একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটলেও অপরাধীরা ধরা পড়ছে না৷ তবে হত্যাকারীদের আটক করতে না পারলেও বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ব্লগারদের সীমা লঙ্ঘন না করার আহ্বান জানিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
গত শুক্রবার ঢাকায় ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে (নিলয় নীল) হত্যার মধ্য দিয়ে গত সাড়ে পাঁচ মাসে দুর্বৃত্তরা মোট চারজন ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ রোজার মাস বাদ দিয়ে তারা প্রতিমাসেই একজন করে হত্যা করেছে৷ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে তারা তালিকা ধরে প্রতিমাসে অন্তত একজন ব্লগারকে হত্যার মিশনে নেমেছে৷ তাই প্রশ্ন উঠছে এরপর কে? আর পুলিশ তা চেয়ে চেয়ে দেখছে৷''
গত ২৬শে ফেব্রয়ারি একুশে বইমেলার বাইরে টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক ও ডিডাব্লিউ-র দ্য বব্স পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ব্লগার অভিজিৎ রায়কে৷ একই ঘটনায় আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মাত্র এক মাসের মাথায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু৷ এরপর ১২ই মে, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকার কর্মস্থলে যাওয়ার পথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অপর মুক্তমনা ব্লগার ও সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অনন্ত বিজয় দাসকে৷ আর এ হত্যাযজ্ঞের সর্বশেষ শিকার নিলয় নীল৷
ব্লগার হত্যা অবশ্য শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে৷ শুধুমাত্র রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনাতেই এখন পর্যন্ত পুলিশ মূল আসামিদের গ্রেপ্তার এবং আদালতে চার্জশিট দিতে পেরেছে৷
নিলয় হত্যারহস্যও একই পথে?
আবারও ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে৷ এবার বাড়িতে ঢুকে জবাই করা হলো ব্লগার নীলয় নীলকে৷ বরাবরের মতো হত্যাকাণ্ডের পরই পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলেও, নিহতের পরিবার এ আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
ঘরে ঢুকে জবাই
গত ৭ আগস্ট ঢাকার উত্তর গোড়ান এলাকার বাসায় ঢুকে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ওরফে নিলয় নীলকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে৷ ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী নিলয়ের বয়স হয়েছিল ৪০ বছর৷ ভাড়া নেয়ার জন্য বাসা দেখতে চেয়ে ঢুকে পড়া চার দুর্বৃত্ত প্রথমে নিলয়ের স্ত্রী ও তাঁর ছোট বোনকে বারান্দায় বের করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়, তারপর জবাই করে নিলয়কে৷
ছবি: Twitter
পুলিশকে পাশে পাননি নিলয়
কিছুদিন ধরেই তাঁর ওপর হামলার আশঙ্কা করছিলেন নিলয়৷ তিন মাস আগে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, অচেনা কয়েকজন লোক তাঁকে অনুসরণ করছে৷ বিষয়টি জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি করার জন্য থানায় গিয়েছিলেন৷ পুলিশ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে তাঁকে বরং দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেয়৷ তাঁকে অনুসরণ করা এবং পুলিশের দেশ ছাড়ার পরামর্শের কথা ফেসবুকে নিলয় নিজেই লিখেছিলেন নিলয়৷
ছবি: Twitter
নিন্দার ঝড়, গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি
নিলয় নীল নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করেছে৷ নিলয়ের স্ত্রী আশামনি (ওপরের ছবিতে, বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়) এখনো কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
প্রতিবাদ
নিলয় হত্যার পর রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে৷ নিলয়সহ সব ব্লগার হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করার পাশাপাশি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং ব্যর্থতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, ‘‘এতদিন ব্লগারদের রাস্তায় হত্যা করা হতো, এখন বাসায় ঢুকে জবাই করা শুরু হলো৷ এই সরকার ব্লগার হত্যায় পৃষ্ঠপোষকতা করছে৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও বিচারহীনতার জন্যই হত্যাকাণ্ড চলছে
গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ ৩০শে মার্চ তেজগাঁও এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয় ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে৷ মৌলবাদীদের প্রাণনাশের হুমকির মুখে দেশ ছাড়া লেখিকা তসলিমা নাসরীন ধারবাহিকভাবে ব্লগার হত্যার জন্য শেখ হাসিনার সরকার এবং পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
আল-কায়েদার দায়িত্ব স্বীকার
শুক্রবারই নিলয় হত্যার দায় স্বীকার করে আল-কায়েদা৷ আল-কায়েদার ভারতীয় উপ-মহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা, আনসার আল-ইসলামের নামে সংবাদমাধ্যমে ই-মেল পাঠিয়ে ইসলামি জঙ্গি সংগঠনটি এ হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করে৷
ছবি: Fotolia/Oleg Zabielin
‘ধর্মের নামে সন্ত্রাস চলতে দেবো না’
এদিকে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্মরক্ষার কথা বলে মানুষ হত্যাকে ‘ধর্মের নামে সন্ত্রাস’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে এটা চলতে দেওয়া যাবে না৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম৷ যারা ধর্মকেও কলুষিত করে যাচ্ছে, তারা কখনোই ধর্মে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না৷ তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে কীভাবে ঘোষণা দেবে?’’
