দুই হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি এবং ৭০ জন ইসরায়েলির মৃত্যুর পর, মঙ্গলবার দুই পক্ষ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে৷ এরপর থেকে গাজায় চলছে আনন্দ উদযাপন৷
বিজ্ঞাপন
মিশরের মধ্যস্থতায় স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর গাজার আকাশ এখন শান্ত৷ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর গাজায় কোনো আক্রমণ চালানো হয়নি৷ গাজা থেকেও ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে কোনো রকেট ছোড়া হয়নি৷
জাতিসংঘের হিসেবে ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংকটে ফিলিস্তিনের নিহত হওয়া ২,১৪৩ জনের মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগই বেসামরিক লোক৷ আর ইসরায়েলের নিহত হওয়া ৭০ জনের মধ্যে ৬৪ জনই সামরিক বাহিনীর সদস্য৷
বিশ্বাস হচ্ছে না আমি বেঁচে আছি!
কথাটি বলেন গাজার বাসিন্দা ৩২ বছরের মাহা খালেদ৷ আন্দন্দ উদযাপন করার এক ফাঁকে তিনি বলেন, ‘‘আমি কখনো চিন্তাও করিনি যে শেষ পর্যন্ত শান্তি আসবে৷'' যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর গাজার রাস্তায় নেমে আসেন গাজাবাসীরা৷ রাস্তায় গাড়ির ভিড় জমে যায়৷ গাড়ি থেকে উচ্চস্বরে হর্ন বাজানো হয়৷ নারী, শিশু সহ অনেকেই ‘ভি' চিহ্ন দেখাতে থাকেন৷
গাজাবাসীর ‘লাইফলাইন’ টানেল নেটওয়ার্ক
গাজায় ইসরায়েলের হামলার অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে টানেলের কথা, যেগুলো হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করছে৷ এগুলো ধ্বংস করতে চায় ইসরায়েল৷ তবে এসব টানেল অন্য অনেক কাজেও ব্যবহার হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/landov
‘লাইফলাইন’ এবং চোরাচালানের পথ
ফিলিস্তিনিরা টানেল বা সুড়ঙ্গগুলোকে তাদের লাইফলাইন মনে করে, যদিও ইসরায়েল এগুলোকে বিবেচনা করে অস্ত্র চোরাচালান এবং চোরাগোপ্তা হামলার পথ হিসেবে৷ চারপাশ থেকে আবদ্ধ গাজার সঙ্গে বিশ্বের সংযোগের অন্যতম পথ এসব টানেল৷ এগুলো ব্যবহার করে এমনকি পশুও গাজায় নেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images
নিজেদের ভূমিতে কারাবন্দি
গাজায় প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের বাস৷ প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েল এবং মিশর থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে উঁচু দেয়াল দিয়ে৷ সীমান্ত চেকপোস্টগুলোতে রয়েছে কড়া পাহারা৷ একসময় মিশরের রাফা সীমান্ত ব্যবহার করে গাজার বাইরে যেতে পারতো ফিলিস্তিনিরা৷ কিন্তু ২০০৭ সালের জুনে হামাস গাজার ক্ষমতা নেয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে সেই সীমান্তও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণকাজ
আর তখন থেকে গাজাবাসী বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে একমাত্র টানেল বা সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে৷ এগুলো অধিকাংশক্ষেত্রে তৈরি করা হয় অনিরাপদ এবং সাধাসিধে উপায়ে৷ নির্মাণকাজে ব্যবহার হয় বেলচা এবং কাঠ৷ তরুণ ফিলিস্তিনিদের জন্য অর্থ উপায়ের অল্প কিছু মাধ্যমের একটি এই সুড়ঙ্গ খনন৷ তবে এই কাজে মৃত্যু ঝুঁকিও আছে৷
ছবি: Getty Images
গোপন প্রবেশপথ
টানেলে প্রবেশের পথ অধিকাংশক্ষেত্রে সাধারণ বাসাবাড়ির মধ্যে থাকে৷ মূলত বাইরে থেকে যাতে বোঝা না যায়, সেজন্য এই ব্যবস্থা৷ যারা এসব টানেল ব্যবহার করতে চান, তাদের এজন্য টাকা খরচ করতে হয়৷ ইসরায়েল মনে করে, গাজাবাসী টানেল ব্যবহারের জন্য যে টাকা খরচ করেন, তা অন্যান্য চাহিদা মেটাতে আরো ভালো কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images
নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র আনার পথ
ফিলিস্তিনিরা এসব টানেল ব্যবহার করে নির্মাণকাজের জন্য সিমেন্ট এবং অন্যান্য উপাদান গাজায় আনেন৷ ঘরবাড়ি তৈরি কিংবা সংস্কারে এগুলো দরকার হয়৷ এছাড়া ভোগ্যপণ্য, কাপড় এমনকি রকেট এবং বিস্ফোরকও টানেল দিয়েই গাজায় আসে৷
ছবি: DW/T. Krämer
সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে
