যুক্তরাষ্ট্রে ঘরে এসে কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে হত্যা করলো পুলিশ
২৪ জুলাই ২০২৪
পুলিশের সঙ্গে কথা বলার সময় হাতে ছিল ফুটন্ত পানির পাত্র৷এ কারণে সোজা গুলি চালালো পুলিশ৷ পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ নারীর এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যে৷
সোনিয়া ম্যাসি নামের ওই নারী ফোন করে ডেকেছিলেন পুলিশকে৷ তিনি ভেবেছিলেন তার বাসায় কেউ ঢুকে পড়েছে৷
একটি সংবাদ সম্মেলনে মঙ্গলবার নাগরিক অধিকার বিষয়ক আইনজীবী বেন ক্রাম্প এই গুলিচালনার ঘটনাকে ‘যুক্তিহীন' বলেন৷ এই ঘটনায় এক পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে উঠেছে হত্যার অভিযোগ৷ ক্রাম্প আরো বলেন, পুলিশ এই ঘটনায় নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে৷
সরকারের তরফে ‘নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের'- কথা বলা হয়েছে বলে জানান ক্রাম্প৷
এই হত্যার ঘটনা গোটা অ্যামেরিকাকে নাড়িয়ে দিয়েছে৷ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সোনিয়া ম্যাসিকে একজন ‘ভালোবাসাময় মা, বন্ধু, মেয়ে ও কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী' হিসাবে বর্ণনা করে বলেন, তার ‘‘বেঁচে থাকা উচিত ছিল৷''
স্যাঙ্গামন কাউন্টি শেরিফ অফিসের ভাষ্য অনুযায়ী, শিকাগো থেকে ৩২২ কিলোমিটার দূরে স্প্রিংফিল্ড অঞ্চলে নিজের বাসায় কেউ ঢুকে পড়েছে ভেবে ৯১১ নম্বরে ফোন করেন ৩৬ বছর বয়সি সোনিয়া৷ তারপর ৬ জুলাই মধ্যরাত পেরোনোর কিছু পরে তার বাসায় আসে পুলিশ৷
ভিডিওতে দেখা গেছে তিনি দুজন পুলিশ কর্মীর সাথে কথা বলছেন, পুলিশ তার পরিচয় যাচাই করেন৷
তারপর পুলিশকর্মীরা সোনিয়াকে বলেন, চুলায় বসানো ফুটন্ত পানির পাত্রের দিকে খেয়াল রাখতে৷ তারা বলেন, ‘‘আমরা চাই না আমরা থাকতে থাকতে এখানে আগুন লাগুক৷''
এক পুলিশকর্মী পেছনে সরে গেলে সোনিয়া কারণ জানতে চান, সেই কর্মী হাসতে হাসতে সোনিয়াকে নির্দেশ দেন, ‘‘ফুটন্ত পানি থেকে দূরে সরুন!''
সেই পাত্র হাতে নিয়ে ঠান্ডা গলায় সোনিয়া বলেন, ‘‘ওহ, আমি যীশুর নামে তোমায় ভর্ৎসনা করছি৷''
জবাবে এক পুলিশকর্মী গালিগালাজপূর্ণ রুক্ষ ভাষায় সোনিয়াকে পাত্রটি নামিয়ে রাখতে বলেন৷ আরো বলেন, তিনি তাকে গুলি করবেন৷
ক্ষমা চাইতে চাইতে পাত্রটি হাতে নিয়ে সোনিয়া রান্নাঘরের কাউন্টারের পেছনে সরে যান৷ পুলিশের চিৎকার শোনা যায়, ‘পাত্র নিচে রাখুন!''
