ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নীরব কূটনীতির পথ বেছে নিয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার সঙ্কটে পড়ে এমন কিছুও করবে না বাংলাদেশ৷ এই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন সাবেক কূটনীতিকরাও৷
ছবি: Imago/UPI//Imago/Russian Look
বিজ্ঞাপন
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে নীরব কূটনীতির পথ বেছে নিয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার সঙ্কটে পড়ে এমন কিছুও করবে না বাংলাদেশ৷ এই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন সাবেক কূটনীতিকরাও৷
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পর অস্থির হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য৷ তৈরি হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি৷ পাল্টা জবাব দিতে এরইমধ্যে ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপনাস্ত্র হামলাও চালিয়েছে তেহরান৷ তবে দুই পক্ষই বলছে তারা কেউ যুদ্ধ চায় না৷
মধ্যপ্রাচ্যের এই অস্থিরতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে বাংলাদেশও৷ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সংঘাতে আমরা উদ্বিগ্ন৷ আমরা যুদ্ধ চাই না৷ সরকারের পক্ষ থেকে আমরা উভয়পক্ষের সরকারকে আহ্বান জানাবো তারা যেন এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ থেকে সরে আসে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারপও যদি যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ এই ধাক্কা বাংলাদেশেও লাগবে৷''
ইরানের শত্রু-মিত্র
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সর্ম্পকের অবনতি ঘটে৷ প্রভাব পড়ে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেও৷ ছবিঘরে দেখুন ইরানের আজকের শত্রু-মিত্র কারা, কার সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক৷
ছবি: Lisa Leutner/REUTERS
যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Barria
ইসরায়েল: আন্তরিকতা থেকে অবিশ্বাস
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান (১৯৫০ সাল)৷ রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ছবি: AP
সৌদি আরব: ঘাড়ের কাছে শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াইয়ে ইরানের চিরশত্রু সৌদি আরব৷ ১৯৭৯ সালে তেহরানের ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ দুই দেশ কখনও সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও চলছে তাদের ছায়াযুদ্ধ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদির দুইটি তেলক্ষেত্রে হামলার পেছনে ইরান রয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়াদ৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Yorulmaz
রাশিয়া: দখলদার থেকে মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে আস্তানা গাড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েকবছর দখলদারি বজায় রাখে তারা৷ শাহের শাসনামলেও সম্পর্ক ভাল ছিল না৷ এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার৷
ছবি: AP GraphicsBank
ইউরোপ: আলোচনায় সমাধান
ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইউরোপের সঙ্গেও তেহরানের সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে ৷ তবে প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানির সময়ে এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়৷ পরমাণুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউ বরাবরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিয়ে আসছে৷ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তি বাতিল করলেও ইউরোপের দেশগুলো তা এখনও বজায় রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
চীন: অস্ত্র আর বাণিজ্যের সম্পর্ক
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে তেহরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল চীন৷ বেইজিংয়ের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র ক্রেতা দেশের একটি ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে হয়েছে চীনকে৷ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের পর চীন জানিয়েছে তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ে সম্পর্ক অটুট থাকবে৷
ছবি: AP / DW-Fotomontage
ইরাক: সর্ম্পকে নতুন মোড়
সাদ্দাম হোসেনের চালানো হামলা থেকে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত ছিল আট বছর৷ তবে বর্তমানে বাগদাদের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের৷ দেশটির একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান৷ এইসব গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷
কথিত আছে লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর উত্থান ইরানের মাধ্যমেই৷ তাদের মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আস্তানাগুলো৷ ২০১৮ সালে হেজবোল্লাহ ও তাদের জোট দেশটির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ যার মধ্য দিয়ে লেবাননের সরকারে ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে৷ এছাড়াও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী আর ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের মিত্রশক্তি৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
ভেনেজুয়েলা: শত্রু যখন একই
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি৷ ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন৷ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়৷ একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/ABACA/Iran Presidency
বাংলাদেশ: পাঁচ দশকের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক৷ বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকা এসেছিলেন৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ৷ অক্টোবরে বাকুতে ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসার রুহানি ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করেন৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.৭৭ কোটি ডলারেরর পণ্য রপ্তানি করেছে দেশটিতে৷
ছবি: Fars
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে এরইমধ্যে গণমাধ্যমকে অবহিত করেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে৷'' তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘যদি বিশ্ব পরিস্থিতি অস্থিতিশীলতা হয়, তাহলে দুশ্চিন্তা আছে৷'' বাংলাদেশে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছেন৷ যে কারণে সরকার বিশ্বের সব জায়গায় স্থিতিশীলতা ও শান্তি চায় বলে জানিয়েছেন তিনি৷
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির প্রধান ফারুক খান ডয়চে ভেলেকে বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমরা চাই কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের ওপর হামলা চালাবে না৷ প্রত্যেক দেশের নিজের সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে থাকার অধিকার আছে৷ যে ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে ঘটেছে তা মধ্যপ্রাচ্যের জন্যেও ভালো নয়, বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যেও ভালো নয়৷ তাই উভয় পক্ষ আবেগের বশবর্তী না হয়ে বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমরা আহ্বান জানাই৷''
মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের এক কোটি ২২ লাখ প্রবাসী কর্মী আছেন৷ তারা বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠান৷ বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাতে বাংলাদেশে তেলের দাম, শ্রমবাজার, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য এই চারটি ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে৷
ফারুক খান
This browser does not support the audio element.
