ইউক্রেন যুদ্ধ অস্ত্রের প্রচুর কেনা-বেচা হচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে তাতে অস্ত্রের বাজারের উন্নতি হচ্ছে না। যুদ্ধের জন্য মার খাচ্ছে ব্যবসা।
বিজ্ঞাপন
২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০০টি অস্ত্রের সংস্থা উৎপাদন বাড়িয়েছে। কিন্তু উৎপাদনের গড় বৃদ্ধি আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে। সম্প্রতি স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) একথা জানিয়েছে।
কোভিডের সময় থেকে অস্ত্র উৎপাদনের গড় বৃদ্ধি কমতে শুরু করেছিল বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে। কারণ, অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল সময় মতো পাওয়া যাচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তা আরো মার খেয়েছে বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। কোভিডের কারণে উৎপাদন বৃদ্ধির হার এক বছরে এক দশমিক নয় শতাংশ মার খেয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই হার আরো বেড়েছে বলে তাদের অনুমান।
সিপ্রির বক্তব্য, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলিতে অস্ত্রের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই তুলনায় কাঁচামালের সরবরাহ হচ্ছে না। ফলে চাহিদা থাকলেও অস্ত্রের উৎপাদন কম হচ্ছে। রিপোর্টে লেখা হয়েছে, এর ফলে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকায় সেনাবাহিনীর সংস্কার সংক্রান্ত যে পদক্ষেপগুলি নেয়ার কথা বলা হয়েছে, তা-ও সমস্যার মুখে পড়তে পারে। ইউরোপ এবং অ্যামেরিকা ইউক্রেনের জন্য হাজার হাজার ডলার বরাদ্দ করছে অস্ত্র এবং গোলা-বারুদ কেনার জন্য। কিন্তু চাহিদা মতো অস্ত্র মিলছে না বলে দাবি করা হয়েছে।
অস্ত্রের ইতিহাস পাল্টে দেয়া কালাশনিকভ
মিখাইল কালাশনিকভের নাম হয়তো অনেকেই জানেন না৷ কিন্তু কালাশনিকভ রাইফেল বা একে-৪৭ এর নাম জানেন না, এমন লোক পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন৷ চলুন জেনে নেই কালাশনিকভের কিছু তথ্য৷
ছবি: AP
কে এই কালাশনিকভ?
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দুই বছর পর ১৯১৯ সালের ১০ নভেম্বর রাশিয়ায় জন্ম নেন মিখাইল টিমোফেয়েভিচ কালাশনিকভ৷ কৃষক বাবা-মায়ের ১৯ সন্তানের মধ্যে ১৭তম৷ ছোটবেলায় কবি হতে চাইলেও ধীরে ধীরে যন্ত্রপাতির প্রতি আকর্ষণ জন্মায় তার৷ ১৯৩৮ সালে লাল ফৌজে বাধ্যতামূলক চাকরি নেয়ার পর শারীরিক ছোট আকৃতির কারণে তাকে যুক্ত করা হয় ট্যাংক ইউনিটে৷
ছবি: Getty Images
উদ্ভাবনী মন
লাল ফৌজের ট্যাংক ইউনিটে কাজ করার সময়ই ছোটখাট উদ্ভাবন করে সহযোদ্ধাদের তাক লাগাতেন কালাশনিকভ৷ শুধু ট্যাংক সংক্রান্ত নয়, ছোট অস্ত্রের ক্ষেত্রেও নানা নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি৷ তার নানা পরিকল্পনায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন লাল ফৌজের মার্শাল জর্জি ঝুকভ নিজ হাতে তাকে একটি হাতঘড়ি উপহার দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রথম সাবমেশিনগান
তখনকার সামরিক অস্ত্রের নানা ত্রুটি দেখে কালাশনিকভ আগ্রহী হয়ে ওঠেন নিজেই সাবমেশিনগানের ডিজাইন তৈরিতে৷ তার ডিজাইন করা প্রথম সাবমেশিনগান অবশ্য গ্রহণ করেনি লাল ফৌজ৷ কিন্তু তার এই আগ্রহের কথা বিবেচনা করে ট্যাংক রেজিমেন্ট থেকে কালশনিকভকে বদলি করা হয় আগ্নেয়াস্ত্রের বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন বিভাগে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Tass/M. Tereschenko
মিখটিম
কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৪৫ সালেই৷ ১৯৪৬ সালে সেই ডিজাইন নিয়েই রাইফেল প্রতিযোগিতায় নাম লেখান কালাশনিকভ৷ সেখানে তার গ্যাস টারবাইনের রাইফেলের ডিজাইনটিকে তার নাম অনুসারেই নাম দেয়া হয় মিখটিম৷ এই নমুনাটিই পরবর্তীতে পালটে দিতে থাকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের ইতিহাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Parhomenko
