জিকা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক আবার ফিরে এসেছে৷ আতঙ্ক বেশি এখন যুক্তরাষ্ট্রে৷ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, ভয়ংকর এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই আরো জোরদার করতে হবে৷ নইলে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়তে পারে জিকা৷
বিজ্ঞাপন
বলিভিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, এল সালভাদর, ফ্রেঞ্চ গিনি, গুয়াতেমালা, গায়ানা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, পানামা, প্যারাগুয়ে, সুরিনাম, ভেনেজুয়েলা, বার্বাডোস, গুয়াদেলোপ, হাইতি, মার্টিনিক, সেন্ট মার্টিন এবং পুয়ের্তো রিকোসহ ৩০টি দেশে গত বছর জিকা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ কয়েকটি দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল এই ভাইরাস৷ তবে গত কয়েকমাসে দেশগুলোতে আতঙ্ক অনেক কমেছে, পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে৷
বর্তমানে আলোচিত এক ভাইরাস ‘জিকা’৷ ভারত, পাকিস্তানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ এখনও এ থেকে মুক্ত৷ তবে সতর্ক থাকতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Dana
লক্ষণ
জ্বর, ব়্যাশ (চামড়ায় লাল ফুসকুড়ি), গোঁড়ালিতে ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া – জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত এ সব লক্ষণ দেখা দেয়৷ এছাড়া পেশীতে ও মাথায়ও ব্যথা হতে পারে৷ জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Almeida
নামকরণের ইতিহাস
‘জিকা’ নামটি নেয়া হয়েছে উগান্ডার জিকা বন থেকে৷ ১৯৪৭ সালে হলুদ জ্বর নিয়ে গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরা জিকা বনে একটি খাঁচায় একটি বানর রাখে৷ পরে বানরটি জ্বরে পড়লে তার দেহে একটি সংক্রামক এজেন্টের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়৷ ১৯৫২ সালে এর নাম দেয়া হয় জিকা ভাইরাস৷ এরপর ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ায় এক মানুষের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া যায়৷
ছবি: Reuters/R. Paiva
যেসব দেশে ছড়িয়েছে
২০১৫ সাল নাগাদ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকার কয়েকটি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে৷ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন নাগরিকের শরীরেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে৷
যেভাবে ছড়ায়
এডিস ইজিপ্টি নামের মশার কামড়ের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে৷ ফলে মশার কামড় থেকে বাঁচার যে উপায়গুলো আছে সেগুলো মেনে চললেই এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে৷
ছবি: picture-alliance/J. Gathany/Centers for Disease Control and Prevention via AP
গর্ভবতী নারীরা বেশি সাবধান!
সম্প্রতি একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না গবেষকরা৷ তাঁদের কারও মত হচ্ছে, কয়েকটি দেশে শিশুদের ‘মাইক্রোসেফালি’ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী মা৷ এই রোগ হলে শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন ঠিকমতো হয় না, ফলে শিশুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি অস্বাভাবিক বা বিলম্বিত হওয়া থেকে শুরু করে অকালে মারা যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়৷ বৈজ্ঞানিকভাবে অবশ্য এটি এখনও প্রমাণ করা যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Dana
ভ্যাকসিন নেই
এই রোগের চিকিৎসায় এখনও কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি৷ ফলে সতর্ক থাকাটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ৷ অবশ্য এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল৷
ছবি: Reuters/J. Cabezas
6 ছবি1 | 6
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাই এ উদ্যোগকে যথেষ্ট মনে করছেন না৷ সোমবার সেন্টার্স ফর ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-র প্রিন্সিপাল ডেপুটি ডিরেক্টর অ্যান শুচ্যাট হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, জিকা ভাইরাস সম্পর্কে তাঁরাই এখনো খুব পরিষ্কার ধারণা পাননি৷ মারাত্মক এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য আরো বড় পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন বলেও জানান তিনি৷ অ্যান শুচ্যাট বলেন, আগে যতটা ভয়ংকর মনে করা হয়েছে, জিকা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর৷ তাঁর মতে, জিকা সম্পর্কে জানার পরিধি বাড়াতে হলে এবং প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে হলে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সুপারিশ অনুযায়ী শিগগিরই অর্থ ছাড় দিতে হবে৷
