প্লাস্টিকের বোতল নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলুন৷৷ কারণ এই বোতলটি যাতে নতুন হয়ে আবার আপনার কাছে ফেরত আসতে পারে, সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ সেটি কেমন করে, তা জানতে যেতে হবে জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের একটি কারখানায়৷
বিজ্ঞাপন
প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যা হল, এটা সহজে ভাঙে না৷ জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান পুরোনো পিইটি বোতল থেকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য একরকমের দানা তৈরি করেছে, যা থেকে প্লাস্টিকের পুরো বোতল তৈরি করা যাচ্ছে৷ প্রতিদিন এমন চারশ' বেল বর্জ্য আসে এখানে৷ একেকটা বেলের ওজন আড়াইশ' কেজি৷ প্রতিটিতে থাকে ১০ হাজার বোতল৷ খরচও আছে৷
কোম্পানির নাম আরসিএস কাঁচামাল ব্যবহারকারী কোম্পানি৷ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলেক্সান্ডার রিমার বলেন, ‘‘যেহেতু এটি উচ্চমান সম্পন্ন কাঁচামাল, আমাদের এসব বেলের জন্য টনপ্রতি প্রায় তিনশ' থেকে পাঁচশ' ইউরো খরচ করতে হয়৷''
প্রথমে বেলগুলো খুলে কনভেয়ার বেল্টে বোতলগুলো দেয়া হয়৷ এখানে যা আসে সবই পিইটি বোতল৷
প্রথমে রঙ ও উপাদান মাফিক বোতলগুলো আলাদা করা হয়৷ এই সিস্টেম পিইটি বোতল বাদে বাকি সবকিছু চিনে ফেলে এবং আলাদা করে দেয়, যেমন বোতলের মোড়ক বা থলে৷
এরপর ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে টুকরো করে ধুয়ে ফেলা হয়৷ এই প্লাস্টিকের রাসায়নিক নাম হল পলিইথিলিন টেরেফথালেট৷ এখানেই পিইটি ফ্লেক্স তৈরি করা হয়৷
এই ফ্লেক্সগুলোকে সবশেষ আরেকবার আলাদা করে পরিষ্কার করা হয়৷ প্রক্রিয়াটিকে ঠিকঠাক চালানোর জন্য যন্ত্রগুলোকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের টুকরো স্ক্যান করতে হয়৷ ফ্লেক্সগুলোকে একটি লেজার রশ্মি সেকেন্ডে লাখ দশেকবার আঘাত করে৷ সেন্সরে তখন ময়লা কণাগুলো ধরা পড়ে৷ এরপর যন্ত্র তা পরিষ্কার করে নেয়৷
পানামায় প্লাস্টিকের বোতলের দুর্গ
পরিবেশ দূষণের একটা বড় কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য৷ এটি সমুদ্রের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর৷ এই ক্ষতি কমাতে এক ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিলেন এক ক্যানাডিয়ান৷ পানামার একটি দ্বীপে তৈরি করলেন পুরোনো প্লাস্টিক বোতলের প্রাসাদ৷
ছবি: Oliver Ristau
প্লাস্টিকের দুর্গ
পানামার বোকাস দেল তোরো রাজ্যের প্রধান দ্বীপ ইসলা কোলোনের গ্রীষ্মমন্ডলীয় গাছপালার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যযুগীয় ধাঁচে তৈরি অদ্ভুত এই প্রাসাদটি৷ প্রায় ৪০,০০০ পুরোনো পেট বোতল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এটি৷ কারণ? প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা৷
