1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আর নেপোয় মারে দই

১০ জানুয়ারি ২০২০

'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ' বা মধ্যপ্রাচ্যে ‘আঞ্চলিক যুদ্ধ' শুরু হওয়ার শঙ্কা থাকলেও পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে৷ আগেও অনেকবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ফিরে এসেছে বিশ্ব৷ অচিরেই বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না বলেই মনে হচ্ছে৷

ছবি: Reuters/J. Ernst

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েক দশক ধরে চলে স্নায়ুযুদ্ধ৷ নাৎসি জার্মানি ও অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে৷ একপক্ষ পুঁজিবাদী অ্যামেরিকার সঙ্গে, অন্যপক্ষ ঝুঁকে পড়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে৷ সোভিয়েত পতনের পর থেকে দীর্ঘদিন অ্যামেরিকা বলতে গেলে একক রাজত্ব চালিয়েছে বিশ্বজুড়ে৷ কিন্তু এখন আবার ফিরে আসছে সেই স্নায়ুযুদ্ধের যুগ৷ তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন৷

জাতীয়তাবাদের আবার পুনরুত্থান ঘটছে পৃথিবীতে৷ এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সামরিক শাসকেরা নন, হিটলারের মতোই গণতান্ত্রিক উপায়ে বিপুল জনপ্রিয়তার হাত ধরেই নব্য ফ্যাসিবাদীরা আসছেন ক্ষমতায়৷ কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদলে উগ্র জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুলছেন তারা৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডনাল্ড ট্রাম্প, ভারতে নরেন্দ্র মোদি এর জ্বলন্ত উদাহরণ৷

যে ইউরোপ এক শতাব্দীতে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল, সেই ইউরোপের নানা দেশেও পপুলিস্টদের উত্থান ঘটছে৷ ব্রিটেনের পপুলিস্টরা তো ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যকে বের করেই ছাড়লেন, কেবল সময়ের অপেক্ষা৷ গণতন্ত্রের তেমন একটা তোয়াক্কা না করে ক্ষমতায় থাকা রাশিয়ার পুটিন এবং চীনের শি জিনপিংও রয়েছেন৷

বিপুল পরাক্রমে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব নিয়েছে চীন৷ সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হলেও সামরিক শক্তিতে এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থানে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝখানে অবস্থান করায় রাশিয়াও দারুণভাবে ফিরে এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মাঠে৷ বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অর্থনীতিতে উন্নতি করছে, কিন্তু এদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়েও নানা সময়ে প্রশ্ন উঠেছে৷

অর্থনীতির এ নতুন মেরুকরণে টালমাটাল দেশগুলো৷ প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক দিয়েই এগিয়ে চলেছে৷ আফ্রিকার অনেক দেশ নতুন টাইগার বলে বিবেচিত হচ্ছে৷ ফলে অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত দেশগুলো এখন নতুন চ্য়ালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে৷ এমন অবস্থায় নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে জনগণের দৃষ্টি ফেরানো দরকার সবারই৷ সাম্প্রতিক সব যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যাবে এর সবকটির মূল কারণ একই৷

পুলওয়ামা কাণ্ডে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো বলে চিৎকার শুরু হলো৷ তখনও কিছু মানুষ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির একটা হাতিয়ার দরকার৷ থমকে থাকা অর্থনীতি, বেকারত্ব, শিক্ষা, জীবনমান এবং অন্যসব ‘বাস্তব' সমস্যাগুলো মানুষকে টানতে পারবে না, এটা বিজেপি নেতারা ভালোই বুঝেছিলেন৷ বাস্তবে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ভারত বা পাকিস্তান কারোরই তেমন কিছু না হলেও বোকা বনেছে জনগণ, লাভ হয়েছে নরেন্দ্র মোদির

