1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যেসব কারণে বিতর্কে নতুন পাঠক্রম

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৪ নভেম্বর ২০২৩

চলতি বছর কয়েকটি শ্রেণিতে নতুন পাঠক্রম কার্যকর হয়েছে। আগামী বছর অষ্টম এবং নবম শ্রেণিসহ আরো কয়েকটি শ্রেণিতে কার্যকর হবে। তাই এই পাঠক্রম নিয়ে আলোচনা-সমলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

স্কুলের একটি ক্লাসে বইয়ে মনযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থী
নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বেনছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

ঢাকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকরা এরই মধ্যে নতুন এই পাঠক্রম নিয়ে প্রদিবাদমুখর। কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এই সমলাচনার পিছনে আছে কোচিং সেন্টার। কারণ, এই পাঠক্রমে কোচিং সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা আর থাকবে না।

অন্যদিকে শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন,নতুন পাঠক্রম ভালো , কিন্তু এটা শুরুর জন্য যথেষ্চ প্রস্তুতি নেই। তাছাড়া এটা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা উচিত।

চলতি বছরে প্রথম শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এই পাঠক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর (২০২৪ সাল) চালু হবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালু হবে।

পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি

নতুন পাঠক্রমে এখনকার মতো আর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে না৷ শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুসারে এসএসসি পরীক্ষা হবে৷ একাদশ ও  দ্বাদশ শ্রেণিতে বোর্ডের অধীনে দুটি পবালিক পরীক্ষা হবে৷

শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বেন৷ একাদশ শ্রেণিতে মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য- এই তিন বিভাগে ভাগ হবে৷ শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো বিভাগ বেছে নিতে পারবেন৷

প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে৷ তবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রচলিত কোনো পরীক্ষাই হবে না৷ এরপর থেকে পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন থাকবে৷ দুটি মিলিয়ে ফলাফল নির্ধারণ করা হবে৷ শ্রেণি অনুযায়ী মূল্যায়ন শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ হবে ক্লাসে শিক্ষার সময়ে৷ বাকিটা পরীক্ষার মাধ্যমে৷

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিখনকালীন অংশের মূল্যায়ন হবে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, হাতে-কলমের কাজ ইত্যাদি বহুমুখী পদ্ধতি ব্যবহার করে।

প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনটি বই থাকবে। তবে কোনো পরীক্ষা হবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে আটটি বিষয় আছে। এর মধ্যে পাঁচটি বিষয় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান। বাকি তিনটি বিষয় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্পকলা। শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ।

৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন ১০টি বিষয় রয়েছে- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।  এগুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ আর ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।  আর নবম, দশম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় থাকবে, যার ৫০ শতাংশ হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন, বাকি ৫০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।

শহরাঞ্চলে বিরোধিতার পেছনে আছে কোচিং সেন্টার: মশিউজ্জামান

This browser does not support the audio element.

একাদশ ও দ্বাদশে গিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ। আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ।  একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির পর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পাবলিক পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে। সপ্তাহে ছুটি হবে দুইদিন৷

যত বিতর্ক

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্ত বোর্ড (এনসিটিবি)-র সদস্য (পাঠ্যক্রম) মশিউজ্জামান বলেন, ‘‘এই পদ্ধতিতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা গাইড বই আছে। তারা কীভাবে পড়াবেন, কী পাড়াবেন তার সব নির্দেশনা আছে সেখানে।  বছরের কোন মাসে কোন সপ্তাহে কী পড়াবেন তা বলে দেয়া আছে। এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিজেরাও শিখবে। তাদের সহায়ক হবেন শিক্ষকরা।  শিক্ষার্থীদের গ্রুপ করে তাদের কাজ দেয়া হবে। শিক্ষক গ্রুপের সঙ্গে কথা বলবেন। ১০ জনের গ্রুপে যারা দুর্বল হবে তাদের ওই গ্রুপে যারা সবল তারা আবার শেখাবেন।  এখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের মূল্যায়নও করবে।”

তিনি বলেন, ‘‘এটা হঠাৎ করে শুরু করা হয়নি। গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে এটা নিয়ে কাজ হয়েছে এবং এই কাজ অব্যাহত আছে। ১ ডিসেম্বর থেকে শিক্ষকদের  সাত দিনের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। এর আগে গত বছরও প্রশিক্ষণ হয়েছে। আমরা মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করেছি। অনলাইনে প্রশিক্ষণ মডিউল আছে।”

তার মতে, ‘‘আসলে এখন শহরাঞ্চলে যে বিরোধিতা হচ্ছে এর পিছনে আছে কোচিং সেন্টার। কারণ, নতুন এই পদ্ধতিতে কোচিং সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।”

চলতি বছরে প্রথম এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠক্রমের বইয়ে পড়ানো এবং মূল্যায়ন করা হয়েছে। ‘অ্যাক্টিভিটি-নির্ভর’ এই শিক্ষা পদ্ধতিতে মূল বইয়ের পাশাপাশি  শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক বই আছে। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আলমগীর হোসেন খান বলেন," শিক্ষকদের জন্য সহায়ক গাইড আছে। আমরা এক বছর তিনটি শ্রেণিতে নতুন পাঠক্রমে পড়ালাম। অভিজ্ঞতা ভালোই বলা চলে। শিক্ষার্র্থীরা আগ্রহ পাচ্ছে। পড়াশোনাটা এই পদ্ধতিতে একপাক্ষিক নয়। এখানো সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তবে অনেক শিক্ষক এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। তাদের আরো প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।”

