1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যেভাবে ভারতে ফিরলেন বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া খাইরুল

বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ আসাম
৯ জুন ২০২৫

কীভাবে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল, কীভাবেই বা ভারতে ফিরলেন তা ডিডাব্লিউকে বলেছেন মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম।

বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মোহাম্মদ খাইরুলকে
আবার কাজে ফিরেছেন খাইরুলছবি: privat

ভারতের আসাম রাজ্যে চলছে বিদেশি ধরপাকড় অভিযান। ২৩ মে রাজ্যের পুলিশ মরিগাঁও, বরপেটা, ধুবরি এলাকা থেকে ১৪ জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে আটক করে। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় ভারতের সব থেকে বড় ডিটেনশন ক্যাম্প বা বিদেশি আটক শিবিরে। তিনদিন পর রাতের অন্ধকারে ১৪ জনকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে। সেখানে আরো তিন দিন কাটিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা আসামে ফেরেন। ডিডাব্লিউর কাছে এমনটিই দাবি করেছেন সদ্য নিজের বাড়িতে ফেরা মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম। 

আসামের মরিগাঁও জেলার এই প্রাক্তন শিক্ষক বাড়ি ফেরার পর কিছুদিন কথা বলতে চাননি। অবশেষে ঘটনার কথা তিনি জানালেন ডিডাব্লিউকে। খাইরুল বলেন, "মনে হচ্ছে পুনর্জন্ম পেয়েছি। দুই সন্তান এবং স্ত্রীকে রেখে গেছিলাম। একসময় মনে হয়েছিল আর তাদের দেখতে পাবো না।"

২৩ মে মরিগাঁও জেলার একদল পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় মিকিরভেটা থানায়। সেখানে তার নথি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে কিছু আধিকারিক তার নাগরিকত্ব, মামলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করেন এবং রাতে পুলিশের গাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালপাড়া জেলায়। 

খাইরুলের দাবি, ''বিকেল চারটে নাগাদ পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়। একজন আধিকারিক বলেন, আপাতত মাটিয়া ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে। হাত বেঁধে কড়া পাহারায় সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।'' খাইরুল আরো বলেন,, "ভোর চারটে নাগাদ সেখানে গিয়ে পৌঁছাই আমরা। আমার সঙ্গে মরিগাঁও জেলার আরো আটজন মানুষ ছিলেন। তারা সবাই পুরুষ। যেখানে আমাদের রাখা হয়েছিল, আমার মতো আরো ৩১ জন লোক ছিলেন। আমরা সবাই নাকি বিদেশি, পুলিশের মুখে এমনটাই শুনেছিলাম। আমি আগেও দু'বছর ডিটেনশন ক্যাম্পে থেকেছি, তবে সেটা অন্য জায়গায়।" 

এনআরসির নামে বাঙালি বিদ্বেষ?

16:37

This browser does not support the video element.

২৬ মে বিকেলে খাইরুল-সহ ১৪ জনকে গাড়িতে উঠতে বলে পুলিশ এবং তখন খাইরুলের সন্দেহ হয়, তাদের সঙ্গে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। খাইরুল ডিডাব্লিউকে বলেন, তখন গাড়িতে উঠতে চাননি তিনি এবং এ কারণে তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। তিনি বলেন, "আমার হাত বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। একেবারে পশুর মতো ব্যবহার করা হয়েছিল তখন। এক সময় বুঝতে পেরেছিলাম, আর বাধা দিলে হয়তো মেরেই ফেলবে। তাই শেষমেষ হাল ছেড়ে দিই এবং তাদের কথা মতোই গাড়িতে উঠি।"

তারপর গোয়ালপাড়ার মাটিয়া থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে মানকাচর জেলার ঠাকুরানবাড়ি এলাকায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দাবি খাইরুলের। ২৬ মে বিকেল চারটে নাগাদ তাদের নিয়ে রওনা দেয় পুলিশ। রাত ন'টা নাগাদ সেখানে গিয়ে পৌঁছায় তারা। সেখানে তাদের বসিয়ে রাখা হয় এবং রাত তিনটে নাগাদ বিএসএফের কিছু গাড়ি আসে। ১৪ জনকে একে একে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয় এবং ভোর চারটে নাগাদ সীমান্তের গেট খুলে তাদের ওপারে চলে যেতে বলে বিএসএফ। 