ছবি: Oliver Ristau
সমুদ্রের জন্য হুমকি
প্রাসাদটির প্রবেশদ্বার ও ভেতরে নানা চিত্রকর্মে দেখানো হয়েছে কিভাবে বিশ্বের সমুদ্রগুলো প্লাস্টিকের কারণে দূষণের শিকার হচ্ছে৷ গবেষণা দল ‘ফিউচার ওশান’-এর মতে, বছরে ৩০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্যের অল্প পরিমাণই প্রক্রিয়াজাত করে পূনর্ব্যবহারযোগ্য করা হয়৷ অপরিশোধিত বর্জ্যের অনেকটুকুই যায় সমুদ্রের জলে, ২০১০ সালে যার পরিমাণ ছিল ৪৮ লাখ টন থেকে ১ কোটি ২৭ লাখ টন পর্যন্ত৷
ছবি: Oliver Ristau
রবার্টের স্বপ্ন
নয় বছর আগে ক্যানাডার রবার্ট বেজেয়াউ মূলত অবসরের পরিকল্পনা নিয়েই বোকাস দেল তোরোতে এসেছিলেন৷ কিন্তু সেখানে কতটা বর্জ্য উৎপাদিত হয় তা নিয়ে দ্বীপ কর্তৃপক্ষের এক গবেষণায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নিয়ে বনে যান প্লাস্টিক দূষণবিরোধী প্রচারক৷ তিনি বলেন, ‘‘যদি পৃথিবীর ৭৩০ কোটি মানুষ প্রতিদিন এক বোতল করে পানীয় পান করেন, তাহলে বছরে ২৬ হাজার ৬শ’ কোটি বোতল বর্জ্য তৈরি হয়৷’’
ছবি: Oliver Ristau
ক্যারিবিয়ান স্বর্গ
বছর বছর মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডা থেকে হাজারো পর্যটক ছুটি কাটাতে আসেন এই দ্বীপপুঞ্জে৷ চমৎকার সব বার ও রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি এসব দ্বীপে আছে ম্যানগ্রোভ বন, টলটলে সমুদ্র ও মনোরম সৈকতের মতো প্রকৃতির সমারোহ৷ কিন্তু পর্যটকের স্রোতের কারণে তৈরি হয় প্রচুর বর্জ্য, যার শেষ ঠিকানা হয় সমুদ্র, কারণ, এদের পর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা নেই৷
ছবি: Oliver Ristau
রবার্টের সংগ্রহ
৬২ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট এই দ্বীপেই বছরে জমা হয় প্রায় পনের লাখ খালি বোতল৷ রবার্ট এগুলো সংগ্রহ করেন তাঁর নির্মাণ প্রকল্পের জন্য৷ শুধু সাধারণ পানীয়ের বোতলই তিনি ব্যবহার করতে পারেন, কারণ, অন্য বোতলগুলোতে দাহ্য উপাদান থাকে৷
ছবি: Oliver Ristau
প্লাস্টিক ও লোহার ব্যবহার
প্রথমে লোহার খাঁচায় প্লাস্টিকের বোতলগুলোকে একটার ওপর আরেকটা রাখা হয়৷ এরপর এগুলোর ওপর সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে দেয়াল বানানো হয়৷ প্রতিটি দেয়ালে ৩০০টি অর্ধলিটার বা ১২০টি দেড় লিটারের বোতল আঁটে৷ শুধু মধ্যযুগীয় শৈলীতে বানানো ত্রিকোণ জানালাগুলো এইভাবে তৈরি সম্ভব হয় না৷
ছবি: Oliver Ristau
স্থাপত্যের নতুন জ্ঞান
