ইরানের সেনা প্রধান কাসিম সোলেইমানিকে হত্যা করে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলো যুক্তরাষ্ট্র৷ ইরান ফুঁসছে৷ প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়েছেন খামেনি৷ তাহলে কি যুদ্ধ অনিবার্য? ডনাল্ড ট্রাম্প কি তাই চান?
বিজ্ঞাপন
নিজের দেশে তিনি ভালো নেই৷ এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেনেটে তার ইমপিচমেন্টের বিষয়টি আলোচনায় ওঠার কথা৷ তার আগে ইরাকে বিমান হামলায় জেনারেল কাসিম সোলেইমানিকে হত্যা করে নিজের দেশের সবার নজর অন্যদিকে ভালোভাবেই সরাতে পেরেছেন ট্রাম্প৷
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা প্রত্যাশিতভাবেই অন্যায় হামলায় এলিট বাহিনীর প্রধানকে হত্যার বদলা নিতে চেয়েছেন৷ অন্যদিকে সোলেইমানি নিহত হওয়ার পর টুইটার অ্যাকাউন্টে মার্কিন পতাকা শেয়ার করে একরকম আনন্দই প্রকাশ করেছেন ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' স্লোগানের মাধ্যমে উগ্রতা, বিভেদ আর ঔদ্ধত্বের প্রবক্তা হয়ে ওঠা ট্রাম্প৷
ট্রাম্প যে ইচ্ছে করেই যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করেছেন তা বুঝতে বেশিদূর যেতে হবে না৷ দু'দিন আগেই নিজের টুইট বার্তায় লিখেছিলেন বাগদাদের মার্কিন দূতাবাসে ‘‘কোনো প্রাণহানি বা আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে তার জন্য ইরানই দায়ী থাকবে৷ সেজন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে৷ এটা কোনো সতর্কবার্তা নয়, এটা হুমকি৷''
ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের ঘোষণা খামেনির
সোলাইমানি হত্যায় ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি৷ সোলাইমানি দেখানো পথে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছে লেবাননের হেজবুল্লাহও৷ চলুন দেখা যাক এই ঘটনায় কার প্রতিক্রিয়া কেমন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Office of the Iranian Supreme Leader
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা
দীর্ঘ টানাপড়েন, হুমকি-পালটা হুমকির পর অবশেষে ইরানের ওপর বড় আঘাত হানলো মার্কিন বাহিনী৷ ইরাকে মার্কিন বিমান হানায় নিহত হয়েছেন ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসিম সোলাইমানি৷ যার ফলে অ্যামেরিকা এবং ইরানের মধ্যে যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছিল, তা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Office of the Iranian Supreme Leader
পেন্টাগন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই এ হামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন৷ ভবিষ্যতে ইরানকে যেকোনো হামলার পরিকল্পনা থেকে বিরত রাখতেই সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে বলেও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে সংস্থাটি৷ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে অবস্থান করা মার্কিন নাগরিকদের রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dunaway
ডনাল্ড ট্রাম্প
বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে ইরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়ার হামলার পরই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন ট্রাম্প৷ বলেছিলেন, ‘‘কোনো প্রাণহানি বা আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে তার জন্য ইরানই দায়ী থাকবে৷ সেজন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে৷ এটা কোনো সতর্কবার্তা নয়, এটা হুমকি৷’’ সোলাইমানিকে হত্যার পর নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে মার্কিন পতাকা শেয়ার করেছেন ট্রাম্প৷
ছবি: Getty Images/D. Angerer
মার্কিন কংগ্রেস
তবে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান এলিওট এনজেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, কংগ্রেসকে অবগতকরণ কিংবা কোনো আলোচনা ছাড়াই সোলাইমানির বিরুদ্ধে হামলা চালানো হয়েছে। কংগ্রেসকে না জানিয়ে এমনতর গুরুতর পদক্ষেপ সরকারের কংগ্রেস অবমাননার শামিল বলেও মন্তব্য করেন এনজেল।
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Schwenkenbecher
খামেনির প্রতিশোধের বার্তা
কুদস ফোর্সের প্রধান কাসিম সোলাইমানিকে যারা হত্যা করেছে সেই ‘অপরাধীদের’ জন্য ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি। খামেনি বলেছেন, “প্রতিরোধ বাহিনীর জিহাদ দ্বিগুণ উদ্যমে অগ্রসর হবে, অবশ্যই পবিত্র এ যুদ্ধে যোদ্ধাদের জন্য নিশ্চিত বিজয় অপেক্ষা করছে।’’ সোলেইমানির মৃত্যুতে তিনদিনের ‘রাষ্ট্রীয় শোকের’ ঘোষণাও দিয়েছে ইরান।
ছবি: ravapress.ir
হেজবুল্লাহর শোক