তিনি আরো বলেন, ‘‘এটা অনেকটাই বাস্তবনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি। অভিভাবকরা মনে করছেন, এর ফলাফল কেমন হবে৷ আমরা এ বছরের মূল্যায়ন শেষ করছি। মূল্যায়ন শেষে রেজাল্ট দেবো। এই ব্যবস্থায়ও গ্রেডিং পদ্ধতি আছে। আগের পদ্ধতিতে যেমন সারাবছর পড়ে শূন্যও পাওয়ার আশঙ্কা ছিল, এই ব্যবস্থায় শূন্য পাওয়্রা সুযোগ নেই।”

আর বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির  সভাপতি মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘‘এই পদ্ধতি বেশ আলাদা। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা একটা অংশগ্রহণমূলক পাঠক্রম। তবে এটা আমাদের এখানে কতটা উপযোগী হবে তা বুঝতে আরো সময় লাগবে। এখানে অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের মান, অভিভাবক এবং গ্রাম ও শহরের বাস্তবতা গুরুত্বপূর্ণ।”

পরিবর্তনটা করতে হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে: মজিবুর রহমান লাবলু

This browser does not support the audio element.

নতুন  এই পাঠক্রম নিয়ে যে সমালোচনাগুলো আসছে সেগুলো হলো:

১. প্রস্তুতির অভাব ২. শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব ৩. অবকাঠামোর অভাব ৪. শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত এবং ৫. গ্রাম ও শহরেরর পার্থক্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান লাবলু মনে করেন, ‘‘একটি ভালো পদ্ধতিও প্রস্তুতির অভাবে সঠিকভাবে কাজ না-ও করতে পারে। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নিতে হবে। অবকাঠামো , শিক্ষকের মান, প্রস্তুতি- এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর পুরো পদ্ধতি এক সঙ্গে পরিবর্তন নিয়েও প্রশ্ন আছে।”

তার মতে, ‘‘এটা পুরোটা এক সঙ্গে না করে ধাপে ধাপে সময় নিয়ে বাস্তবায়ন করা যেতো। আমরা ছাত্র- শিক্ষকের অনুপাতও বিবেচনা করিনি। আর অভিভাবকদেরও বিষয়টি বুঝানোর প্রয়োজন ছিল।”

তিনি বলেন, ‘‘এটা সত্য যে, পাঠক্রম পরিবর্তনশীল। তবে সেই পরিবর্তনটা করতে হবে বাস্তবতার ভিত্তিতে। পরিবর্তনটির সঙ্গে সবাইকে খাপ খাওয়ানোর সুযোগ দিতে হবে। সেটা না করায় এখন এটার সমালোচনা হচ্ছে। ডিম ভাজা নিয়ে কথা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ডিম ভাজবে- এটা খারাপ কিছু না। তবে দেখতে হবে স্কুলে ডিম ভাজার অবকাঠামো আছে কিনা।”

কারিকুলাম উন্নয়ন ও পুনর্বিবেচনা বিষয়ক কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান বলেন, ‘‘যে কয়টি শ্রেণিতে আমরা এরই মধ্যে নতুন পাঠক্রম চালু করেছি, তাতে শিক্ষার্থীরা এটাকে খুবই ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। গ্রামের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়েছে। তবে শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। আমরা এটাই আশা করেছিলাম। কারণ, শিক্ষকদের যে দীর্ঘ দিনের অভ্যাস, সেখানে পরিবর্তন আনা সহজ নয়। তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা দেখেছি, গ্রামের স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা এটাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। শহরের শিক্ষকরা এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না। এর কারণ  শহরের তথাকথিত স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী বেশি এবং শিক্ষকরা কোচিং করান। এই ব্যবস্থায় প্রচলিত ধারার কোচিংয়ের কোনো উপযোগিতা থাকে না। আর অভিভাবকদের বিষয়টি ঠিকমতো জানানো যায়নি। ফলে তাদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।’’

তার কথা, ‘‘নতুন এই পাঠক্রম দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে করা হয়েছে। মোট ছয়টি গবেষণা করা হয়েছে। পুরো ডিজাইনটা তৈরির সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ৮৫০ জনের সঙ্গে কনসালটেশন করা হয়েছে। এই কাজের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ১০ জন শিক্ষক যুক্ত আছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা এর সঙ্গে কাজ করছেন।”

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে এক লাখ ১৯ হাজার স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনে চার লাখ তিন হাজার শিক্ষক দুই কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন৷ বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইজ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৮ হাজার ৮৭৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই লাখ ৩৭ হাজার শিক্ষক ৮৯ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন।

অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান বলেন, ‘‘এবার শিক্ষক প্রশিক্ষণের সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনলাইন, মাল্টিমিডিয়া, অফলাইন, মডিউল সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

আর মশিউজ্জামান বলেন, "ব্যানবেইজের হিসাবে বাংলাদেশে এখন ৪২ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক আছেন। তবে কিছু কথিত ভালো স্কুলে ৮০-৮২ জনের জন্য একজন শিক্ষক। এরকম স্কুল আছে এক হাজার। আর বাকি ৩২ হাজার স্কুলে এই সমস্যা নেই। তাহলে আমি  এক হাজারের জন্য ৩২ হাজারকে তো অবহেলা করতে পারবো না।’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