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিসিজ-এর পরিচালক অ্যান্থনি ফাউসিও মনে করেন জিকা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত গবেষণার জন্য এই পরিমাণ অর্থ সত্যিই দরকার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘প্রেসিডেন্ট যখন ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার চেয়েছেন, বুঝতে হবে আমাদের আসলে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারই দরকার৷''
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকের পুয়ের্তো রিকোয় জিকা সংক্রমণ অনেক বেড়েছে৷ ৪৩৬ ব্যক্তির শরীরে ধরা পড়েছে জিকা সংক্রমণ৷ তাদের মধ্যে ৬০ জনই অন্তঃসত্ত্বা নারী৷ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগাম ব্যবস্থা না নিলে পুয়ের্তো রিকো থেকে জিকা যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ ডেনমার্কের আরথুস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক এসকিল্ড পেটারসেন মনে করেন, শুধু যুকরাষ্ট্রে নয়, দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতেও ঢুকে পড়তে পারে জিকা৷
এসিবি/ডিজি (এপি, এএফপি, রয়টার্স)
জিকা ভাইরাস ছড়ানো মশা মারতে মাছ ও ব্যাঙ
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় জিকা ভাইরাসের ‘ভেক্টর’ প্রতিরোধে নানা ধরনের পন্থা নেওয়া হচ্ছে – তাদের অধিকাংশই প্রকৃতিদত্ত অথবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে সৃষ্ট৷ লক্ষ্য হলো, মশার লার্ভা বা কীট বিনষ্ট করে মশা কমানো৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
মশককীট খেকো মাছ
এল সালভাদর-এর সান দিয়েগো সৈকতে কিশোররা জাম্বো নামের এক ধরনের মোটা স্লিপার মাছ ধরে আনে৷ পরে জল রাখার পিপেয় এই জাম্বো মাছ ছেড়ে দিলে, সেই মাছ মশার লার্ভে বা কীটগুলোকে খেয়ে ফেলে৷ ‘এডিস এজিপ্টাই’ মশার কামড় থেকেই জিকা ভাইরাস ছড়ায়৷ (ছবিতে ব্রাজিল-এর একটি মিষ্টি জলের মাছকে দেখা যাচ্ছে)৷
ছবি: Matheus Volcan
মশা দিয়ে মশা মারা
জিকা ভাইরাস মায়ের পেটের ভ্রুণে মাইক্রোসেফালি রোগের অবতারণা ঘটায়, যা থেকে নবজাতকের মস্তক ও মস্তিষ্কের বিকাশ স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট হয়৷ নয়ত জিকা ভাইরাসের জ্বর প্রাণঘাতী নয়৷ কলম্বিয়া আর ব্রাজিলেই জিকা ভাইরাসের প্রকোপ আপাতত সবচেয়ে বেশি৷ কলম্বিয়ার আন্তিয়োকিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মশকদের মধ্যে ওলবাখিয়া নামের একটি জীবাণু ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, যার ফলে এডিস মশা মানুষকে সংক্রমিত করতে পারবে না৷
ছবি: Imago
মশাখেকো ব্যাঙ
যেখানে বিপদ, সেখানেই ব্যবসা ফাঁদার সুযোগ ও সম্ভাবনা৷ তাই আর্জেন্টিনায় সাত ডলার দরে ব্যাঙ বিক্রি হচ্ছে – সেই ব্যাঙ নাকি মশার বংশ ধ্বংস করে মানুষজনকে এডিস আর জিকার হাত থেকে বাঁচাবে৷ এ কাজে ব্যাঙ নাকি মশা তাড়ানোর ক্রিমের চেয়ে বেশি কার্যকর৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE/P. Oxford
অরগ্যানিক কীটনাশক
‘এডিস এজিপ্টাই’ মশা শুধু জিকা নয়, ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস ও চিকুঙ্গুনিয়া জ্বরের ভাইরাসও বহন করে৷ এই মশার কীট ধ্বংসের জন্য পেরুতে কোকো, ইউকা, অ্যাসপারাগাস আর আলু মিশিয়ে একটি ‘বায়োলার্ভিসাইড’ বা অরগ্যানিক কীটনাশক তৈরি করা হচ্ছে৷
ছবি: AP
তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে মশার প্রজনন ক্ষমতা রোধ
ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে৷ মূল ধারণাটা হলো, মশকদের উপর রশ্মি বিকিরণের ফলে পুরুষ মশারা নিষ্ফলা হয়ে পড়বে, কাজেই নারী মশারা ডিম পাড়তে পারবে না৷
ছবি: Kerry Skyring
ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানো
এককালে গোয়ালঘরে যা করা হতো, জিকা-ডেঙ্গুর তাড়নায় সেই পুরনো পদ্ধতিই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন অধিকাংশ দেশেই ডিডিটি ছড়ানো নিষিদ্ধ৷ মুশকিল এই যে, ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানো গেলেও, মশার ডিম ও কীট অক্ষত থেকে যায়৷