গত দশকের শুরুর দিকে গ্রিসের দেউলিয়া হওয়ার দশা হয়েছিল৷ বিষয়টি নাড়া দেয় গোটা ইউরোজোনকে৷ একজন ব্যক্তি সেসময় কঠোর হস্তে গ্রিসকে লাইনে আনার উদ্যোগ নেন৷ তিনি আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷
বিজ্ঞাপন
আঙ্গেলা ম্যার্কেল টানা ১৬ বছর জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন৷ এই সময়ে শুধু জার্মানি নয়, গোটা ইউরোপের নানা সমস্যার সমাধান করতে দেখা গেছে তাকে৷ শান্ত প্রকৃতির এই রাজনীতিবিদ অনেক সময় কঠোর থেকে কঠোরতর উদ্যোগ নিয়েছেন৷ কিন্তু কখনো অশান্ত বা অস্থির হতে দেখা যায়নি তাকে৷
ইউরোপে অভিন্ন মুদ্রা চলে এমন ইউরোজোনভুক্ত দেশগুলোর একটি গ্রিস৷ এই জোনে একটি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে অন্যদের ওপরও তার প্রভাব পড়ে৷ ফলে জোনের শক্তিশালী দেশ হিসেবে জার্মানির উপর বাড়তি দায় রয়েছে নানা কিছু সামলানোর৷ ম্যার্কেল সেই কাজটাই করেছিলেন কঠোরভাবে৷
তার কঠোরতা গ্রিকদের মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে গত দশকে যতবার তিনি দেশটি সফরে গেছেন ততবারই সেখানে তার বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ, বিক্ষোভ হয়েছে৷ একপর্যায়ে দেশটির সরকার ম্যার্কেলের সফরের সময় সেখানে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ নিষিদ্ধও করেছিল৷ আর তিনি যখন সেখানে থাকতেন, সেখানকার রাস্তাঘাটে হাজার হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হতো৷
শুধু সাধারণ প্রতিবাদকারীরাই নয়, দেশটির সংবাদমাধ্যমও ম্যার্কেলের উপর বেশ চটেছিল৷ তাকে তুলনা করা হতো নাৎসি শাসক অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে৷ এমনকি হিটলারের গোঁফ ম্যার্কেলের নাকের নিচে বসিয়ে পোস্টারও বানানো হয়েছিল গ্রিসে৷
কোন মেগা প্রকল্পে কত বিদেশি ঋণ
বিদেশি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের সরকার কয়েকটি মেগা প্রকল্প শেষ করেছে৷ আরও কিছু সমাপ্তির পথে৷ কয়েকটি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে৷ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে সিপিডি৷
ছবি: Salim/Xinhua News Agency/picture alliance
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
রাশিয়া ১,১৩৮ কোটি ডলার দিচ্ছে ঋণ দিচ্ছে৷ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে প্রকল্পটির ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷ এই ঋণের সুদের হার হচ্ছে, লাইবর রেট (একসময় বৈশ্বিক সুদহার নির্ধারণের অন্যতম মাপকাঠি ছিল লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফারড রেট বা লাইবর রেট) এবং সঙ্গে আরও ১.৭৫ শতাংশ৷ ইতিমধ্যে ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Abdul Goni/AFP/Getty Images
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ
এই প্রকল্পে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন৷ এই ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর৷ চলতি অর্থবছর থেকে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে৷
ছবি: Shamsul Haque Ripon
ঢাকা আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
প্রকল্পটিতে ১১২ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন৷ সুদহার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর৷ ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৬ সালে৷
ছবি: Rehman Asad/NurPhoto/picture alliance
পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র
এই প্রকল্পে ১৪০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক৷ এই ঋণের সুদহার লাইবরের সঙ্গে ২.৯৮ শতাংশ৷ ৪ বছর গ্রেসসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷ বর্তমানে এই ঋণের বিপরীতে প্রতিবছর ২৫ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে৷ ২০২৬-২৭ অর্থবছর নাগাদ তা ৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে৷
ছবি: Salim/Xinhua News Agency/picture alliance
মেট্রোরেল
এই প্রকল্পের জন্য জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে৷ ইতিমধ্যে দুই কিস্তিতে প্রায় ৬৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে৷ ৩০ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কর্ণফুলী টানেল
