এক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে ইউরোপের এয়ারবাস থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কিনতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, দাবি বিমানের৷ এর ফলে খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে সমালোচনা থাকলেও বেশি সুফল দেখছেন কর্মকর্তারা৷
বিজ্ঞাপন
বিমানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এয়ারবাস থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কিনতে গত মে মাসে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে যৌথ চুক্তি হয়েছে৷ ২০৩০ সালের মধ্যে এসব উড়োজাহাজ কেনা হবে৷ এর মধ্যে আগামী বছরের জুলাই মাসে আসবে দুইটি৷
গত ৩ মে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ এয়ারবাসের ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেয়৷ বাংলাদেশ সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ গত ১১ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘এয়ারবাস কোম্পানির তৈরি ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ৷ ইউরোপীয় উড়োজাহাজ শিল্পে আস্থা রাখার জন্য আমি আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) ধন্যবাদ জানাই৷ ১০টি এয়ারবাস এ৩৫০ কেনার এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ৷''
সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ-এর এক নিরীক্ষায় দেখা যায়, ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক রুটে ২০ লাখ ৫৮ হাজার যাত্রী পরিবহণ করেছে বিমান৷ এসব ফ্লাইটে প্রায় সাত লাখ আসন খালি ছিল, যা বিমানের যাত্রী বহন সক্ষমতার প্রায় ২৪ শতাংশ৷ এরপরেও বহরে নতুন উড়োজাহাজের দরকার আছে কিনা- এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে৷
বর্তমানে বিমানের বহরে ২১টি উড়োজাহাজ আছে৷ এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭, ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, ছয়টি বোয়িং ৭৩৭ এবং পাঁচটি ড্যাশ ৮ মডেলের৷
দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট কমিউনিকে হয়েছে: শফিউল আজিম
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মে মাসে দুই দেশের মধ্যে (বাংলাদেশ-ফ্রান্স) জয়েন্ট কমিউনিকে হয়েছে এক দেশ আরেক দেশ থেকে মোট ১০টি উড়োজাহাজ কিনবে৷ উনারা আগামী জুলাই মাসে দুইটি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি৷ স্ট্যান্ডার্ড মেনেই দুই পক্ষ কাজ করছি৷ ২০৩০ সালের মধ্যে ১০টি উড়োজাহাজ কেনা হবে৷''
কেউ শতভাগ আসনে যাত্রী বহন করতে পারে না জানিয়ে শফিউল আজিম বলেন, ‘‘ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ৷ নতুন উড়োজাহাজের রুট কী হবে তা এগুলো কেনার প্রক্রিয়া শুরুর সময়ই নির্ধারণ করা হয়েছে৷ অনুমান করে নয়, সায়েন্টিফিক ওয়েতে এগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে৷''
রোয়িং থেকে উড়োজাহাজ না কিনে এয়ারবাস থেকে কেনার সিদ্ধান্ত হওয়ায় খরচ বেড়ে যাবে বলে অনেকেই মতামত দিয়েছেন৷ তবে বড় বড় এয়ালাইন্সের মতো একাধিক কোম্পানির উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত করতে চায় বিমান৷
শফিউল আজিম বলেন, ‘‘একটা জায়গা থেকে আমরা কিনছি, আরেকজন এলে তাকেও তো আমরা দেখবো৷ এখানে ডায়ভার্সিফাই করার একটি সুযোগ আছে৷ যাত্রীদেরও অনেক সময় চয়েস থাকে, এয়ারবাসের আছে কিনা, সেই এক্সপেরিয়েন্স নেওয়ার জন্য৷ বিমানের সক্ষমতাও বাড়বে৷ দুইটি বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে যদি কাজ করতে পারি, অনেক সময় একই কোম্পানি একসাথে দিতে পারছে না, সেক্ষেত্রে আরেকজন থাকছে৷ অপশনটা বেড়ে গেল৷ দুইটি কোম্পানি যখন আসবে, তখন প্রতিযোগিতামূলক হবে, আমরা বেস্ট প্রাইসে বেস্ট জিনিসটি নিতে পারবো৷’’
এয়ারবাসের উড়োজাহাজের জন্য পাইলট ও প্রকৌশলীদের নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হবে কিনা জানতে চাইলে শফিউল আজিম বলেন, ‘‘দুই কোম্পানির উড়োজাহাজে খুব সামান্যই পার্থক্য৷ অনেক এয়ারলাইন্স একসঙ্গে বোয়িং ও এয়ারবাস চালাচ্ছে৷ অ্যামেরিকার বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স কোম্পানি বোয়িং ও এয়ারবাস চালাচ্ছে৷ সুতরাং এখানে বড় কোনো পার্থক্য নেই৷ এটা অ্যাডজাস্ট করার সক্ষমতা আমাদের আছে, আমাদেরও একসময় এয়ারবাস ছিল৷ খুব মাইনর অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হবে৷''
এয়ারবাসের দাম বেশি হলেও অপারেশন কস্ট কম: এ টি এম নজরুল ইসলাম
বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘এককভাবে বোয়িংয়ের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতেই এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ ফলে বোয়িং থেকে এসব উড়োজাহাজ কিনলে কত টাকা সাশ্রয় হতো সেই হিসাব আমরা করতে যাইনি৷ সরকারও চায় বিমান যাতে এককভাবে কারো উপর নির্ভরশীল না থাকে৷''
আগামী ৫ বছরে বিমানের আরো এয়ারক্রাফটের প্রয়োজন হবে বলে মত দিয়েছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এ টি এম নজরুল ইসলাম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বিমানের অনেক রুটেই ফ্লাইট চালানোর সুযোগ রয়েছে৷ বড় বড় কোম্পানিতে দুই ধরনের এয়ারক্রাফট থাকে৷ এখন বিমান এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কিনলে তাদের বার্গেইনিং পাওয়ার বাড়বে৷ এয়ারবাসের দাম একটু বেশি হলেও অপারেশন কস্ট কম৷ তবে পাইলট, ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ লাগবে৷''