এই পদ্ধতিতে খুবই সাধারণ ভবন তৈরি করা সম্ভব, যার জন্য প্রায় ১৪,০০০ বোতল দরকার৷ রবার্ট একটি সেন্টার খুলতে চান, যেখানে তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কিভাবে কম খরচে প্লাস্টিক বোতলকে নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তার প্রশিক্ষণ দেবেন৷ তাঁর মতে, এর একটা বড় উপকার হলো, বোতলের ভেতরকার বাতাস তাপ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে৷
ছবি: Oliver Ristau
তথ্য রিসোর্ট
দুর্গটিতে ঘুরে পর্যটকরা প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারেন৷ আর এখান থেকে যে অর্থ উপার্জিত হবে তা দিয়ে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করতে চান রবার্ট৷ তাঁর আশা, বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে বর্জ্য তৈরি হবেই, সেখানে এগুলো দিয়ে অর্থবহ কিছু করা৷
ছবি: Oliver Ristau
8 ছবি1 | 8
জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের কোম্পানি ইউনিসেন্সর এই যন্ত্রের উদ্ভাবক৷ এর প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন অপটিওইলেকট্রনিক্সের একজন প্রফেসর৷ তার মেয়ে স্টেফানি ক্রিগ এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক৷
‘‘ফ্লেক্সগুলোর ওপর লেজার আঘাত করে৷ ফ্লেক্সগুলো তখন লেজারের শক্তি শোষণ করে এবং আবার বিকিরণের মত সেই শক্তি পরিবেশে ছাড়ে৷ এই শক্তি আবার যন্ত্রে প্রবেশ করে এবং স্পেক্ট্রোমিটারে তা মাপা হয়,'' বলেন স্টেফানি৷
তারা ১০০টিরও বেশি এমন সিস্টেম বিক্রি করেছেন এবং সামনে আরো বিক্রি করবেন৷ কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন শুধু বোতল নয়, দইয়ের কৌটার মত প্লাস্টিক পণ্যেও রিসাইকেল করা পিইটির ব্যবহার বাড়াতে চাইছে৷
শিল্প প্রকৌশলী স্টেফানি ক্রিগের ভাষায়, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ ভাগ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ ভাগ পণ্য পুনর্ব্যবহার করতে চাইছে৷ এমনকি খেয়াল করলে দেখবেন, ২০১৯ সাল থেকেই এমন যন্ত্রের চাহিদা বেড়েছে৷''
প্লাস্টিক দিলে মিলবে বই
ইন্দোনেশিয়ার এক লাইব্রেরিয়ান বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলছেন শিশুদের৷ সেই সঙ্গে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতাও বাড়াচ্ছেন অভিনব উপায়ে৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Ajeng Dinar Ulfiana/REUTERS
ছোট উদ্যোগ, বড় প্রভাব
রাদেন রোরো হেনদারতি প্রতি সপ্তাহান্তে তার তিন চাকার গাড়ি নিয়ে ছুটে যান মুনতাগ গ্রামে৷ তাকে দেখে ছুটে আসে শিশুরা৷ আসে বই পড়তে৷ তারা কুড়িয়ে আনা প্লাস্টিক তুলে দেয় রাদেনের হাতে, তার বিনিময়ে পায় মজার মজার বই৷ তিন চাকার গাড়ি নিয়ে লাইব্রেরিয়ান রাদেন যখন বাড়ি ফেরেন, মন জুড়ে থাকে শিশুদের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের মাঝে পরিবেশ-সচেতনতাও বাড়াতে পারার আনন্দ!