এই প্রকল্পে ৬,০৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন৷ সুদসহ এটি ফেরত দিতে হবে৷ চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে৷
ছবি: Salim/Xinhua/picture alliance
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৭ সালে এডিবির সঙ্গে ১৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল৷ ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালে৷
ছবি: Ehsan Kutubi
ভারতীয় ঋণগুচ্ছ
তিনটি লাইনস অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত ৭৩৬ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১৬৫ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে৷ এসব ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ ভারতীয় ঋণ পরিশোধের সময় পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছর৷ তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে ১৫টি প্রকল্প শেষ হয়েছে৷ চলমান আছে আটটি প্রকল্প৷
ছবি: Al-emrun Garjon/AP/picture alliance
ঋণ নিয়ে বিদেশি ঋণ শোধ
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গত ৪ এপ্রিল ঢাকায় ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন৷ এইসময় তিনি বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Patrick T. Fallon/AFP/Getty Images
দ্বিপক্ষীয় ও দাতা সংস্থার ঋণের পার্থক্য
চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে৷ আর বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং জাপানের মতো দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে সাধারণত ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে শোধ করার সুযোগ থাকে৷
ছবি: La Nacion/ZUMA/picture alliance
10 ছবি1 | 10
এসবের মধ্যেও অবশ্য ম্যার্কেল তার মিশনে অটল ছিলেন৷ ২০০৯ সালে গ্রিক সরকার যখন হঠাৎ করে ভয়াবহ রকম বাজেট ঘাটতির কথা জানান দেয় তখন থেকেই দেশটিকে উদ্ধারে মনোযোগী হয় জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ এবং দাতাগোষ্ঠী৷ নানা ধাপে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ এবং সেই প্রক্রিয়ায় জার্মানি ছিল সর্বোচ্চ একক ঋণদাতা৷ এমনকি ঋণের জামিনদারও হয়েছিল জার্মানি৷
গ্রিসের অর্থনীতিকে বাঁচাতে জার্মানির এই অগ্রণী ভূমিকার পেছনে মুখ্য চরিত্র ছিলেন ম্যার্কেল৷ কিন্তু ঋণ দেয়ার সঙ্গে অত্যন্ত কঠোর সব উদ্যোগ নিতেও একরকম বাধ্য করা হয়েছিল গ্রিসকে৷ এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সরকারের খরচ কমানো এবং কর বাড়ানোর মতো নানা অপ্রিয় বিষয়৷ বিশেষ করে সরকারি কর্মীদের বোনাস বাতিল, বাৎসরিক ছুটিসহ নানা সুযোগসুবিধা কমানো, বেতন বৃদ্ধি তিন বছরের জন্য স্থগিত, অবসর ভাতা উল্লেখযোগ্য হারে কমানো, অবসরের বয়স বাড়ানো, জ্বালানি, মদ আর তামাকের কর বাড়ানো, ভ্যাট বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিতে হয়েছিল ইউরোপের দেশটিকে৷
মিতব্যয়িতার এসব উদ্যোগ অনেক গ্রিকেরই পছন্দ হয়নি৷ সেসময় তাদের ‘অলস' হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছিল নানা তরফ থেকে৷ বিদেশি ঋণদাতাদের চাপিয়ে দেয়া নানা কৃচ্ছসাধনের উদ্যোগের প্রতিবাদে গ্রিসের নানা শহরে বিক্ষোভও হয়েছে৷ বারবার পরিবর্তন ঘটেছে সরকারে৷ একা ম্যার্কেলই আটবার গ্রিসের সরকার প্রধান বদল হতে দেখেছেন৷
এক দশকের চেষ্টার পর অবশ্য গ্রিসের অর্থনৈতিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে৷ দেশটির দেউলিয়া হওয়ার শঙ্কা এখন আর একদমই নেই৷ বরং ইউরোপের অন্যতম অগ্রসমান অর্থনীতির দেশ এখন গ্রিস৷
চ্যান্সেলর ম্যার্কেল শেষবার গ্রিস সফরে গিয়েছিলেন ২০২১ সালে, জার্মানির ক্ষমতা ছাড়ার আগে৷ এথেন্সে তখন তাকে হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানান গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিস৷ ম্যার্কেল সেসময় অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে দেশটি তাকে কখনো কখনো স্বাগত জানায়নি৷ তবে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন গ্রিসের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোয়৷ নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় সাফল্য ম্যার্কেলের৷ ইউরোপ তার শূণ্যতা এখনো অনুভব করে৷