খাইরুলের কথায়, "একটা ভয়ের পরিবেশ ছিল সেখানে। আমরা মাত্র ১৪ জন আর বিএসএফের বন্দুকধারী জওয়ান অনেক বেশি। সেখানে প্রতিবাদ করলে হয়তো প্রাণে বাঁচবো না, এটা ভেবে চুপ থাকি। ওরা আমাদের যেভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে বলে, আমরা যেতে থাকি। অনেকটা ভেতর চলে যাওয়ার পর তারা গেট বন্ধ করে দেয়। তবে আমরা এক অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকি। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ছুটে আসে বাংলাদেশের সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ানরা। প্রথমে তারা আমাদের উপর রেগে যায় এবং চিৎকার করে। আমরা তাদের কাছে হাতজোড় করি, তাদের জানাই আমরা জোর করে ঢুকে আসিনি। আমাদের এদিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।"

বিজিবি-র (বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী)' এক আধিকারিক এগিয়ে এসে তাদের কথা শোনেন এবং আপাতত তাদের আন্তর্জাতিক সীমান্তের জিরো লাইন বা নো-ম্যানস ল্যান্ডে অপেক্ষা করতে বলেন। সকালে আরো কিছু আধিকারিক আসেন এবং প্রত্যেকেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। খাইরুল জানান, বাংলাদেশের বরাইবারি এলাকার মানুষ তাদের বিস্কুট-সহ অন্যান্য খাবার দিতে থাকেন। যে এলাকায় তাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল, সেটা ধানক্ষেতের মতো এবং সেখানে বৃষ্টির জমাজল ছিল। তারা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকেন। 

দুপুরে বিজিবি-র এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক এসে তাদের জানান, তারা বারবার ভারতের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং চিঠিও পাঠিয়েছেন, তবে বিএসএফ তাদের চিঠি গ্রহণ করছে না। খাইরুল ডিডাব্লিউকে বলেন, "বিজিবি-র ওই আধিকারিক আমাদের বলেন, আমরা বাংলায় প্রশ্ন করবো, আপনারা অসমীয়ায় উত্তর দেবেন। হয়তো এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চাইছিলেন, আমরা আসামের মানুষ।"

ওই দিন সন্ধ্যায় প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বিজিবি-র একটি ছাউনিতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। বিজিবি তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও করে। ডাল, ভাত আর পনির তরকারি নিয়ে এসে এক আধিকারিক বলেছিলেন, তাদের কাছে এটুকুই আছে। খাইরুল বলেন, "তারা বারবার বলছিলেন, আমরা যেন কিছু মনে না করি, তাদের কাছে আপাতত এটুকুই খাবার আছে। এই সময়ও কেউ এমন কথা বলছে দেখে মনে কিছুটা শান্তি পাই আমরা।"

এরপর রাত একটা নাগাদ বিজিবির আধিকারিকেরা ফের সেখানে যান এবং খাইরুলসহ সবাইকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। গাড়িতে প্রায় তিন ঘন্টা যাওয়ার পর জামালপুর নামের একটি জায়গায় পৌঁছান খাইরুলরা। সেখানে একটি ঘরে আগে থেকেই ১৪ জনের জন্য আলাদা আলাদা বিছানা সাজানো ছিল। পুরুষ এবং নারীদের আলাদা আলাদা দিকে রাখা হয়। তাদের খাবার দেওয়া হয় এবং ফের এক আধিকারিক তাদের ডেকে পাঠান। তাদের গোটা বিষয় শুনে সেই আধিকারিক চলে যান। 

