যেভাবে হলোকস্ট থেকে বেঁচে যাওয়াদের গল্প শুনছে নতুন প্রজন্ম
২২ এপ্রিল ২০১৯
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে হত্যা করা হয় ৬০ লাখেরও বেশি নিরপরাধ মানুষকে৷ সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়াদের জীবনের গল্প ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে জার্মান একটি সংগঠন৷
বিজ্ঞাপন
প্রতিদিনই অন্ধকার অতীতের কোনো-না-কোনো স্মৃতি উঁকি দেয় ৯৫ বছর বয়সি এরনা ডে ফ্রিস-এর মনে৷ রুটির টুকরো পড়ে থাকতে দেখলেই মনে পড়ে না খেয়ে থাকা দিনগুলোর কথা৷ সাদা বাকলের বার্চ গাছ মনে করিয়ে দেয় আউশভিৎ্স বির্কেনাউ বন্দী শিবিরের কথা৷ ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে৷
এরনার বাবা ছিলেন প্রটেস্ট্যান্ট আর মা ইহুদি৷ শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছেন৷ ১৯৪৩ সালে মা নির্বাসিত হন আউশভিৎসে৷ সাথে এরনাকেও নিয়ে যান তিনি৷ মায়ের শেষদিনগুলোর কথা এখনো তাঁর স্পষ্ট মনে আছে৷
নিজের ঘরের সোফায় বসে এরনা বিষন্ন চিত্তে হলোকস্টের ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি বলছিলেন৷ অবশ্য এর আগেও তিনি বহুবার সেসব কথা বলেছেন৷ উত্তর জার্মানিতে, যেখানে তিনি বসবাস করেন, সেখানকার একটি স্কুল আর কাছের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্মমতার সেসব কাহিনী শুনিয়েছেন৷ তিনি কোনোভাবেই ভুলতে পারেন না মায়ের সাথে শেষ দেখার কথাগুলো, ‘‘এরনা তোমাকে অবশ্যই লড়াই করতে হবে, অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে এবং তারা আমাদের সাথে যা করেছে, তা সবাইকে জানাতে হবে৷''
এরনা বলে চলেন, ‘‘সেই শেষ দেখাটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়৷ আমি নিশ্চিত জানতাম, তিনি কখনোই আউশভিৎস থেকে মুক্তি পাবেন না৷''
এরনা এখন আর চোখে তেমন একটা ভালো দেখেনা না, শুনতেও পান না খুব একটা৷ সাহায্যকারী ছাড়া চলাফেরাও করতে পারেন না৷ এর মাঝেও ২৯ বছরের ভানেসা আইজেনহার্ড্ট তাঁকে অতীতের কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন৷ তাতে খুশি এরনা৷ আইজেনহার্ড্ট একটি সংস্থার হয়ে কাজ করেন, যারা হলোকস্টের জীবিতদের সাথে দেখা করে তাদের গল্প সংরক্ষণ করে এবং সেগুলো তরুণদের শোনায়৷ কিছুদিন আগেই এক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফ্রিজের জীবন সংগ্রামের কথা শুনিয়েছেন তিনি৷ এরপর সবাইকে তাঁর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখতে বলেন৷
শুধু যে হলোকস্টের গল্পই শোনান তা নয়, এরনার ডাক্তার হবার স্বপ্ন, নার্স হিসেবে তাঁর চাকুরিজীবন, ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হওয়া সবই ছিল আইজেনহার্ড্টের নেয়া সাক্ষাৎবারে৷ এরনা তাকে ইসরায়েল যাওয়ার স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন, কেমন চলছে ৩ সন্তান আর ৬ নাতি নাতনি নিয়ে তাঁর এখনকার জীবন– সেইসব কথাও শুনিয়েছেন তিনি৷
আইজেনহার্ড্ট এবং তাঁর সংগঠনের সদস্যরা এভাবে জার্মানির স্কুলগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, শোনাচ্ছেন এরনার মতো হলোকস্ট থেকে বেঁচে ফেরাদের গল্প৷ গত কয়েক বছরে তাঁরা ইসরায়েল, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ৩০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন৷ তাঁদের কেউ এখনো বেঁচে আছেন, আবার অনেকে মারাও গেছেন৷
ইতিহাসে পিএইচডি করা আইজেনহার্ড্ট বলেন, স্কুলে ইতিহাসের ক্লাসগুলোতে ব্যক্তিজীবনের গল্প তেমন একটা বলা হয় না৷ তাঁর বদলে তাদের সামনে কিছু বিমূর্ত সংখ্যা আর চিত্র তুলে ধরা হয়৷ যেমন হলোকস্টে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছে৷ কিন্তু এর মাধ্যমে নির্যাতনের প্রকৃত পরিস্থিতিটি বোঝা কঠিন৷ এ কারণে নাৎসিরা এরনার মতো মানুষদের কতটা কষ্ট দিয়েছে, তা তিনি স্কুল শিক্ষার্থীদের বলতে চান৷ আইজেনহার্ড্ট বলেন, ‘‘এসব গল্পের মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে যে, বর্ণবাদ আর ইহুদিবিদ্বেষ চলতে দিলে তার ফলে কী ঘটে৷''
