জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় অপেক্ষমান রাখা হয়েছে৷ তবে যে কোনো দিন তা ঘোষণা করা হতে পারে৷ এ নিয়ে মোট চারটি মামলার রায় অপেক্ষমান থাকলো৷
ছবি: AP
বিজ্ঞাপন
আর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের আপিল শুনানির জন্য আগামী ১৪ই জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেছেন আপিল বিভাগ৷
বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২-এ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়৷ রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তুহিন আফরোজ শেষ দিনের মতো যুক্তি উপস্থাপন করেন৷ তাঁর যুক্তি উপস্থাপন শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান বলে জানায়৷
গত বছরের ৩১শে ডিসেম্বর সুবহানের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের নয়টি অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল৷
সুবহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর নেতৃত্বে একাত্তরের ১৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকাররা পাবনার ঈশ্বরদী পৌরসভার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে তিন ব্যক্তিকে অপহরণ করে স্থানীয় রেলওয়ের কয়লার ডিপোতে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে৷ পরদিন ১৮ই এপ্রিল তাঁদের হত্যা করা হয়৷ ১৩ই এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী থানার পাকশি ইউনিয়নের যুক্তিতলা গ্রাম ও সংলগ্ন কয়েকটি বাড়িঘরে লুটপাটের পর আগুন দেয় এবং হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এবং মে মাসের ১৬ থেকে ১৯ তারিখের মধ্যে ঈশ্বরদীর অরণখোলা গ্রামে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ এসব অপরাধের পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সুবহান জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ৷
এছাড়া ঈশ্বরদী থানার সাহাপুর, পাবনা সদর থানার দোগাছি এবং কুলুনিয়া গ্রামে হত্যাযজ্ঞ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার জন্যও তাঁকে দায়ী করা হয়৷
পাবনার সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের মোমরাজপুর গ্রাম, কুড়িয়পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা, ফকিত্পুর গ্রাম, কন্দর্পপুর গ্রামের কাছে পদ্মা নদীর পাড় ও গুপিনপুর গামের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা এবং ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে৷
২০১২ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর পাবনার একটি ফৌজদারি মামলায় সুবহানকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে৷ ২৩শে সেপ্টেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানো হয়৷ ওই সময় থেকেই তিনি কারাগারে আটক আছেন৷
মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ নিয়ে মাওলানা সুবহানসহ চারটি মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান আছে৷ বাকি তিনজন হলেন সাবেক সংসদ সদস্য এবং জাতীয় পার্টির নেতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার৷ তিনি পলাতক আছেন৷ জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার৷
অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের আপিল শুনানির জন্য আগামী ১৪ই জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করেছে আপিল বিভাগ৷ গত ১৭ই জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২ মুজাহিদকে মুত্যুদণ্ডের রায় দেয়৷
ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে৷ এ বছর প্রথম রায়ে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন অভিযাগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে৷
ছবি: AP
কাদের মোল্লার ‘বিজয়প্রতীক’, দেশজুড়ে বিক্ষোভ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিতি পাওয়া কাদের মোল্লাকে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় এবং রায়ের পর কাদের মোল্লা আঙুল উঁচিয়ে বিজয়প্রতীক দেখানোয় শুরু হয় বিক্ষোভ৷
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে প্রবল অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দেখা দিলে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়৷ এর আগে শুধু আসামিপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল৷ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের পর জামায়াতে ইসলামীও বিক্ষোভে নামে৷ দলটি মনে করে, এ রায় যথার্থ হয়নি৷ সেই থেকেই শুরু রায়ের প্রতিবাদে হরতাল৷
ছবি: Reuters
সাঈদির ফাঁসির আদেশ
জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইবুনাল৷ প্রতিবাদে হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামি৷ জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ব্যাপক তাণ্ডব চালায়৷ সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির লুট, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ স্টেশনে হামলা,অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ – সবই ঘটেছে, অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে তখন৷
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তি দাবি
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার কয়েকজন ব্লগারের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয় মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত-এ ইসলাম৷ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁদের ‘নাস্তিক’ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়৷ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন এ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে৷ চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখে সরকার৷
ছবি: Reuters
অবশেষে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ
মঙ্গলবার সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসি দিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয় আপিল বিভাগ৷রায় ঘোষণার আগে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
উৎসবের আনন্দ
এ রায়ে আবার জেগে ওঠে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর৷ ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ শুনে সেখানে আবার নামে মানুষের ঢল৷ অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হতে চলেছে – এটাই তাঁদের আনন্দ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
জামায়াতের হরতাল, বিক্ষোভ
কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী৷ রায়কে ‘ভুল’ দাবি করে, অভিযুক্ত সব নেতার মুক্তির দাবিতে এ হরতাল ডেকেছে তারা৷ আবার বিক্ষোভে নেমেছে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা৷কাদের মোল্লার আইনজীবী জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যালোচনার জন্য আবেদন করা হবে৷ তবে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ রায় পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই৷