এবারও উগ্র হিন্দুত্ববাদের ঝাণ্ডা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মোদি৷ নাগরিকপঞ্জি, নাগরিকত্ব বিল, বাবরি মসজিদ ইস্যু, ইত্যাদি নিয়ে সহজে ঘর উত্তপ্ত রাখতে পারলে পেটে পর্যাপ্ত খাবার না থাকার কথাও যে মানুষ ভুলে থাকতে পারে, এটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ ফলে ঘরের পাশে শত্রু পাকিস্তান জুজুর ভয় হয়ে ভালোই ভূমিকা রাখে নির্বাচনে৷

উত্তর কোরিয়া, মেক্সিকো এবং সবশেষ ইরানকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সকল কর্মকাণ্ডও এমন জুজু তৈরির উদাহরণ উদাহরণ৷ এরই মধ্য়ে অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে এ নিয়ে, অভিশংসন এবং পরবর্তী মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক চাপের মুখে রয়েছেন ট্রাম্প৷ কে না জানে, ঘরের বাইরে বড় শত্রু তৈরি করতে পারলে ঘরের মধ্যে শত্রুদের দমন সহজ হয়৷ নির্বাচনের আগে ঘরে বড় কোনো বিপদে পড়লে নভেম্বরের নির্বাচনের আগে এমন আরো নানা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা আমরা দেখতে পারি, সেটা ইরানও হতে পারে, আবার বিশ্বের অন্য কোনো প্রান্তের কোনো দেশও হতে পারে৷

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

ইরানে গত বছর দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়৷ বহু ছাত্রসহ কয়েক হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ কিন্তু বিক্ষোভ দমন করা যাচ্ছিলো না৷ মাঝেমধ্যেই নানা জায়গায় দেখা দিচ্ছিলো অসন্তোষ৷ ফলে ইরানের কমান্ডার কাসেম সোলেইমানি নিহত হলেও মার্কিনবিরোধী চেতনা আবার জাগিয়ে তুলে ঘরের অসন্তোষ আপাতত চাপা দেয়ার সুযোগও তৈরি হয়েছে ইরানের ইসলামি সরকারের৷ সোলেইমানির মৃত্যুর পর তার প্রতিটি জানাযায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম ও ‘ডেথ টু অ্যামেরিকা' স্লোগান একটি শত্রু তৈরি করে ঘরের শত্রুদের মুখ বন্ধ করতে পেরেছে রৌহানি সরকার৷

এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতাও এখন নড়বড়ে৷ তার বিরুদ্ধে চলছে ঘুস-দুর্নীতির তদন্ত৷ আঞ্চলিক বড় শত্রু ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখানোর সুযোগটা নেতানিয়াহুকেও এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিতে পারে৷

উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরনের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প, কিন্তু বাস্তবে করেননি কিছুই৷ বরং কিম জং উনের সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈঠকের পর উন সম্পর্কে প্রশংসাই শোনা গেছে ট্রাম্পের মুখে৷ লাতিন অ্যামেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে হুমকিধামকি দিলেও এখনও সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র৷ এর সব কয়টি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী ভূমিকায় ছিল রাশিয়া ও চীন৷ ফলে অভিশংসনের বিষয়টি না এলে হঠাৎ ইরানের সোলেইমানিকে হত্যার এতো বড় ঝুঁকি ট্রাম্প নিতেন না বলেই মনে হচ্ছে৷

সিরিয়ায় সব পক্ষই প্রক্সি যুদ্ধে নেমেছিল৷ আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করার প্রাথমিক লক্ষ্যে যে অ্যামেরিকা রাশিয়ার কাছে পরাজিত, তা প্রমাণিত৷ কিন্তু উল্লেখ্য, সিরিয়াতেও বিরোধী অবস্থানে থেকেও মুখোমুখি কোনো লড়াইয়ে জড়ায়নি কোনো পরাশক্তিই৷ বরং একসময় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলেও পরে তা আইএসবিরোধী যুদ্ধে পরিণত হয়৷ সব পক্ষের কমন শত্রু হওয়ায় সব পক্ষই নিজেদের এ যুদ্ধে জয়ীও প্রমাণ করতে পেরেছে৷