মধ্যপ্রাচ্যে সংকট আরো বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে৷ যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশকেও ক্ষতির মুখে ফেলবে৷ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার নিয়ে আর্থিক দিক ছাড়াও নিরাপত্তা সংকট তৈরি হবে৷ প্রভাব পড়বে মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বাণিজ্যেও৷ মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশের মধ্যে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে যে বড় ধরনের বিনিয়োগ আশা করছে বাংলাদেশ তাতে নেতিবাচক শংকা তৈরি হবে৷
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান ইস্যুতে বাংলাদেশ এখন নীরব কুটনীতি বা ‘সাইলেন্ট ডিপ্লোমেসি' অবলম্বন করছে৷ তাই এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতির বাইরে সরকারের কোনো পর্যায় থেকে কথা না বলার নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে৷ তবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন চাইবে বাংলাদেশ৷ ঢাকা মনে করছে, এখনও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি যে বাংলাদেশকে কোনো পক্ষ নিতে হবে৷ দুই দেশের সাথেই চলমান সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় এমন অবস্থান বজায় রাখতে চাইছে সরকার৷
বাংলাদেশের এই নীতিকে সঠিক বলে মনে করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অ্যামেরিকা বা ইরান কেউইতো আমাদের বলছে না যে তোমরা আমাদের পক্ষ নাও৷ আমাদের পক্ষে কোনো দিকে স্পষ্ট অবস্থান নেয়াও কঠিন৷ সরকারও তো বলেছে আমরা কোনো দিকে যাব না৷ আমার মনে হয় সরকারের এই অবস্থান ঠিক আছে৷ এটাই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক৷''
তার মতে, ‘‘আমি মনে করি না কোনো অলআউট ওয়ার হবে৷ তবে মধ্যপ্রাচ্য সব সময়ই একটু ঝামেলার জায়গা৷ ফলে এখনকার পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে সারাবিশ্বের মত আমাদেরও ক্ষতি হবে৷ তেলের দাম বাড়বে আর মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের যারা আছেন তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে৷ নতুন করে সেখানে কর্মী যাওয়া বাধাগ্রস্থ হতে পারে৷''
মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক
This browser does not support the audio element.
লিবিয়ায় বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য নীরব কূটনীতিকেই শ্রেয় মনে করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘একদিকে ইরান আরেক দিকে অ্যামেরিকা৷ অ্যামেরিকার সঙ্গে আছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইসরাইল৷ এই অঞ্চলে আমাদের লাখ লাখ লোক আছে যারা রেমিট্যান্স পাঠায়৷ আমরা যদি কোনো একটা পক্ষে অবস্থান নেই তাহলে আমাদের রেমিট্যান্সে আঘাত লাগবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলা করেছে ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে৷ তারা জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যার একটা জবাব দিচ্ছে৷ তবে যুদ্ধ চায় না৷ আর আমার মনে হয় না অ্যামেরিকাও যুদ্ধ বাধাবে৷ তারা অন্য কোনো দেশকে এমন কোনো ডিলেমায় ফেলবে বলে মনে হয় না যে, হয় আমরা সাথে নয় ওর সাথে থাক৷ তাই বাংলাদেশ যে এখন সাইলেন্ট ডিপ্লোমেসি নীতিতে আছে এটাই ঠিক আছে৷''
শহীদুল হক বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষের একটা ইরানমুখী মনোভাব আছে সত্য৷ কিন্তু আবেগ দিয়েতো আর সব হয় না৷ বুঝতে হবে ইরানী নেতৃত্বও যুদ্ধের দিকে যেতে চায় না৷ তারাও এটা বোঝে৷ আর আমাদের সাথে ইরানের এখন তেমন ব্যবসা-বাণিজ্য নেই৷ সেখানে আমাদের শ্রমবাজারও তেমন নেই৷''
এদিকে জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যার পর ঢাকায় ইরানি দূতাবাস একটি বিবৃতি দিয়েছিল৷ সেখানে এই হামলাকে বর্বরোচিত এবং কাসেম সোলেইমানিকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে এই বিবৃতির বাইরে আর কিছু বলতে রাজি হয়নি দূতাবাস৷ এছাড়াও ঢাকায় শ্রীলঙ্কার দূতবাসও একটি বিবৃতি দিয়েছে ঘটনার পর৷ তাতে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়৷ শ্রীলঙ্কা সব পক্ষকে ধৈর্য্য ধরে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে৷
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
একটা সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল ইরান৷ সেখান থেকে চিরশত্রুতায় রূপ নিয়েছে তাদের সম্পর্ক৷ কীভাবে এই মেরুকরণ ঘটল দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: gemeinfrei
ইরানের সরকার উৎখাত