পুরোটা দিন ওই ক্যাম্পে থাকার পর সন্ধ্যায় আবার একটি গাড়িতে বসতে বলা হয়। খাইরুল বলেন, "বিজিবির ব্যবহার ভালো ছিল, তবে আমাদের মনে তো ভয় ছিলই। অবৈধ বিদেশি হিসেবে আরেকটা দেশে এসেছি, অন্তত জেল তো খাটতে হবে, এটা ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যায় গাড়িতে বসিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে, যেখান দিয়ে আমাদের দুদিন আগে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। গভীর রাতে বিজিবি আমাদের তুলে দেয় বিএসএফের হাতে। এরপর বিএসএফ আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ সবাইকে আলাদা আলাদা গাড়িতে বসিয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসে। অন্যদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জানি না, আমাকে পাঠানো হয় মরিগাঁও জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে কেউ বিশেষ কিছু বলেননি। শুধু কয়েক ঘন্টা পর আমাকে বলা হয় বাড়ি চলে যেতে।"

খাইরুল সরাসরি বাড়ি ফেরেননি। তিন দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন আত্মীয়দের বাড়ি। তার দাবি, তখনো মনে ভয় ছিল, বাড়ি ফিরলেই হয়তো পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, "যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, বারবার পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছি আমার অপরাধ কী? তারা কেউ কিছু বলেনি। আমাকে প্রচণ্ড মারধর করার পর হাত জোড় করে বলেছিলাম, একটু মানবিকতা দেখাতে। তাদের মধ্যে একজন বলেছিলেন, আমি চুপ থাকলেই আমার মঙ্গল। তাই দেশে ফেরার পর প্রথমে চুপ ছিলাম। আমরা দুর্বল, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, আমার চাকরি গেছে, এবার এই যন্ত্রণা ভোগ করে ফিরেছি। শুধুমাত্র দুই সন্তান আর স্ত্রীর জন্য এখনো বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা হারাইনি। না হলে এই অপমান সহ্য করা সহজ নয়।"

সুপ্রিম কোর্টে খাইরুলের মামলা চলছে। তার আইনজীবী অভিজিৎ রায় ডিডাব্লিউকে বলেন, ''যেভাবে খাইরুলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা বেআইনি। আমরা সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়টি উল্লেখ করবো। খাইরুল যে ভারতীয় তার একাধিক নথি আমাদের হাতে আছে।'' খাইরুল এবং তার আইনজীবীর বক্তব্য, ১৯৫৬ সালে মরিগাঁও জেলায় একটি চালকল চালু করেছিলেন খাইরুলের বাবা। তখন অবিভক্ত আসামের রাজধানী ছিল শিলং। শিলংয়ের এক সরকারি কার্যালয় তার বাবার চালকল খোলার অনুমতি দিয়েছিল এবং তাদের কাছে সেই কাগজ আছে বলেও দাবি করেন খাইরুল ও তার আইনজীবী। খাইরুল আরো বলেন, তার ঠাকুরদাদা একসময় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯২৭ সালে একটি বন্দুক রাখার লাইসেন্স পেয়েছিলেন তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে। এছাড়া ভারত স্বাধীন হওয়ার আগের নানা নথিও তাদের কাছে আছে। এই সব নথিই সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। 

আসামে দীর্ঘদিন ধরে এনআরসি এবং নাগরিকত্ব নিয়ে আন্দোলন করছেন কমল চক্রবর্তী। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ''যেভাবে নতুন করে ধরপাকর শুরু হয়েছে, তা আইনসম্মত নয়। আর রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না।'' 

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অবশ্য বলেছেন, ‘‘বিদেশি তাড়ানোর বিষয়ে ১৯৫০ সালের একটি আইন এখনো বাতিল হয়নি। এবার থেকে ওই আইনের মাধ্যমে সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হবে।’’ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ১৯৫০ সালের ওই আইনে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন বিদেশিদের সীমান্তের বাইরে পাঠানোর নির্দেশ জারি করার অধিকার জেলা শাসকের আছে। তাই এবার থেকে সেরকম কেউ ধরা পড়লে আর ফরেনার্স ট্রাইবুনালে যেতে হবে না। আসাম বিধানসভায় সোমবার এই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