তারপরই সোনিয়াকে ঘিরে ফেলে গুলি চালায় পুলিশ৷ ভিডিওতে দেখা গেছে শন জি. নামের এক পুলিশকর্মী সোনিয়াকে লক্ষ্য করে তিনবার গুলি চালান, যার মধ্যে একটি তার মাথায় গিয়ে লাগে৷
পরে, সেই পুলিশ কর্মীরা দাবি করেন, তাদের ভয় ছিল যে ফুটন্ত পানি হয়ত তাদের মাথায় এসে পড়বে৷
আফ্রো-অ্যামেরিকান যে ব্যক্তিদের কথা অবশ্যই জানা উচিত
যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের বিদ্বেষ ও নির্যাতনের ইতিহাস বহু পুরনো৷ এখানে কয়েকজন আফ্রো-অ্যামেরিকান ব্যক্তির কথা তুলে ধরা হলো, যাদের নাম গত তিনশ বছরের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
ক্রিসপাস অ্যাটাকস (১৭২৩-১৭৭০)
তাঁর জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্র বলে কোনো দেশ ছিল না৷ ১৭৭০ সালের ৫ মার্চ ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যে পাঁচ বেসামরিক মানুষ নিহত হন তিনি তাদের একজন৷ এটি ‘বস্টন হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত৷ অ্যামেরিকান বিপ্লবে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ শহিদ হিসেবে সমাদৃত৷ তার বাবা আফ্রিকান এবং মা ভারতীয়৷ তিনি একজন পলাতক ক্রীতদাস ছিলেন৷
ছবি: Gemeinfrei
বেনজামিন ব্যানেকার (১৭৩১-১৮০৬)
এই গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত৷ তিনি মৃত্যুদণ্ড প্রথা বিলুপ্ত করার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের সমালোচক ছিলেন, যিনি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মানসিকতাকে নিকৃষ্ট ভাবতেন৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/Highsmith
ফিলিস হুইটলে (১৭৫৩-১৭৮৪)
আফ্রিকায় জন্ম নেয়া এই নারীকে মাত্র সাত বছর বয়সে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল৷ তিনি তার মালিকের কাছে লেখাপড়া শিখেছিলেন৷ ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় এবং ১৭৭৩ সালে তিনি প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান হিসেবে কবিতা সংকলন বের করেন৷ জর্জ ওয়াশিংটন তার কবিতার প্রশংসা করে বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media
জেমস ফোর্টেন (১৭৬৬-১৮৪২)
সমুদ্র দেখা এবং জাহাজের পাল তৈরিতে প্রশিক্ষণ নেয়ার শখ ছিলো ফিলাডেলফিয়ার জেমস ফোর্টেনের৷ ১৭৯৮ সালে পাল তৈরির যে কারখানায় তিনি শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তা কিনে নেন এবং ধনী হয়ে ওঠেন৷ ক্রীতদাস বহনকারী কোনো জাহাজে তিনি পাল বিক্রি করতেন না৷ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তার অর্থ-সম্পদকে কাজে লাগিয়েছিলেন৷ সর্বকালের সেরা একশ আফ্রো-অ্যামেরিকানের তালিকায় তার নাম আছে৷
ছবি: public domain
সোজার্নার ট্রুথ (১৭৯৭-১৮৮৩)
ইসাবেলা বোমফ্রি নামে ক্রীতদাস হিসেবে জন্ম৷ ১৮২৭ সালে সন্তানসহ পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল তাকে৷ দাসপ্রথার অবসান এবং নারী অধিকার নিয়ে আইনি লড়াই লড়েছেন, সেসময় তার নতুন নাম হয় সোজার্নার ট্রুথ৷ ১৮৫১ সালে বর্ণ ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে তার বিখ্যাত বক্তব্য ছিল ‘আমি কি নারী নই?’ তিনি যৌনাঙ্গচ্ছেদেরও বিরোধিতা করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
মারিয়া ডাব্লিউ স্টুয়ার্ট (১৮০৩-১৮৭৯)
মুক্ত মানুষ হিসেবে জন্ম৷ একাধারে সাংবাদিক, মৃত্যুদণ্ডবিলোপপন্থি, প্রভাষক এবং নারী অধিকার আইনজীবী৷ তিনিই প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান, যিনি শ্বেতাঙ্গ-কৃষাঙ্গ নারী-পুরুষের সামনে বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘‘গায়ের রং নারী-পুরুষ নির্ধারণ করে না, আত্মা যে নীতির দ্বারা গঠিত, তা নির্ধারণ করে৷’’
ছবি: Gemeinfrei
হ্যারিয়েট টাবম্যান (১৮২০-১৯১৩)
১৮৪৯ সালে মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে যান ক্রীতদাস হ্যারিয়েট৷ ‘পাতাল রেলের কন্ডাকটার’ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন৷ আসলে ক্রীতদাসদের মুক্ত করতে ‘সেফ হাউজ’ তৈরি করতেন তিনি৷ পরবর্তীতে দরিদ্র ক্রীতদাসদের সাহায্য করতেন তিনি৷ ক্রীতদাস ব্যবসায়ী সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের বদলে ২০ ডলারের নোটে টাবম্যানের ছবি ব্যবহার করা হবে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
