করোনা চিকিৎসায় বাংলাদেশে বড় ঘাটতির কথা বলা হলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে রোগীদের ১০ হাজার সাধারণ বেড এবং ১৯৮ টি আইসিইউ বেড খালি আছে। আর ৩৫০টি ভেন্টিলেটর এখনো অব্যবহৃত৷
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মঙ্গলবার সংসদে বলেছেন, করোনা রোগীদের জন্য ৪০০ ভেন্টিলেটারের মাত্র ৫০টি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি সাড়ে তিনশ' ব্যবহার করাই হয়নি।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতান জানান, করোনা রোগীদের জন্য সারাদেশে নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সাধারণ বেড আছে ১৪ হাজার ৭৪৮টি এবং আইসিইউ বেড ৩৮১টি। ওই দিন পর্যন্ত সাধারণ বেডে ভর্তি ছিলেন ৪ হাজার ৮৭৩ জন। খালি ছিল নয় হাজার ৯২৭৫টি। আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন ১৮৩ জন এবং খালি ছিল ১৯৮টি।
ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী
কেন বেড, আইসিইউ খালি?
মোট রোগী এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ১৪-১৫ ভাগ করোনা রোগী এখন হাসপাতালে ভর্তি হন। ৮৫ ভাগ করোনা রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় থেকে। আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের ২৩ থেকে ২৫ ভাগ হাসপাতালেই যাননি। ৩০ জুন মোট আক্রান্ত হন তিন হাজার ৬৮২ জন। আর হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৪৭ জন। ১ জুলাই মোট আক্রান্ত তিন হাজার ৭৭৫ জন আর হাসপাতালে ভর্তি ৫৩৮ জন।
বিশ্লেষকদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে সাধারণ বেড ও আইসিউ খালি থাকার কথা বলা হলেও কোন হাসপাতালে খালি আছে তা রোগী বা তার স্বজনরা জানেন না। ফলে তাদের হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হয়। আর এই কারণেই তারা বাসায় চিকিৎসাকে এখন শ্রেয় মনে করছেন। অন্যদিকে বেড বা আইসিইউ খালি থাকলেও তা প্রকাশ করা হয় না। কারণ, ভিআইপিদের জন্য অঘোষিতভাবে কিছু রিজার্ভ রাখা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ‘‘আমি নিজেও অনেক রোগীর জন্য বেড বা আইসিইউ'র চেষ্টা করে পাইনি। কিন্তু এখন দেখছি বেড খালি পড়ে আছে। এটা শুনে আমি বিস্মিত হলেও অবিশ্বাস করছি না। কারণ. এখন মানুষ সচেতন হয়েছেন। ৮০-৮২ ভাগ রোগীই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সর্বোচ্চ ২০ ভাগের বেশি রোগী হাসপাতালে আর যান না। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। সমন্বয়হীনতার কারণে বেড বা আইসিইউ খালি থাকলেও মানুষ জানে না। ফলে সে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরছে।''
ডা. কামরুল হাসান খান
আর এই বেড বা আইসিইউর হিসাব কাগজে-কলমে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তার মতে, এখানে শুভঙ্করের ফাঁকির কয়েকটি বিষয় থাকতে পারে। প্রথমত, বিএসএমএমইউ এবং গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালসহ বেশ কিছু হাসপাতালে তো কয়েকদিন আগেও রোগীই ভর্তি নেয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, বেড থাকার পরও নানা উদ্দেশ্যে সাধারণ রোগীদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।তৃতীয়ত, বেড অনুপাতে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী আছে কিনা সেটা দেখা দরকার। তিনি বলেন, ‘‘কোভিড চিকিৎসার সুবিধা না থাকলে তো বেডের হিসাব দিয়ে লাভ নাই।”
চিকিৎসা পরিস্থিতি
আগের চেয়ে করোনা চিকিৎসা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন বিএমএ'র মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী। তবে তিনিও মনে করেন এখন সচেতনতার কারণে অধিকাংশ রোগী আর হাসপাতালে যান না। তারা বাসায় থেকেই চিকিৎসা করান। আর কোভিড হাসপাতালের বাইরেও এখন সরকারি ৫০ টি হাসপাতাল কোভিড-এর চিকিৎসা দিচ্ছে, ফলে কোভিড হাসপাতালে চাপ কমছে। আর যারা একটু স্বচ্ছল, তারা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি।
কিন্তু এত বেড খালি থাকার পরও রোগীদের তা জানতে না পারার বিষয়ে ডা. কামরুল হাসান খান বলেন , ‘‘প্রত্যেকদিন কেন্দ্রীয়ভাবে জানাতে হবে কোন হাসপতালে কত বেড, কত আইসিইউ খালি আছে। তাহলে রোগীদের হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হবে না। আর যে-কোনো হাসপাতালে গেলে সেখান থেকেই রোগীকে বলে দিতে পারবে কোন হাসপাতালে বেড খালি আছে, কোথায় যেতে হবে।”
সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন একদিনে সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ ৫৩ হাজার ২৭৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মারা গেছেন ৩৮ জন। এ নিয়ে বাংলাদেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো এক হাজার ৯২৬।
করোনা: গুজব ও বাস্তবতা
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া তথ্য, মিথ্যা সংবাদ৷ ডয়চে ভেলে চেষ্টা করছে বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে আপনাদের সঠিক তথ্য জানানোর৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xiao Yijiu
শিশুদের আশঙ্কা কি বেশি?