তিনি মনে করেন, দশটি বিমান যেহেতু ধাপে ধাপে সাত বছরে এসে পৌঁছাবে তাতে বিমান বিভিন্ন প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাবে৷ তার মতে শাহজালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বাড়তি সুবিধা যাবে, যা নিয়ে আগ্রহ আছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর৷ এসব বিষয়ও বিমানকে ভাবতে হবে৷
আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলোর আগ্রহে শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল
সেবার মান বাড়াতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৈরি হচ্ছে তৃতীয় টার্মিনাল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে টার্মিনালটি চালু হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থাগুলোর মনযোগে থাকা টার্মিনালটির কথা জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অবকাঠামো
সাতশ মিটার দীর্ঘ এবং দুইশ মিটার প্রস্থের তিনতলা এই টার্মিনালটির আয়তন হবে দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার৷ প্রকল্পের মোট নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে জাপান সরকার ৭৫ শতাংশ আর্থিক সহযোগিতা করছে৷ নির্মাণের বাকি ব্যয় বহন করবে বাংলাদেশ সরকার।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কাজের অগ্রগতি
টার্মিনালটিরর কাজ ৮৫ শতাংশ হয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে শূণ্য দশমিক নয় শতাংশ কাজ সমাপ্ত হচ্ছে বলেও জানান তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
যার যে কাজ
টার্মিনালের পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ জাপানকে দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ৷ ইমিগ্রেশন এবং নিরাপত্তার দায়িেত্ব থাকবে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক)৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কর্মীদের নিরাপত্তা
তৃতীয় টার্মিনাল এলাকায় প্রবেশ করলে নিরাপত্তা ও সতর্কতার ফলক বারবার চোখে পড়ে৷ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে অনেক কাজই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, তাই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে কাজে নামতে কর্মীদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বিরামহীন কাজ
তৃতীয় টার্মিনাল পরিদর্শনে এসে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘শুরুর পর থেকে একদিনের জন্যও এখানে কাজ থামেনি৷ এমনকি কোভিডের সময়ে সারা পৃথিবী যখন থেমে ছিল, তখনো এখানে নিরলসভাবে কাজ চলেছে৷ কর্মীদের নিরাপত্তার সকল ব্যবস্থা আমরা নিয়েছিলাম৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
যেসব সুবিধা থাকছে
আন্তর্জাতিক মানের এই বিমানবন্দরে থাকছে ১৫টি সেলফ চেক-ইন বহির্গমন কাউন্টার, মাল্টিলেভেল কার পার্কিং, ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেক-ইন আগমনী কাউন্টার, ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট, ২৪টি বোর্ডিং ব্রিজ, ভিভিআইপি স্পেসসহ নানা সুযোগ-সুবিধা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে সাধারণ গাড়ি চলাচলের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল এবং উড়াল সড়ক হিসেবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত থাকবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
যাত্রী বাড়বে
বর্তমানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীকে সেবা প্রদান করা যায়৷ তৃতীয় টার্মিনালটি হলে এই বিমানবন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ২ কোটি যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
টিকে থাকার লড়াই
৮ আগস্ট তৃতীয় টার্মিনালের কাজের অগ্রগতি দেখতে এসে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, বিমান বাংলাদেশ এখানে কতটুকু কাজ পাবে, তা নির্ভর করবে তাদের পারফর্মেন্সের উপর৷ তাদেরকে বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে৷ যাত্রীসেবার মান আন্তর্জাতিক মানের না হলে এখানে টিকে থাকা কঠিন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
টার্মিনালকে ঘিরে আগ্রহ
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বের সেরা সব এয়ারলাইন্স কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে৷ এর মধ্যে জার্মানির লুফটহানসা, ব্রিটিশ, জাপান, ইউনাইটেড, আমেরিকান, কান্তাস, এয়ার ফ্রান্স, অল নিপ্পন ভার্জিন আটলান্টিক এয়ারলাইন্স অন্যতম৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সফট ওপেনিং
আগামী ৭ অক্টোবর তৃতীয় টার্মিনালের ‘সফট ওপেনিং’ করবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ উদ্বোধনের পরেই বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল ও অন্যান্য যান্ত্রিক বিষয়াদির সমন্বয়, একটি বিমান পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনায় ট্রায়াল রান এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘এমন কাজে গর্ব হয়’
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে কথা হয় ফায়ার সার্ভিস পাইপ ফিটার মো. আকবর হোসেনের সাথে৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশের এত বড় একটা প্রকল্পের সাথে জড়িত থাকতে পেরে আমি গর্বিত৷ এখানে কাজের মান খুবই ভালো হচ্ছে৷ শুধু আমরা যারা ১১ হাজার শ্রমিক এখানে ২৪ ঘন্টা কাজ করছি তাদের জন্যবা নয়, এই বিমানবন্দর বাংলাদেশের জন্যও গর্বের জায়গা হয়ে থাকবে৷’’