১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক৷ তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে দেশটির তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেন৷ ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স এবং এবং মার্কিন সিআইএ ক্যু ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে উৎখাত করে৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
শাহের ক্ষমতা আরোহন
মোসাদ্দেকের পতনের পর ক্ষমতায় ফেরেন ইরানের নির্বাসিত শেষ সম্রাট রেজা শাহ পাহলভি৷ পরবর্তী দুই দশক ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব৷ এক পর্যায়ে মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয় পারস্য উপসাগরের দেশটি৷ যুক্তরাষ্ট্রের কোন অনুরোধই এসময় ফেলেননি শাহ, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার৷
ছবি: gemeinfrei
ইসলামী বিপ্লব
শাহের আমলে ইরানের তেল ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ ও অ্যামেরিকান কোম্পানিগুলোর৷ ইরানি জনগণের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে৷ ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন রেজা শাহ পাহলভি৷
ছবি: Getty Images/Afp
খোমেনির ফেরা
দুই সপ্তাহ পর দেশে ফেরেন নির্বাসিত নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনি৷ তিনি ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবের’ নেতৃত্ব দেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই দেশটির ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে৷ ৪৪৪ দিনের জন্য বন্দী হয় ৫২ অ্যামেরিকান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP/G. Duval
প্রথম অবরোধ
বন্দী সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার৷ দেশটিতে মার্কিন পণ্য রপ্তানি ও তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়৷ জব্দ করা হয় ইরানের ১২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ৷ বের করে দেয়া কূটনীতিকদের৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ইরাক-ইরান যুদ্ধ
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইরান আক্রমণ করে সাদ্দাম হুসেন৷ যুদ্ধ চলাকালে ইরাককে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, অর্থ, সামরিক প্রযুক্তি এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এই যুদ্ধ চলে আট বছর৷ এসময় লেবাননে ইরানের সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর হামলায় বৈরুতের একটি ব্যারাকে ২৪৪ অ্যামেরিকান নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/Bildarchiv
ইরানের বিমানে হামলা
১৯৮৮ সালে পারস্য উপসাগরে ইরানের একটি যাত্রিবাহী বিমানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র৷ নিহত হয় ইরানের ২৯০ জন যাত্রী৷ একে দুর্ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান৷ এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক আরও তিক্ততায় রূপ নেয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Taherkenareh
নতুন অবরোধ
ইরান সন্ত্রাসীদের মদত দেয়ার পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, এমন অভিযোগে দেশটিকে একঘরে করার জন্য প্রচার চালায় ক্লিনটন প্রশাসন৷ ১৯৯৬ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ইরানে বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন৷
ছবি: AP
সম্পর্ক সহজীকরণ
১৯৯৮ থেকে পরবর্তী দুই বছর মোহাম্মদ খাতামি সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ প্রকাশ করে ক্লিনটন প্রশাসন৷ এজন্য রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়৷ খাতামি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রস্তাব দেন৷ ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়৷
ছবি: AP
পরমাণু আকাঙ্ক্ষা
২০০৫ সালে আহমদিনেজাদের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের আবারও অবনতি ঘটে৷ ইরান এসময় পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে৷ বুশ ইরানকে সন্ত্রাসের রপ্তানিকারক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন৷ তবে ২০১৫ সালে ওবামা যুক্তরাষ্ট্র ও জোট রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তিতে বৈরিতার সেই বরফ কিছুটা গলে৷
ছবি: AP
যুদ্ধের দামামা
২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমানু চুক্তি বাতিল করে ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ওয়াশিংটন৷ দুই দেশের প্রক্সি ওয়ার অনেকটাই যুদ্ধাবস্থায় রূপ নিয়েছে চলতি বছরের তিন জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জেনারেল কাসিম সোলেইমানিকে হত্যার পর৷