শিশুদের নিয়ে আলাদা করে কোনো আশঙ্কা নাই৷ যে কোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন৷ আক্রান্তদের পাঁচ জনের চারজনের ওপর এই ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের মতোই প্রভাব ফেলবে৷ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শিশু ও তরুণ বয়সিরা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে পারেন৷ মধ্যবয়সিরা এতে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত সেবা ও চিকিৎসায় তাদেরও সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
কী খেলে ঠেকানো যাবে করোনা?
কোনো কিছু খেয়েই করোনা ঠেকানো যাবে না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য সুষম খাবার এমনিতেই প্রয়োজন৷ অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে৷ কেউ রসুন খাওয়ার কথা বলছেন, কেউ ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক দ্রব্যের কথা বলছেন৷ রসুনে নানা উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য ভালো৷ রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে তা ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক শরীরে গেলে তা করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
ছবি: AFP/C. De Souza
গরম বা ঠান্ডা পানি পান করা উচিত?
নিয়মিত পানি পান করলে শরীরের জন্য ভালো৷ কিন্তু ১৫ মিনিট পর পর গরম পানি পান করলে ভাইরাস মারা যাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷ মুখে বা শরীরে একবার ভাইরাস প্রবেশ করলে কোনো খাবার বা পানীয় দিয়েই তা আটকানো যাবে না৷ শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো ওষুধে কাজ হবে?
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য কার্যকর, ভাইরাসের জন্য নয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুস্থ শরীরে ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে৷ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখনো নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি৷ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিগগিরই হয়তো আসবে সুখবর৷
ছবি: imago/Science Photo Library
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে?
এ বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ পরীক্ষাগারে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়৷ কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রা কোনো দেশেই থাকে না৷ অনেকে মনে করছেন গরম পানি দিয়ে স্নান করলে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সবসময় জরুরি৷ কিন্তু প্রচণ্ড গরম পানি দিয়ে স্নান করলেই তা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Lipinski
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কি করোনা ভাইরাস শনাক্ত সম্ভব?
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরে তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব, ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করা সম্ভব না৷ সেক্ষেত্রে কারো শরীরে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি বোঝা যাবে না৷ সাধারণত ভাইরাস শরীরে ঢোকার ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যেই তা টের পাওয়া যায়৷ তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিনের পরও ভাইরাস শরীরে কর্মক্ষম থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Mikheyev
টাকার মাধ্যমে কী করোনা ছড়ায়?
শরীরের বাইরে করোনা ভাইরাস কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে৷ ফলে আমদানি করা কোনো পণ্য বা চিঠির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷ ময়লা টাকা থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷ ফলে টাকা লেনদেনের পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত৷ যত বেশি সম্ভব হাত-মুখ-নাক-কানে হাত নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ছবি: DW
মশা বা অন্য পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে?
সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল এক ধরনের বেড়াল থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ালো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে অন্য কোনো মাধ্যম হয়ে মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়েছে৷ তবে মশা বা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে এটি আপনার মধ্যে ছড়াবে না৷ সতর্কতা হিসেবে মাছ-মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে রান্না করতে হবে৷ অর্ধেক সিদ্ধ মাছ-মাংস বা পোচ করা ডিম থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Rose
কিভাবে থাকবো নিরাপদ?
সবচেয়ে জরুরি হাত পরিষ্কার রাখা৷ সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ২০ সেকেন্ড পরিষ্কার করতে হবে৷ যদি সাবান না থাকে, ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷ হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলুন, হাত ধুয়ে নিন৷ অথবা হাতের কনুইয়ে মুখ ঢাকুন৷ হাতের তালুতে হাঁচি-কাশি দিলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে আক্রান্ত হতে পারেন অন্য়রা৷ হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানো ও কোলাকুলি থেকেও বিরত থাকুন৷
ছবি: AFP/N. Almeida
আমি কী মারা যাবো?
করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন, এমন আশঙ্কা একেবারেই কম৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন৷ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন৷ অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন৷ সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে জমিয়ে রাখবেন না৷ আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশেপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস৷ ফলে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন৷