ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেনান্ট জেনারেল জেএফআর জেকব৷ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা কুর্নিশ দাবি করে৷ আত্মসমর্পণ চুক্তিতে সই করতে গড়িমসি করায় জেনারেল নিয়াজির মাথায় বন্দুক ধরেছিলেন জেকব৷ লিখছেন শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়৷
বিজ্ঞাপন
পুরো নাম জেকব ফার্জ রাফায়েল, সংক্ষেপে জেএফআর জেকব৷ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যিনি পরিচিত ছিলেন লেফটেনান্ট জেনারেল জেকব নামে৷ বংশপরিচয়ের সূত্রে ইরাকি ইহুদি, কিন্তু তাঁর পরিবার ইরাকের বাগদাদ থেকে চলে এসেছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায়৷ এই শহরেই ১৯২৪ সালে তাঁর জন্ম৷ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর লড়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে৷ তার পর স্বাধীন ভারতের সেনানী হিসেবে ১৯৬৫ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে৷ কিন্তু লেফটেনান্ট জেনারেল জেকবের নাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা আছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকার জন্য৷
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু দুর্লভ ছবি
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-র সংগ্রহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে৷
ছবি: AP
উত্তাল মার্চ
১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ ঢাকার রাস্তায় স্বাধীনতার দাবিতে হারপুন হাতে বিক্ষোভ মিছিল৷
ছবি: AP
যশোরে মুক্তিবাহিনী
২ এপ্রিল ১৯৭১৷ যশোরে মার্চ করছে মুক্তিবাহিনী৷
ছবি: AP
ত্রিপুরায় বাংলাদেশি শরণার্থী
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল৷ প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে ভারতের ত্রিপুরার মোহনপুরের একটি স্কুল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশিরা৷
ছবি: AP
ভারত সীমান্তের কাছে বাংলাদেশিদের অবস্থান
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল৷ ভারত সীমান্তের ৩০ মাইলের মধ্যে কুষ্টিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকেই অবস্থান করছিল৷
ছবি: AP
বেনাপোলের কাছে শরণার্থী শিবির
১৪ এপ্রিল ১৯৭১, যশোরের বেনাপোলের কাছে ভারত সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: AP
আহত মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর বোমা হামলায় আহত একজন মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যাচ্ছেন বেসামরিক মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা৷
ছবি: AP
মুক্তিবাহিনী
১৯৭১ সালের ৩ রা আগস্ট৷ ঢাকার কাছে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হেমায়েতউদ্দীন একটি গোপন ক্যাম্প থেকে মেশিনগান তাক করে রেখেছেন৷
ছবি: AP
১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থীর নেতৃত্বে প্লাটুন
১৩ নভেম্বর ১৯৭১৷ ফরিদপুরে রাইফেল হাতে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ৷ ৭০ সদস্যের একটি প্লাটুন গড়া হয়েছিল সেখানে৷ সেই প্লাটুন দক্ষিণাঞ্চলে সামরিক ও চিকিৎসা দ্রব্য সরবরাহ করত৷ একদম বামে থাকা ১৯ বছর বয়সি তরুণটি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ ৭০ জনের প্লাটুনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি৷
ছবি: AP
মুক্তিবাহিনীর পারুলিয়া দখল
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর৷ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পারুলিয়া গ্রাম দখল করে নেয় মুক্তিবাহিনী৷
ছবি: AP
আখাউড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী
২৯ নভেম্বর, ১৯৭১৷ আখাউড়ায় অস্ত্র পাহাড়া দিচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা৷ তাদের দাবি ছিল, ভারতীয় সৈন্যদের কাছ থেকে এসব অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে৷
ছবি: AP
ভারতীয় সেনাদের হামলা
২ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ যশোরে পাকিস্তানি সেনাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে ভারত ৷ এক পাকিস্তানি সেনাসদস্য রাইফেল নিয়ে অন্যত্র যাচ্ছে৷ অন্য সেনারা তখন অস্ত্র তাক করে পরিখার মধ্যে রয়েছে৷
ছবি: AP
ভারতীয় সেনা
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর৷ ভারতীয় সীমান্তের কাছে ডোঙ্গারপাড়ায় খোলা মাঠে মেশিনগান তাক করে রেখেছেন এক ভারতীয় সেনা৷
ছবি: AP
ডিসেম্বরেও ঢাকায় পাকিস্তানি সার্জেন্ট
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ রাজধানী ঢাকার অদূরে একটি এলাকায় একজন পাকিস্তানি সার্জেন্ট দুই সেনাকে নির্দেশনা দিচ্ছে৷
ছবি: AP
যুদ্ধবিরতি
রবিবার ১২ ডিসেম্বর. ১৯৭১৷ ঢাকা বিমানবন্দরে অপেক্ষায় আছেন বিদেশিরা৷ একটি ব্রিটিশ বিমান অবতরণ করেছে৷ ৬ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির সময় বিদেশিদের নিয়ে যাওয়ার জন্যই ঐ বিমানটি পাঠানো হয়েছিল৷
ছবি: AP
ভারতীয় ট্যাংক
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর৷ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যাংক বগুড়ার দিকে রওনা হয়েছে৷
ছবি: AP
চার রাজাকারকে হত্যার পর মুক্তিবাহিনীর প্রতিক্রিয়া
হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা চার রাজাকারকে হত্যার পর আল্লাহ’র উদ্দেশে শুকরিয়া জানাচ্ছেন মুক্তিসেনারা৷
ছবি: AP
16 ছবি1 | 16