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়েছে লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ আন্দোলন৷ এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ বলেছেন, বিশ্বজুড়ে সব প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাজ ও দায়িত্ব হচ্ছে এসব খুনি অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দেয়া। সোলাইমানির দেখানো পথে হেজবুল্লাহ অগ্রসর হবে বলেও জানান নাসরাল্লাহ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/B. Hussein
ইরানের পাশে রাশিয়া
সোলাইমানির হত্যা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা উসকে দেবে বলে মন্তব্য করেছে রাশিয়া৷ সংবাদ সংস্থা তাস পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, ‘‘সোলাইমানি পরম বিশ্বস্ততার সঙ্গে ইরানিদের স্বার্থ সুরক্ষায় কাজ করেছেন। আমরা ইরানি জনগণের প্রতি গভীর শোক জানাচ্ছি।’’
ছবি: picture-alliance/dpa/TASS/A. Shcherbak
ইরাকে যুদ্ধের শঙ্কা
মার্কিন হামলায় সোলাইমানি ছাড়াও ইরাকি কমান্ডার আবু মাহদি আল মুহান্দিসসহ আরো চারজন নিহত হয়েছেন৷ এই হামলাকে আগ্রাসন আখ্যা দিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদেল মাহদি। এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, ইরাকের মাটিতে মার্কিন সেনা উপস্থিতির শর্তের লঙ্ঘন ঘটেছে এ হামলায়। এর ফলে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি৷ মুহান্দিস ছিলেন আধা সামরিক বাহিনী হাশেদ আল-শাবির উপপ্রধান।
ছবি: Getty Images/AFP/A. Al-Rubaye
তেহরানে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢল
ইরাকে মার্কিন হামলায় ইরানি জেনারেল নিহতের ঘটনায় তীব্র বিক্ষোভ চলছে তেহরানে৷ জুম্মার নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছেন রাস্তায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Salemi
ট্রাম্পের পাশে ইসরায়েল
রাষ্ট্রীয় সফরে গ্রিসে থাকা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সফর সংক্ষেপ করে দেশে ফেরত গেছেন৷ এয়ারপোর্টে সাংবাদিকদের নেতানিয়াহু বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের নিজেকে রক্ষার অধিকার রয়েছে৷ ট্রাম্প দক্ষভাবে সে কাজটিই করেছেন৷ ইসরায়েল ট্রাম্পের পাশে আছে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/AP/Y. Karahalis
10 ছবি1 | 10
আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি তার কড়া জবাব দিলেও মার্কিন দূতাবাস থেকে বিক্ষোভকারীরা সরে গিয়েছিল৷ তারপর তো পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হওয়ার কথা৷ ট্রাম্প চাইলে তাই হতো৷ কিন্তু কংগ্রেসকে কিছু না জানিয়ে তিনি হামলার নির্দেশ দিয়ে দিলেন পেন্টাগনকে৷
হামলার নির্দেশ দিয়ে আর ইরানের এলিট বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের একটা পতাকা টুইট করে ট্রাম্প আপাতত চুপ৷
মধ্যপ্রাচ্যের একাংশে নেমেছে শোকের ছায়া, বাড়ছে ক্ষোভ আর আতঙ্ক৷ তার প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়বে৷ তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে৷ মার্কিন হামলায় সোলেইমানির সঙ্গে ইরাকি কমান্ডার আবু মাহদি আল মুহান্দিসসহ আরো চারজন নিহত হয়েছেন৷ তাই ইরাকও ক্ষুব্ধ৷ ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদেল মাহদি ইতিমধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন৷
যুদ্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে ডনাল্ড ট্রাম্পের৷ দেশে যে কিছুটা কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছিলেন সে অবস্থা হয়ত খানিকটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন৷
আর লাভ অস্ত্রবিক্রেতাদের৷
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ইরান আর ইরাকের৷ সেই দেশদুটোর সাধারণ মানুষের৷ আশির দশকে প্রায় আট বছর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছে তারা৷ সেই যুদ্ধ শেষেও ইরাকের মানুষ বেশিদিন শান্তিতে থাকতে পারেনি৷ ১৯৯০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত চলা উপসাগরীয় যুদ্ধের ক্ষত শুকানোর আগে ২০০৩ সালে আবার পড়ে যুদ্ধের খপ্পরে৷ আট বছরের সেই যুদ্ধে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার দেশটি আজ বলতে গেলে আস্ত একটা ধংসস্তূপ৷
যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের জন্যও বিপদ৷ মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছেন এমন বাংলাদেশীরা সংকটে পড়বেন৷ তার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তো পড়বেই৷
প্রাক মধ্যযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ - যখন বিশ্বের যে প্রান্তে যত যুদ্ধ হয়েছে, তাতে আখেরে মানবতার ক্ষতিই হয়েছে৷ লক্ষ-কোটি মানুষ মরেছে৷ ধংস হয়েছে ভূখন্ড, ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি৷
যুদ্ধের ধংসযজ্ঞ ট্রাম্প বা অন্য কোনো কোনো যুদ্ধবাজ চাইতে পারেন, আমরা চাই না৷ আমরা শান্তি চাই৷