একে-৪৭, দ্য একে-৪৭
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অস্ত্র বলে ধরে নেয়া হয় এটিকে৷ ১৯৪৭ সালে মিখটিমের ডিজাইনকে আরো উন্নত করে কালাশনিকভ তৈরি করেন একটি রাইফেল৷ নাম দেয়া হয় আভটোমাট (স্বয়ংক্রিয়) কালাশনিকভ ১৯৪৭ বা সংক্ষেপে একে-৪৭৷ এরপরই এটি সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মূল অস্ত্রে পরিণত হয় এটি৷ একই সময়ে অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছিলেন লাল ফৌজের আরো দুই বিশেষজ্ঞ- ভাসিলি দেগতিয়ারিয়ভ এবং জর্জি স্পাগিন৷ দুজনই এটিকেই সর্বাধুনিক অস্ত্রের স্বীকৃতি দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Thomas
একেএম
১৯৫৯ সালে একে-৪৭ এর উন্নত ভার্সন হিসেবে পরিচিত হয় একেএম৷ একে পরিবারের অস্ত্রগুলোর মধ্যে এটিকেই সবচেয়ে বেশি সহজলভ্য বলে ধরে নেয়া হয়৷ ওয়ারসো চুক্তিতে স্বাক্ষর করা প্রায় সব দেশ তো বটেই, এশিয়া ও আফ্রিকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র দেশগুলোতেও ব্যাপক হারে শুরু হয় এর ব্যবহার৷
ছবি: Reuters/Shemetov
একে-৭৪
১৯৭৪ সালে একেএম রাইফেলকে আরো আধুনিক করে তোলেন মিখাইল কালাশনিকভ৷ তৈরি হয় একে-৭৪৷ ১৯৭৯ সালে আফগান যুদ্ধে প্রথম এর ব্যবহার করে সোভিয়েন সেনারা৷ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলো এখনও এই অস্ত্র ব্যাপক হারে একে-৭৪ ব্যবহার হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Ria Novosti/A. Druginyn
আরপিকে
এটি অবশ্য একে সিরিজের রাইফেল নয়৷ একেএম রাইফেল তৈরির সময়ই একটি লাইট মেশিনগানও ডিজাইন করেন কালাশনিকভ৷ এর নাম দেয়া হয় রুশনয় পুলেমিয়ত কালাশনিকভা বা আরপিকে অর্থাৎ হাতে বহনযোগ্য কালাশনিকভের মেশিনগান৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা দেশগুলো ছাড়াও বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও সার্বিয়াতেও উৎপাদন হয় এই মেশিনগান৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Kaze
আরো অস্ত্র
একে সিরিজের ২০০টি অ্যাসল্ট রাইফেল ডিজাইনের মধ্যে আরো বেশ কিছু রাইফেলও জনপ্রিয়তা পায় অস্ত্র বাজারে৷ এর মধ্যে রয়েছে একে-১০১, একে-১০২, একে-১০৩, একে-১০৪, একে-১০৫, একে-১২৷ এছাড়া, সাইগা সেমিঅটোমেটিক রাইফেলের ডিজাইনও কালাশনিকভের করা৷
ছবি: Getty Images/G.Frey
সহজলভ্যতা
একে-৪৭ এতো বেশি জনপ্রিয় ও সহজলভ্য যে অনেক গবেষক অস্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘পিপলস গান’ বা জনতার অস্ত্র৷ চীনসহ ৩০টিরও বেশি দেশে বৈধ উপায়েই ব্যবসার জন্য উৎপাদন হয় কালাশনিকভ৷ প্রতিবছর বাজারে নতুন করে আসে প্রায় ১০ লাখ কালাশনিকভ রাইফেল৷ দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, এই মুহূর্তে বিশ্বে ২০ কোটি কালাশনিকভ আছে, অর্থাৎ প্রতি ৩৫ জন মানুষের জন্য একটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Rehder
ব্যবহার, বিতর্ক
সেনাবাহিনীর জন্য এর উদ্ভাবন হলেও কালো বাজারেও ব্যাপক সহজলভ্যতা এই অস্ত্র৷ তালিবান ও আইএস থেকে শুরু করে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে সহজেই পৌঁছে গেছে এক-৪৭৷ এমনকি বাংলাদেশেও প্রায়ই নানা জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের কাছে একে-৪৭ থাকার তথ্য পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/Medyan Dairieh
মৃত্যু
দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে মারা যান মিখাইল কালাশনিকভ৷ পেপটিক আলসারে মৃত্যু হয় তার৷ ফেডারেল মিলিটারি মেমোরিয়াল সেমেট্রিতে কবর দেয়া হয় তাকে৷