তখন তিনি মেজর জেনারেল, ভারতীয় সেনার পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরের সেনাপ্রধানের পদে৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে এগিয়ে গেছে ভারতীয় সেনা৷ সেই বাহিনীর নেতৃত্বে জেনারেল জেকব৷ তারপর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন৷ বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা পেয়ে গেল স্থিরচিত্রটি৷ নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান এএকে নিয়াজি৷ ভারতীয় বাহিনীর লেফটেনান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা-র সামনে বসে সই করছেন অস্ত্র সমর্পণ এবং পরাজয় স্বীকারের চুক্তিপত্রে৷ ওঁদের দু'জনের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান, বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল দেওয়ান, স্থলসেনার লেফটেনান্ট জেনারেল সগত সিং এবং মেজর জেনারেল জেকব৷
শুধু যে ভারতীয় সেনার পূর্বাঞ্চলীয় শাখার প্রধান হিসেবেই জেনারেল জেকব ঐ ঐতিহাসিক মুহূর্তে হাজির ছিলেন, তা নয়৷ এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে দখলদার পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেও নয়, জেনারেল জেকবের আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের ওই আত্মসমর্পণে৷ যদিও পুরোটাই জনশ্রুতি, এবং যে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যেমন কিছু কল্পগাথাও জন্ম নেয়, হতেই পারে এটাও তেমনই এক উপকথা৷ শোনা যায়, যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরেও আত্মসমর্পণ করতে রাজি ছিলেন না পাক সেনানায়ক জেনারেল নিয়াজি৷ তাঁর আত্মসম্মানে লাগছিল৷ তখন এই জেনারেল জেকব ফাঁকা ঘরে নিয়াজির মুখোমুখি হন৷ কোমরের খাপ থেকে নিজের বন্দুক বের করে নিয়াজির মাথায় ঠেকিয়ে বলেন, অকারণ কথা নষ্ট হচ্ছে৷ হয় আপনি আত্মসমর্পণের চুক্তিতে সই করুন অথবা একটি গুলিতে এই ঝামেলা এখানেই শেষ করে দেব! এর পর নিয়াজি নাকি আর কথা বাড়াননি, চুপচাপ সই করে দিয়েছিলেন৷
‘তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না’
১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবস৷ ন’মাসের মুক্তিযুদ্ধ আর চরম আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে৷ জাতি তাই আজ স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য আন্দোলনরত ছাত্রদের বুকে গুলি চালানো হয়৷ রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে এদিন শহিদ হন৷ সেই তার সঙ্গে সঙ্গেই রচিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি৷
ছবি: Archiv Rowshan Jahan Shathi
কাল রাত
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী৷ তার জবাব দেয়া হয় স্বাধীনতা ঘোষণা আর মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে৷ যুদ্ধকালীন নয় মাসের চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী৷
ছবি: DW/M. Mamun
ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশ
১৬ই ডিসেম্বর অনেক ত্যাগ আর তিতিক্ষার বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্র, পায় নতুন একটা মানচিত্র৷ স্বাধীনতার জন্য জীবন দেন ৩০ লাখ মানুষ৷ দেশের বাতাসে তাই আজ ভেসে বেড়াচ্ছে সেই গান – ‘তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না’৷
ছবি: AP
রাষ্ট্রীয় ভাবে পালন
বরাবরের মতোই দিনটিকে পালন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে৷ তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে ৪৪তম বিজয় উৎসব শুরু হয়৷ আর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের স্মৃতির বেদীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন সরকার প্রধান, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতারা৷
ছবি: DW/M. Mamun
মানুষের ঢল
রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢল নামে সর্বস্তরের মানুষের৷ মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী সবাই সমবেত হন শ্রদ্ধার্ঘ্য হাতে৷
দেশের প্রতিটি শহরে নানা ভাবে বিজয় উদযাপন চলছে৷ শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সহ চলছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান৷
ছবি: AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
২০১১ সালে, কলকাতায় ভারতীয় সেনার পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর ফোর্ট উইলিয়ামে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের ৪০ বছর পূর্তির দিনটি মহা সমারোহে পালিত হয়েছিল৷ বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে আমন্ত্রিত ছিলেন সেই উদযাপনে৷ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন লেফটেনান্ট জেনারেল জেকব৷ তখন তিনি যথেষ্ট বৃদ্ধ৷ লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন৷ কিন্তু তাও নজরে পড়ার মতো ব্যাপার ছিল, সভার জায়গায় পৌঁছে তিনি উপস্থিত সমস্ত সেনাকর্মীর সঙ্গে কথা বললেন, কুশল জানতে চাইলেন৷ যে সৌজন্য এবং সামরিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ দ্বিতীয় কোনো সেনাকর্তা কিন্তু সেদিন দেখাননি৷ ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানটি দেখে রিপোর্ট করতে৷ লেফটেনান্ট জেনারেল জেকবকে দেখে প্রশ্নটা না করে থাকতে পারিনি, যে আপনি সত্যিই জেনারেল নিয়াজির মাথায় বন্দুক ধরেছিলেন?
নির্ভিক সেনাপতির রসবোধেরও পরিচয় পেয়েছিলাম সেদিন৷ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘সব বাজে কথা! একদম কান দিও না এ সব গালগল্পে৷'' তারপর রহস্য করার ঢঙে বলেছিলেন, ‘‘লড়াইয়ের ময়দানে ওরকম অপদস্থ হয়েও লোকটার লজ্জা হয়নি৷ বেঁকে বসেছিল, সই করবে না৷ তাই ভালো কথায় বোঝাতে হয়েছিল৷ ভালোভাবে বললে সবাই কথা শোনে৷ নিয়াজিও শুনেছিল৷'' বলেই হা হা করে হেসে উঠেছিলেন প্রবীণ এই সেনানায়ক৷
এই বছরের জানুয়ারিতে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন লেফটেনান্ট জেনারেল জেকব, ৯২ বছর বয়েসে৷