এরনার বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম আর অতীত স্মৃতির গল্পে আবেগান্বিত হচ্ছেন শিশুরাও৷ ১৪ বছর বয়সি এক শিক্ষার্থী আম্ব্রা রিজো বলল, ‘‘আমি তাঁর গল্প শুনে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম৷''
১৫ বছর বয়সি সানিয়া শুবার্থের কাছে সবচেয়ে খারাপ লেগেছে এরনার মায়ের সাথে শেষ দেখার মুহূর্তটি৷ কেননা এরনাকে তাঁর মা সেই সময় বলেননি যে, ‘‘আমি তোমাকে ভালবাসি, আমাদের আর কখনো দেখা হবে না৷'' তার বদলে তিনি মেয়েকে বেঁচে থাকার সাহস দিয়েছেন আর লড়াই চালিয়ে যেতে বলেছেন৷
স্কুল শিক্ষার্থীদের এইসব অনুভূতির চিঠি আইজেনহার্ড্ট এরনার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন৷ সেখানে একজন লিখেছে, ‘‘প্রিয় এরনা, আমি নিশ্চিত তুমি একজন মহৎ এবং সাহসী নারী৷ আমি এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে পারছি না, তোমাকে আমার অনেক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি৷‘
এরনার কাছে এখন এমন অসাধারণ সব চিঠিভর্তি একটি বাক্স রয়েছে৷ তিনি খুশি যে, শিশুরা মনযোগ দিয়ে তাঁর গল্প শুনেছে, কেননা, অনেক সময় এইসব বিষয় নিয়ে মানুষ আর আগ্রহই দেখায় না৷
যুদ্ধের পরের সময়টার কথা ভেবে এরনা অবশ্য বেশ খুশি৷ সন্তান আর নাতি-নাতনিদের নিয়ে সুখের জীবনই কাটিয়েছেন তিনি৷ আর ভানেসা আইজেনহার্ড্টরা তো আছেনই৷ তাঁরা তাঁর জীবনের গল্পকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে, যেন তা কখনোই হারিয়ে না যায়৷
মারিনা স্ট্রাউস/এফএস
হলোকস্টের স্মরণে জার্মানি যা করেছে, করছে
১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ইউরোপে৷ এরপর থেকে হলোকস্টের শিকার হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মরণে রাখতে এই গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা সংরক্ষণ করে আসছে জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
ডাখাউ
মিউনিখের কাছে ডাখাউ-এ প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল নাৎসিরা৷ আডল্ফ হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর গড়ে তোলা কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী বা এসএস-এর সদস্যরা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সেই ইহুদি নিধন শিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে বন্দি করতো৷ তারপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতো তাঁদের৷ পরবর্তীতে নাৎসিদের স্থাপন করা অন্যান্য ক্যাম্পগুলো ঐ ডাখাউ-এর আদলেই তৈরি করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাৎসিদের ব়্যালি গ্রাউন্ড
ন্যুরেমব্যার্গে নাৎসি আমলের সবচেয়ে বড় প্রচারণা ব়্যালিটি অনুষ্ঠিত হতো৷ প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা একটি ‘গ্রাউন্ডে’ নাৎসিদের বার্ষিক কংগ্রেস এবং এই ব়্যালি অনুষ্ঠিত হতো, যাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করতেন৷ ছবিতে অসমাপ্ত কংগ্রেস হলটি দেখতে পাচ্ছেন৷ এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর এবং ডকুমেন্টেশন সেন্টার৷
ছবি: picture-alliance/Daniel Karmann
হলোকস্টের মূল পরিকল্পনা
বার্লিনের ভানজে লেক এলাকার এই ‘ভানজে হাউস’-টিতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা হয়েছিল৷ নাৎসি সরকার ও এসএস বাহিনীর মোট ১৫ জন সদস্য ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি এই ভবনে মিলিত হয়ে ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন৷ অর্থাৎ জার্মান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সব ইহুদিদের তাড়ানো ও তাঁদের শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এখানেই৷ ১৯৯২ সাল থেকে ভবনটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আনে ফ্রাঙ্কের স্মৃতি বিজড়িত