গত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে গাজায় টানেল রয়েছে৷ ১৯৭৯ সালে ইসরায়েল এবং মিশরের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর রাফা শহরটি বিভক্ত হয়ে যায়৷ এর অর্ধেক চলে যায় মিশরের দখলে বাকিটা গাজার৷ তখন থেকেই শহরটির দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ এবং মালামাল পরিবহণের উপায় হয়ে ওঠে সুড়ঙ্গ পথ৷
ছবি: Getty Images
মিসাইল থেকে বাঁচার উপায়
এখন অনেক সাধারণ টানেলেও যোগাযোগের আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে৷ বিশেষ করে বিদ্যুৎ এবং টেলিফোনের কথা বলা যায়৷ সুড়ঙ্গ খননের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা মাটির উপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন টেলিফোনের মাধ্যমে৷ আর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যখন আক্রমণ করে, তখন অনেক ফিলিস্তিনি জীবন বাঁচাতে বা লুকিয়ে থাকতে টানেলে আশ্রয় নেন৷
ছবি: Getty Images
মিশরও ধ্বংস করছে সুড়ঙ্গ
শুধুমাত্র ইসরায়েলই গাজার সুরক্ষা নেটওয়ার্ক ধ্বংসের চেষ্টা করছে না৷ মিশরও এগুলোর বিরোধী৷ সেদেশের সিনাই উপত্যকায়ও হামাসের হামলার অভিযোগ রয়েছে৷ তাই মিশরের সেনারাও বছরের পর বছর তাদের ভূখণ্ডের নীচে থাকা টানেল ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/S.Al Farra
মাটির নীচে বিপদ
শুধুমাত্র ইসরায়েলি সেনাদের হত্যার উদ্দেশ্যেও অনেক সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছে৷ ২০০৪ সালে হামাসের প্রকাশিত এই ছবিতে কিছু বিস্ফোরক দেখানো হয়েছে যা ব্যবহার করে সেবছরের ডিসেম্বরে ইসরায়েলের একটি সেনা ঘাঁটির নীচে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল৷ এতে পাঁচ ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং দশজন আহত হন৷
ছবি: Getty Images
সুড়ঙ্গে মন্ত্রী
গাজা থেকে ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য তৈরি এই সুড়ঙ্গটি ২০১৩ সালে প্রদর্শন করেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোসা ইয়ালন৷ ইসরায়েলের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হামেস এই টানেল দিয়ে ইসরায়েলে হামলা এবং ইসরায়েলিদের অপহরণ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রমণ চলছেই
ইসরায়েল দাবি করেছে, গাজায় কয়েক ডজন টানেল ধ্বংসে সক্ষম হয়েছে তাদের সেনাবাহিনী৷ গত আট জুলাই থেকে গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল৷ এতে বুধবার (৩০.০৭.১৪) পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে বারোশ’র বেশি মানুষ, যাদের অধিকাংশই নিরীহ ফিলিস্তিনি৷
ছবি: picture alliance/landov
11 ছবি1 | 11
কী আছে চুক্তিতে?
ফিলিস্তিনের প্রধান আলোচক আজম আল-আহমেদ জানিয়েছেন, ‘‘মিশরের উদ্যোগের মধ্যে গাজার উপর থেকে অবরোধ আংশিকভাবে খুলে দেয়ার বিষয়টি রয়েছে৷ এর ফলে পণ্য-সামগ্রী সহ খাদ্য সহায়তা গাজায় প্রবেশ করতে পারবে৷ এছাড়া ওষুধ এবং পানি, বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও গাজায় ঢুকতে পারবে৷'' তবে কবে থেকে অবরোধ খুলে দেয়া হবে সেটা এখনো জানা যায়নি৷
এছাড়া মাছ ধরার জন্য গাজার জেলেদের ‘এখনই' নৌকা নিয়ে সাগরের ছয় মাইল পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷ ক'দিন পর সীমাটা বাড়িয়ে ১২ মাইল করা হতে পারে৷
চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার একমাসের মধ্যে আলোচনার জন্য আবারও দুই পক্ষের কায়রোয় মিলিত হবার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ ইসরায়েলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও একই রকম তথ্য দিয়েছেন৷
আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন
ফিলিস্তিনিরা এই চুক্তিকে ‘স্থায়ী' যুদ্ধবিরতি বলছে৷ আর ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা একে ‘শর্তহীন ও সময়ের ক্ষেত্রে বাধাহীন' চুক্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন৷
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই চুক্তির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়ে দুই পক্ষকেই ‘‘চুক্তির শর্তগুলো পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার'' আহ্বান জানিয়েছেন৷
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আশা প্রকাশ করেন যে, ‘‘এটা (চুক্তি) ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি চূড়ান্ত শান্তি চুক্তির মঞ্চ তৈরি করবে৷''