ছবি: Oli Scarff/Getty Images
‘সীমা লঙ্ঘন করবেন না’
পুলিশের আইজি একেএম শহিদুল হক বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ জানিয়ে ব্লগারদের প্রতি সীমা লঙ্ঘন না করার অনুরোধ জানিয়েছেন৷ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, ‘‘কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া উচিত নয়৷ কেউ তা করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’ ব্লগার হত্যাকারীদের ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের গ্রেপ্তারের আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জামায়াতের ‘ভুল’
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন নিলয় নীল৷ বিচারাধীন, সাজাপ্রাপ্ত এবং অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর নেতা৷ নিলয় নিহত হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় জামায়াত৷ তবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদের পাঠানো বিবৃতিতে নিলয় নীল নামে পরিচিতি নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের নাম লেখা হয় নীলয় হোসেন ওরফে নীল৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
9 ছবি1 | 9
ব্লগার অভিজিৎ হত্যায় সরাসরি জড়িত কাউকে এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ৷ হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে শফিউর রহমান ফারাবি নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও, তার কাছ থেকে কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি৷ আদালতেও কোনো স্বীকারোক্তি দেয়নি ফারাবি৷
তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন যে, তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাতজনকে চিহ্নিত করেছেন, গ্রেপ্তারেরএ চেষ্টা চলছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অভিজিৎ হত্যার দিন সেই এলাকায় থাকা পুলিশের ভিডিও ফুটেজ দেখে সাতজনকে শনাক্ত করে তাদের ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে৷''
ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার পর পর জনতার হাতে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল নামে দুই মাদ্রাসা ছাত্র ধরা পড়লেও, পুলিশ তাদের কাছ থেকে বাড়তি কোনো তথ্য আদায় করতে ব্যর্থ হয়৷ ওই দু'জনের সঙ্গে থাকা পলাতক আবু তাহের ও মাসুমকেও গ্রেপ্তার করা যায়নি৷
এছাড়া সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যার ঘটনায় ইদ্রিস আলী (২৪) নামে এক আলোকচিত্র সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে সাতদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও, অপরাধীদের চিহ্নিত বা আটকের কোনো খবর নেই৷ প্রসঙ্গত, ইদ্রিস আলী হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের কাছ থেকে ছবি তোলায় তাঁকে আটক করা হয়৷
সর্বশেষ নিলয় নীল হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তভার গোয়েন্দা বিভাগকে দেয়া হয়েছে৷ যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘নিলয় হত্যাকাণ্ডও একই জঙ্গি গ্রুপ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাজ বলে মনে হচ্ছে৷ এ ব্যাপরে দু'জন সন্দেহভাজনকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি, তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷''
কিন্তু এতদিনেও ব্লগার হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা যায়নি কেন? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘এই উগ্রবাদীরা ছোট ছোট গ্রুপে অসংখ্য গ্রুপে বিভক্ত৷ তারা নানাভাবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয় থেকে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে৷ তাই তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে৷ তবুও আমরা চেষ্টা করছি৷''
এর জবাবে ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘‘পুলিশ চাইলেই পারে৷ আমরা দেখেছি কোনো কোনো ঘটনায় পুলিশ অপরাধীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক করে ফেলে৷ শুধু ব্লগার হত্যার ঘটনায় ব্যতিক্রম৷ দেখেশুনে মনে হচ্ছে সরকার ব্লগার হত্যাকারীদের কোনো এক অদৃশ্য কারণে ঘাটাতে চায় না৷''
সর্বশেষ নিহত ব্লগার নিলয়ের বাবা তারাপদ চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই৷ সরকার চাইলে, পুলিশ চাইলে অপরাধীদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব৷''
অন্যদিকে রবিবার পুলিশের আইজি এ কে এম শহিদুল হক পুলিশ সদর দপ্তরে আবারো ব্লগার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলেও, তাঁর কথায়, ‘‘ব্লগারদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনারা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না৷ লিখতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করবেন না৷''