের তৎকালীন পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির৷ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই মিজান দাবি করেন, তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন বাছির৷ বুধবার মিজানের তিন বছরের কারাদণ্ড হয়৷ আর দুটি মামলার বাছিরের আট বছরের জেল হয়৷
কারাগারে ডেসটিনির এমডি
সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ার অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনকে ২০২০ সালে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে ২০ লাখের বেশি মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালে মামলা করেছিল দুদক৷ পরে ওই বছরের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রফিকুল আমীনসহ কোম্পানির অধিকাংশ শীর্ষ কর্মকর্তা৷
ছবি: bdnews24.com
বেসিক ব্যাংকের বাচ্চুর দুর্নীতি পায়নি দুদক
জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল৷ পরে চাপের মুখে ২০১৪ সালে তিনি পদত্যাগ করেন৷ অনুসন্ধানের পর ২০১৫ সালে ব্যাংকের ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক৷ কিন্তু এর মধ্যে বাচ্চুর নাম ছিল না৷ অথচ ২০১৬ সালে অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিত দুটি সংস্থার প্রতিবেদনে অভিযোগের সঙ্গে বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২,৬০০ কোটি টাকা সরায় বলে অভিযোগ ওঠে৷ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক৷ তারা ৩৮টি মামলা করে৷ বিচার প্রক্রিয়া এখনো চলছে৷ হল -মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, এমডি তানভীর মাহমুদ এখন আটক আছেন৷ এর মধ্যে ২০১৮ সালে দুদকে সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় জেসমিন ইসলামের তিন বছরের জেল হয়েছে৷
ছবি: DW
সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডির কারাদণ্ড
২০১১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখা থেকে ডিএন স্পোর্টসের নামে ঋণ নিয়ে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনার তদন্ত করে ২০১৪ সালে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়৷ এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি হুমায়ুন কবীরও ছিলেন৷ গত ডিসেম্বরে কবীরসহ ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়৷ হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে দায়ের করা দুদকের বিভিন্ন মামলাতেও আসামি হুমায়ুন কবীর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nabil
ব্যাংক কর্মকর্তার যাবজ্জীবন
ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের দুই কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালে মামলা করে দুদক৷ বিচার শেষে ২০১৬ সালে ব্যাংকের এক কর্মকর্তাসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত৷ শাস্তিপ্রাপ্তরা হলেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান, প্যারাগন নিট কম্পোজিট লিমিটেডের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ও পরিচালক সাইফুল ইসলাম৷ রায়ের সময় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পলাতক ছিলেন৷
ছবি: Felix Kästle/dpa/picture-alliance
বিনা দোষে জেল
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের এক মামলায় ২০১৬ সালে পাটকল শ্রমিক জাহালমকে (বামে) গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ মামলায় অভিযুক্তের নামের সাথে মিল না থাকলেও তাকে সাজা দেয়া হয়েছিল৷ ঐ ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর তিন বছর জেল খাটার পর হাইকোর্টের নির্দেশে জাহালম মুক্তি পেয়েছিলেন৷ এছাড়া দুদকের ভুল তদন্তের কারণে ১৫ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া নিরপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাজা গতবছর জানুয়ারিতে বাতিল করে দিয়েছিল হাইকোর্ট৷
ছবি: dnews24.com
বিসমিল্লাহ গ্রুপ
একাধিক ব্যাংক থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি, মুদ্রা পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান চৌধুরীসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা করেছিল দুদক৷ এর মধ্যে এক মামলায় ২০১৮ সালে খাজা সোলেমান চৌধুরী, নওরিন হাসিবসহ নয়জনকে দশ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত৷
ছবি: YAY Images/imago images
অর্থ পাচার বিষয়ে দুদকের ভূমিকায় আদালতের অসন্তোষ
২০২০ সালে অর্থ পাচার সংক্রান্ত দুদকের এক প্রতিবেদন দেখে হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল৷ জ্যেষ্ঠ বিচারক নজরুল ইসলাম তালুকদার সেইসময় বলেছিলেন, ‘‘বিদেশে এত লোক টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে৷ ক্যানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কারা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের একজনের নামও পাননি! উই ওয়ান্ট টু সি দুদক কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে৷ আপনারা অন্ততপক্ষে এটা দেখান যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷’’
ছবি: bdnews24.com
এ ব্যাপারে দুদক আইনজীবীর বক্তব্য
বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে- হাইকোর্ট জানতে চাওয়ার নয় মাস পর গত ডিসেম্বরে কর ফাঁকি সংক্রান্ত পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা বাংলাদেশের ৪৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা দিয়েছিল দুদক৷ সেই সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছিলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন হওয়ায় কেবল ঘুস ও দুর্নীতি থেকে উদ্ভূত (সরকারি কর্মচারীসংশ্লিষ্ট) অর্থ পাচারের অভিযোগ দুদক কর্তৃক অনুসন্ধানযোগ্য৷
ছবি: DW
কোকোর টাকা ফিরিয়ে আনা?
২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিদেশে পাচার করা অর্থ থেকে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা দেশে ফেরতে আনার কথা জানিয়েছিল দুদক৷ সেই সময় বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, কোকো ও বিএনপিকে হেয় প্রতিপন্ন করতেই কথিত পাচার করা অর্থ ফেরত আনার কথা বলা হচ্ছে৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০০৪-এ বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও হাইতি যৌথভাবে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলে বিবেচিত হয়েছিল৷ আর ২০২২ সালের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১৪৭ নম্বরে৷ ২০২১ সালেও একই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ৷
ছবি: DW
রাঘব বোয়ালদের ধরা হচ্ছে না?
সম্প্রতি রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে চাকরি হারিয়েছেন দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন (ছবি)৷ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ‘‘রাঘব বোয়ালদের ধরতে গেলে চাকরি হারাতে হয়, যা দুদক গঠনের উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত৷’’ তিনি বলেন, ‘‘দুদক যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল তা সফল হয়নি৷’’ তবে দুদকের আইনজীবী আ্যাডভোকেট খুরশীদ আলমের দাবি, ‘‘এসব কথা বলছেন বিএনপিপন্থিরা৷’’
ছবি: Privat
সাজার হার কেমন?
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ দাবি করেন, ‘‘আমাদের মামলায় শাস্তি পাওয়ার হার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ৷ ভবিষ্যতে এটা আরো বাড়বে৷ কারণ দুদকের তদন্তে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে৷ ফরেনসিক ল্যাব করা হচ্ছে৷ ফলে তদন্তে দক্ষতার যে ঘাটতি আছে, তা অনেকটা দূর হবে৷’’