ছবি: AP
অনুশোচনা
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে রুশ পত্রিকা ইজভেস্তিয়া কালাশনিকভের লেখা একটি চিঠি প্রকাশ করে৷ চিঠিটি তার মৃত্যুর ছয় মাস আগে রুশ অর্থোডক্স চার্চের নেতা পেত্রিয়ার্ক কিরিলকে লেখা৷ মৃত্যুশয্যায় ‘আত্মিক যন্ত্রণা’ উল্লেখ করে কালাশনিকভ জানতে চান, তার উদ্ভাবিত রাইফেলে মৃত্যুতে খ্রিস্টান হিসেবে তার দায় কতোটুকু৷ জবাবে কিরিল জানান, চার্চ সবসময় মাতৃভূমিকে রক্ষার পক্ষে৷ ফলে কালশনিকভ এবং সেনাবাহিনী ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য৷
ছবি: picture-alliance/ZumaPress
সম্মাননা
কালাশনিকভের সবচেয়ে জনপ্রিয় আবিষ্কারগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে হলেও, সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরও কমেনি তার উদ্ভাবন৷ ফলে দুই আমলেই ব্যাপক সম্মান পেয়েছেন তিনি৷ অর্ডার অব রেড স্টার, অর্ডার অব লেনিন, হিরো অব সোশ্যালিস্ট লেবার, অর্ডার ফর মেরিট টু দ্য ফাদারল্যান্ড, হিরো অব দ্য রাশান ফেডারেশন এর মধ্যে অন্যতম৷
ছবি: Reuters/P. Rebrov
ভাস্কর্য
মিখাইল কালাশনিকভকে সম্মান জানাতে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর শহরতলীতে স্থাপন করা হয় একে-৪৭ হাতে কালাশনিকভের একটি ভাস্কর্য৷ ভাস্কর্য উন্মোচন করেন কালাশনিকভের মেয়ে ইয়েলেনা৷ এরপর ভাস্কর্যকে গার্ড অব অনার দেয় রুশ সেনারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zmeyev
জাদুঘর
কালাশনিকভের ‘অসাধারণ’ সব কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে ইজেভস্ক শহরে রয়েছে কালাশনিকভ মিউজিয়াম৷ সেখানে কালাশনিকভের জীবনের নানা স্মৃতির পাশাপাশি তার তৈরি করা বিভিন্ন অস্ত্র, ডিজাইন তাকে নিয়ে লেখা বই দেখতে পাবেন দর্শণার্থীরা৷
ছবি: DW/E. Sherwin
16 ছবি1 | 16
রিপোর্টের বক্তব্য, অস্ত্র তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল আসে রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকা রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেই কাঁচামাল হাতে আসছে না। অন্যদিকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবসা সামান্য বাড়লেও তারাও সমস্যার মুখোমুখি। নিষেধাজ্ঞার কারণে অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অনুঘটক বা সেমি কনডাক্টর তারা জোগাড় করতে পারছে না। কাঁচামাল এবং অস্ত্র বিক্রির দাম পেতেও তাদের অসুবিধা হচ্ছে।
কোভিডের সময় থেকেই অস্ত্রের বাজারে মন্দা শুরু হয়েছিল। কাঁচামাল সরবরাহে সমস্যার কারণেই সে সময় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল, ২০২১ সালে অস্ত্রের বাজার আবার ঊর্ধ্বমুখী হবে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা হতে পারেনি বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
বিশ্বের প্রথম ১০০টি অস্ত্রের কোম্পানির মধ্যে ৪০টি অ্যামেরিকায়। অস্ত্র ব্যবসার অর্ধেকের বেশি তারা নিয়ন্ত্রণ করে। এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বে বৈধ অস্ত্র ব্যবসার মোট মূল্য ৫৯২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু মার্কিন কোম্পানিগুলির শেয়ার ২৯৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সাল থেকে অ্যামেরিকায় অস্ত্রের ব্যবসার পতন হয়েছে শূন্য দশমিক আচ শতাংশ। ইউরোপের কোম্পানিগুলির মোট অস্ত্র ব্যবসার শেয়ার ১২৩ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছরে সেখানে অস্ত্র ব্যবসা বেড়েছে চার দশমিক দুই শতাংশ।
এশিয়ার অস্ত্র কোম্পানিগুলির মোট শেয়ার ১৩৬ বিলিয়ন ডলার। ব্যবসা বেড়েছে পাঁচ দশমিক আট শতাংশ। তবে খেয়াল রাখতে হবে চীনের মোট অস্ত্র ব্যবসার পরিমাণ এখনো স্পষ্ট নয়। বিশ্বের একাধিক দেশকে অস্ত্র বিক্রি করে চীন।