আনে ফ্রাঙ্ককে এখন অনেকেই চেনেন৷ তাঁর ডাইরিও পড়েছেন অনেকে৷ আনে ফ্রাঙ্ক সহ প্রায় ৫০ হাজার ইহুদিকে ব্যার্গেন-বেলজেনের এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/Klaus Nowottnick
হিটলারকে মারার ব্যর্থ পরিকল্পনা
জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি অপশাসন প্রতিরোধে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ক্লাউস ফন স্টাউফেনব্যার্গ-এর নেতৃত্বে একটি দল হিটলারের ওপর বোমা হামলা চালায়৷ কিন্তু হত্যা পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হলে, সেই রাতেই বার্লিনের এই ‘বেন্ডলারব্লক’ ভবনে স্টাউফেনব্যার্গ ও তাঁর সঙ্গীদের গুলি করে হত্যা করা হয়৷ এই ভবনটি এখন ‘জার্মান রেসিস্টেন্স মেমোরিয়াল সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হত্যা স্মরণ
হেসে রাজ্যের হাডামারে একটি হাসপাতালের প্রায় ১৫ হাজার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করা হয়৷ এরকম ‘অক্ষমদের’ নাৎসি সরকার ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষণা করেছিল৷ তাই তাঁদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষাক্ত ওষুধ প্রবেশ করানোসহ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করা হয়৷ পুরো জার্মানিতে এভাবে প্রায় ৭০ হাজার প্রতিবন্ধীকে মেরে ফেলে নাৎসি বাহিনী৷ পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে হাডামারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনে স্মৃতিস্তম্ভ
হলোকস্টের স্মরণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৬০ বছর পর, বার্লিনের ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের কাছে ‘মেমোরিয়াল টু দ্য মার্ডার্ড জিউস অফ ইউরোপ’ নামের এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়৷ নিহতদের স্মরণে সেখানে কংক্রিটের ২,৭১১টি স্ল্যাব বসানো হয়েছে৷ ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, এমন বহু মানুষের নামও লেখা আছে একটি জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমকামী হত্যা স্মরণ
বার্লিনের ঐ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ‘টিয়ারগার্টেন’ নামক একটি উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে চার মিটার উঁচু এই স্মৃতিফলক৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নাৎসিদের হাতে নিহত সমকামীদের স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়৷ এই স্তম্ভের মধ্যে থাকা একটি পর্দায় চোখ রাখলে দুটি ছবি দেখা যায়৷ একটিতে চুমু খাচ্ছেন দু’জন পুরুষ, অন্যটিতে দুই নারী৷
ছবি: picture alliance/Markus C. Hurek
সিন্টি ও রোমা হত্যা স্মরণ
বার্লিনের সংসদ ভবনের ঠিক উল্টো দিকে ২০১২ সালে একটি পার্ক উদ্বোধন করা হয়৷ নাৎসি আমলে নিহত প্রায় পাঁচ লক্ষ সিন্টি ও রোমার স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্মতিস্মারক হিসেবে ‘শ্টলপারশ্টাইন’
নব্বইয়ের দশকে শিল্পী গুন্টার ডেমনিগ নাৎসি নির্যাতনের শিকাররা যে সব বাড়িতে বাস করতেন, সেগুলোর সামনে রাস্তার ওপর সোনালি পাতের ছবির মতো এই স্মৃতিস্মারক বসানো শুরু করেন৷ এতে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তাঁর নাম, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও মেরে ফেলার তারিখ লেখা আছে৷ ইউরোপের ১৮টি দেশে এরকম ৪৫ হাজারেরও বেশি ‘শ্টলপারশ্টাইন’ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিউনিখের ব্রাউন হাউস
নাৎসি আমল শেষের এত বছর পরও সে সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তৎপর জার্মানি৷ তাই তো ৩০ এপ্রিল, ২০১৫-তে আরও একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে জার্মানি৷ মিউনিখ শহরে হিটলারের অফিসের অদূরে যেখানে নাৎসিদের প্রধান কার্যালয় ছিল, সেই ব্রাউন হাউসে ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার ফর দ্য হিস্টরি অফ ন্যাশনাল সোশ্যালিজম’ নামের এই সেন্টারটির উদ্বোধন করা হবে৷