বুকার টি ওয়াশিংটন (১৮৫৬-১৯১৫)
গৃহযুদ্ধ তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল৷ তিনি ছিলেন প্রভাবশালী শিক্ষক, লেখক এবং অনেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা৷ আফ্রিকান-অ্যামেরিকানদের শিক্ষার মাধ্যমে এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের মানোন্নয়নের পরামর্শ দিতেন তিনি৷ তিনিই প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান যিনি ১৯০১ সালে কোনো প্রেসিডেন্টের সাথে খাবার খেয়েছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
আইডা বি ওয়েলস-বার্নেট (১৮৬২-১৯৩১)
গৃহযুদ্ধের আগে ক্রীতদাস ছিলেন বাবা-মা৷ তিনি একজন প্রভাবশালী সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা এবং ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালার্ড পিপল’ বা এনএএসিপি-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা৷
ছবি: Imago Images
জেমস ওয়েলডন জনসন (১৮৭১-১৯৩৮)
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আফ্রো-অ্যামেরিকান অধ্যাপক, যিনি প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের অধীনে কূটনীতিক ছিলেন৷ তিনি এনএএসিপি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন৷ বর্ণবিদ্বেষ এবং কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন৷ তার লেখা কবিতা ‘লিফট এভরি ভয়েস অ্যান্ড সিং’ পরবর্তীতে ‘আফ্রো-অ্যামেরিকান জাতীয় সংগীতে রূপ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/Everett Collection
ডাব্লিউ ই বি ডু বোইস (১৮৬৮-১৯৬৩)
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, যিনি একাধারে এনএএসিপি’র প্রতিষ্ঠাতা, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ এবং নাগরিক অধিকার কর্মী৷ ১৮৯৫ সালে তিনি ওই ডিগ্রি পান৷ দাস-বাণিজ্যের উপর তিনি থিসিস লিখেছিলেন৷ মেধাবী শিক্ষার্থী হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেননি৷ ১৯১৯ সালে প্যারিসে প্রথম ‘এক্সিবিট অফ অ্যামেরিকান নিগ্রোস’ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন৷
ছবি: picture-alliance/Glasshouse Images
রোজা পার্কস (১৯১৩-২০০৫)
১৯৫৫ সালে একটি বাসে শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির জন্য নিজের আসন ছাড়তে রাজি না হওয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাকে৷ এই ঘটনা ‘মন্টগামরি বাস বয়কট’ আন্দোলনে রূপ নেয়৷ এর সূত্র ধরে মার্টিন লুথার কিং নাগরিক অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার হন৷ ‘নাগরিক অধিকারের প্রথম নারী’ এবং ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের জননী’ হিসেবে অমর হয়ে আছেন তিনি৷
ছবি: picture alliance/Everett Collection
12 ছবি1 | 12
পুলিশকর্মীদের কী হলো?
শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মী শন জি-কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েঝে৷ তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগও আনা হয়েছে৷ কাউন্টি শেরিফের তরফে প্রকাশিত বিবৃতিতে তার এই আচরণকে ‘যুক্তিহীন ও অসতর্ক সিদ্ধান্ত' বলা হয়েছে৷
গত সপ্তাহে গ্র্যান্ড জুরি শন জিকে অভিযুক্ত করে৷ ফার্স্ট ডিগ্রি খুনের সাথে তার বিরুদ্ধে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রসহ গুরুতর আঘাত ও অপেশাদার আচরণের অভিযোগ৷
দোষী সাব্যস্ত হলে খুনের দায়ে ৪৫ বছর পর্যন্ত কারাবাসের সাজা হতে পারে তার৷ সাথে ছয় থেকে ৩০ বছরের কারাবাস আঘাতের জন্য ও দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাবাস অপেশাদার আচরণের জন্য৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের পুলিশের হাতে মৃত্যুর যে ধারা চলছে, তারই তালিকায় নতুন নাম সোনিয়া ম্যাসি৷