ছবি: Ajeng Dinar Ulfiana/REUTERS
প্লাস্টিকের ‘সদ্ব্যবহার’
কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিকের কাপ, ব্যাগ ইত্যাদির বিনিময়ে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার থেকে বই নিয়ে শিশুরাই যে শুধু উপকৃত হয়, তা কিন্তু নয়৷ ইন্দোনেশিয়ায় পরিবেশ দূষণে বড় ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিক৷ রাদেন বইয়ের বিনিময়ে পাওয়া প্লাস্টিক তার সহকর্মীদের সহায়তায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য করেন, কিছু সামগ্রি বিক্রিও করেন৷
ছবি: Ajeng Dinar Ulfiana/REUTERS
‘আবর্জনার লাইব্রেরি’
তিনচাকার গাড়ি শিশুদের কাছে যায় ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হয়ে আর ফেরে প্রতিবার ১০০ কিলোগ্রামের মতো প্লাস্টিক নিয়ে৷ তাই উদ্যোক্তারা তিন চাকার গাড়িটির নাম দিয়েছেন ‘ট্র্যাশ লাইব্রেরি’, অর্থাৎ ‘আবর্জনার লাইব্রেরি’৷ রাদেন মনে করেন এমন পাঠাগার আরো অনেক দরকার, কারণ, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করে এই পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে এ ধরনের আবর্জনা কমানোর কাজও গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে৷’’
ছবি: Ajeng Dinar Ulfiana/REUTERS
পরিবেশ-সচেতন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
মুনতাগ গ্রামের অনেক শিশুকে এখন আর বই পড়া বা ঘরে-বাইরের প্লাস্টিক সংগ্রহ করে রাদেন রোরোর হাতে তুলে দেয়ার কথা বলতে হয় না৷ সময় করে নিজের উদ্যোগেই প্লাস্টিক সংগ্রহ করে সপ্তাহান্তে নতুন বই পাওয়ার আশায় জমায় তারা৷ স্কুল ছুটির পরও একসঙ্গে বসে বই পড়তে দেখা যায় তাদের৷
ছবি: Ajeng Dinar Ulfiana/REUTERS
ভিডিও গেম ছেড়ে বইয়ের ভুবনে
রাদেন রোরো হেনদারতি আরেকটা পরিবর্তন এনেছেন গ্রামের শিশুদের জীবনে৷ গ্রামের যে শিশুরা আগে ভিডিও গেম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, তাদের অনেকেরই এখন সময় কাটে বইয়ের সান্নিধ্যে৷ করোনা সংকটের সময় সারা বিশ্বেই শিশুদের যেখানে ইন্টারনেট-নির্ভরতা বেড়েছে, জাভা দ্বীপের কাছে গ্রামটির চিত্র তখন একেবারে ভিন্ন৷
ছবি: Ajeng Dinar Ulfiana/REUTERS
শিক্ষায় অবদান
করোনা সংকটের সময় বিশ্বের অনেক দেশের মতো ইন্দোনেশিয়ারও অনেক স্কুল এখনো কার্যত বন্ধ৷ সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে সে দেশের অন্তত ৮০ ভাগ শিশু ওইসিডি-র ন্যূনতম মান অনুযায়ী পড়ালেখা করতে পারবে না৷ তিন চাকার গাড়িতে ছয় হাজার বই শিশুদের পড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে সেই আশঙ্কাও কিছুটা কমাচ্ছেন রাদেন৷
ছবি: Ajeng Dinar Ulfiana/REUTERS
6 ছবি1 | 6
রিসাইকেল যন্ত্রে পিইটি ফ্লেক্সগুলোকে প্রচণ্ড চাপে ও ২৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় গলানো হয়৷ এখান থেকেই প্লাস্টিকের দানা তৈরি করা হয়৷
তারা এগুলো বিক্রি করেন এবং এগুলো থেকে নতুন বোতল তৈরি করা হয়৷ এরপর এগুলোকে কয়েকবার রিসাইকেল করা হয়৷ বোতল ছাড়াও অন্য প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে কি এমন পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না?
আলেক্সান্ডার রিমার বলেন, ‘‘গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের এখন এমন পদ্ধতি আছে, যাতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পুরোটাই ফেরত পাওয়া সম্ভব৷ তার মানে অন্য প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রেও এটা ব্যবহার সম্ভব৷''
বিরাট থলেতে করে প্লাস্টিকের দানাগুলো বোতল প্রস্তুতকারকদের দেয়া হয়৷
এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের বোতলে নতুনের চেয়ে খরচ একটু বেশি পড়ে৷ তবে পরিবেশগত বিধিনিষেধের কারণে এখন পুনর্ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে৷ এই কোম্পানিটি নতুন রিসাইকেল প্ল্যান্ট বসানোর পরিকল্পনা করছে৷
বোতলের ক্ষেত্রে রিসাইক্লিং ভাল কাজ করছে৷ যদি নিত্যদিনের বর্জ্যের পাহাড় থেকে মুক্তি পেতে হয়, তবে অন্য পিইটি পণ্যেও এই প্রক্রিয়া কাজে লাগাতে হবে৷