আরো একটি উদাহরণ বর্তমান লিবিয়া৷ গৃহযুদ্ধে রাশিয়া ও তুরস্ক মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছিল৷ সেখানেও নিজেরা লড়াইয়ে না জড়িয়ে বরং যুদ্ধবিরতির পথই বেছে নিয়েছে দেশ দুটি৷ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব বিভিন্ন ঘটনায় মুখোমুখি হয়েছে৷ কিন্তু গত বছর সৌদি আরবের দুটি বড় তেলক্ষেত্রে হামলায় ইরানকে দায়ী করলেও এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সৌদি আরব৷ ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধরত দুই পক্ষে ইরান ও সৌদি আরব প্রক্সি লড়াই করলেও কেউ নিজেরা সরাসরি মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি কখনই নেয়নি৷

ফলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা সম্ভব, এই মুহূর্তে বিশ্বযুদ্ধ তো নয়ই, দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধে জড়ানোর মতো হঠকারি সিদ্ধান্তও এখন কোনো দেশই নেবে না৷ বিভিন্ন দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত যে কয়টি সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সবই প্রক্সি ওয়ার বা হুমকিধামকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে৷

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা অনেকটাই পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের আদর্শকেন্দ্রীক মেরুকরণের ফলে৷ কিন্তু সে মেরুকরণ ব্যর্থ হয়েছে৷ নিশ্চিতভাবেই সমাজতন্ত্র পরাজিত হয়েছে৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চীন সমাজতান্ত্রিক সরকার কাঠামোতে থাকলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পরিণত হয়েছে এক খিচুড়িতন্ত্রে৷ উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতি আর নতুন করে হয়তো বলারও প্রয়োজন পড়ে না৷

সামরিক শাসন হোক, গণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ হোক, একনায়কতন্ত্র হোক, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অথবা ইসলামি বা হিন্দুত্ব উগ্রবাদ হোক, ক্ষমতা ধরে রাখাটাই এখন শাসকদের একমাত্র উদ্দেশ্য৷ ফলে যুদ্ধে জড়িয়ে সে ক্ষমতাকে অকারণ হুমকিতে ফেলার ঝুঁকি আগামী কয়েক দশকে কেউ নেবে বলে অবস্থা বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে না৷ আপাতত চূড়ান্ত কোনো মেরুকরণ তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ‘দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ' চলতেই থাকবে৷

কিন্তু এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় লাভ হচ্ছে কার, ক্ষতিই বা হচ্ছে কার? ওবামাকে টেক্কা দিয়ে মার্কিন জনগণকে নতুন কিছু দেয়ার ক্ষমতা রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের ছিল না৷ ফলে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন, বাইরের শত্রুকে৷ ওবামা প্রশাসনের স্বাস্থ্যসেবা বিল, বিশ্ব নেতাদের করা জলবায়ু চুক্তি, ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি সব ছুঁড়ে ফেলেছেন ট্রাম্প৷ এর আগে বুশ যেমন ‘শয়তানের অক্ষশক্তি' হিসেবে ইরান, ইরাক, উত্তর কোরিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন, সে তুলনামূলক সহজ ধারাকেই আবার ফিরিয়ে আনলেন ট্রাম্প৷

এর ফলে মার্কিন জনগণ নিজেদের ঘরে নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ও হবেন, এমনকি ঘরের বাইরেও শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন৷ কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডার তলে এসে তারাই আবার ‘মেইক অ্যামেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন' স্লোগানে ট্রাম্পকেই ভোট দিচ্ছেন৷

প্রায় প্রতিটি দেশেই এখন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে৷ ‘আমরাই সেরা' স্লোগান তুলে ক্ষমতায় থাকা সহজ হলে খাওয়া-পরার চাহিদা মোটানোর কষ্টকর পথ কে বেছে নেয়! বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে- যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই৷ এর অর্থটি জনগণেরও জানা, কিন্তু সঠিক প্রয়োগটি জানেন শুধু পপুলিস্ট নেতারাই৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