এক সময় ইউরোপে জোটের রাজনীতির ভিত্তি ছিল সহযোগিতা, এখন আরো প্রাধান্য পাচ্ছে নিরাপত্তা, প্রতিযোগিতা ও যৌথ প্রতিরক্ষার বিষয়৷ এসবই ঠিক করছে কোন দিকে চালিত হবে ইউরোপে জোটের ভবিষ্যৎ৷
বিজ্ঞাপন
ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াশোনা করবার দিনগুলিতে শোনা একটা কথা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল৷ অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বের আন্তর্জাতিক গঠন কেমন হবে, তা বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন যে. এক বা দ্বিমুখী ক্ষমতার দিন শেষ৷ বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতার লড়াই হবে বহু মেরুর মধ্যে৷ ফলে, বিশ্ব রাজনীতিতে টিকে থাকার ও প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে হলে ভরসা জোট৷ কিন্তু কোন জোটে কে কীভাবে ও কতটুকু সম্পৃক্ত থাকবে, তারও রয়েছে আলাদা রাজনীতি৷
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কথাই ধরা যাক৷ এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জোটের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ২৭৷ সম্মিলিত চিন্তাধারা, মূল্যবোধ, খোলা সীমান্ত, বাণিজ্য ও অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এই জোট৷ এই মহাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইইউ বজায় রাখতে চেষ্টা করেছে তার নৈতিক অবস্থানকে৷
২৭টি রাষ্ট্রের আলাদা আলাদা পথে নয়, একসাথে বৃহত্তর ইউরোপিয়ান আদর্শ যে জোটের লক্ষ্য ছিল, সেই জোটের সামনে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ডানপন্থি রাজনীতির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ও ইউক্রেন যুদ্ধের আলোকে ন্যাটো-ইইউ সম্পর্কের পুনর্বিবেচনা৷ এই দু'টি বিষয়কে ঘিরে গত দু'বছরেরও বেশি সময় ধরে উত্তাল ইউরোপ৷ কারণ. এই দু'টি প্রশ্নেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বেশি সংঘাত, দ্বন্দ্ব৷
নেতৃত্বের সংকটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে গোটা বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ, অপরিহার্য ভূমিকা দিতে বিরাট অবদান রাখেন সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ ২০১৫-২০১৬ সালের শরণার্থী সংকটের সময় তার দৃঢ় অবস্থান ইউরোপের মানবিকতা, সীমান্ত নীতির দিক নির্ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করে৷
কিন্তু ম্যার্কেল-পরবর্তী যুগে এমন নেতৃত্ব নেই ইউরোপে৷ উরসুলা ফন ডেয়ার লায়েন আবার ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান পদে বসতে চলেছেন বলে ধারণা৷ হয়তো ইইউ-সংগঠনগুলির নেতৃত্ব এখনও ডানঘেঁষা ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি, বাম সোশালিস্ট, ডেমোক্র্যাট ও লিবেরালদের হাতেই থাকবে৷ কিন্তু তবুও চরম ডানপন্থার বিরুদ্ধে জোরগলায় ইউরোপিয়ান মানবিকতার আদর্শের পক্ষে কথা বলার মতো কেউ নেই৷
২০১৫ সালের পর থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতি জনগণের আস্থা বেড়েছে, কমেছে ইউরোপিয়ান আদর্শের প্রতি সংশয়৷ কিন্তু ২০২২ সালের রাশিয়ার ইউক্রেনের ওপর হামলা অনেক কিছুই বদলে দেয়৷
রিজার্ভ সৈন্য বাড়ানোর রূপরেখা প্রকাশ করেছে জার্মানি
02:45
ন্যাটো ও ইইউ: ইউরোপে জোটের দুই পিঠ
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলির ৯৬ শতাংশ বাসিন্দার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যাটো বা নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গ্যানাইজেশন৷ যদিও সরাসরিভাবে ন্যাটো ইউরোপের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়, কিন্তু ট্রান্স-আটলান্টিক সামরিক জোট হিসাবে তার ওপর এই দায় নিজে থেকেই চলে আসে৷
ঠান্ডা যুদ্ধের পর, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ওয়ারশ প্যাক্টের বিকল্প হিসাবে যে ন্যাটো উঠে আসে, সেই ন্যাটোর ভূমিকা বর্তমান বিশ্বে অনেকটাই ভিন্ন৷ একদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই মহাদেশকে সম্মিলিত আদর্শ, মূল্যবোধ ও বাণিজ্যের ভিত্তিতে কাছে টানতে চায়৷
অন্যদিকে, ন্যাটো তার সদস্যরাষ্ট্রদের কাছে টানে সামরিক ঝুঁকি ও প্রতিরক্ষার শর্তে৷ কিন্তু তবুও ইইউ ও ন্যাটো একে অপরের সবচেয়ে কাছাকাছি, মনে করছেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা৷ বাল্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রশ্নেও আরো বেশি করে একসাথে কাজ করছে ন্যাটো ও ইইউ৷ ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বাল্টিক দেশগুলি রাশিয়ার কাছ থেকে আরো বেশি ঝুঁকি অনুভব করছে৷ অন্যদিকে, ডনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট হলে রাশিয়াকে হামলা করতে ‘উৎসাহ' দেবেন, তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারেন কি ইউরোপ নেতৃত্ব?
কিন্তু যেহেতু ন্যাটোর সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, ফলে এ বছরের মার্কিন নির্বাচনের পর ন্যাটো ইউরোপে তার অবস্থানকে কীভাবে চালিত করতে চাইবে, সেটাও দেখার বিষয়৷ কারণ, হয়তো আবার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন ট্রাম্প৷
ইউরোপের সবচেয়ে বড় দু'টি জোটের মধ্যের সম্পর্কের মধ্যে বড় হয়ে উঠছে সহযোগিতার রাজনীতি নয়, বরং প্রতিযোগিতার দিকটি৷ কোন রাষ্ট্রের হাতে থাকবে ইইউ'র রাশ, কার নীতির সবচেয়ে কাছ ঘেঁষে চলবে ন্যাটো, কার প্রতিরক্ষা ব্যয় সকল শর্ত পূরণ করছে, এসব প্রশ্নই এখন আলোচনায়৷
ইউরোপের ভেতর একদিকে চরম ডানপন্থিদের বেড়ে ওঠার চাপ, অন্যদিকে, ঘরের কাছে যুদ্ধের আশঙ্কাকেও পুরোপুরি ফেলে দিতে পারছেন না দুই জোটের নেতৃত্বই৷ ফলে এখন আরো কাছে আসা ছাড়া দু'পক্ষের আর কোনো উপায় নেই৷
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর ন্যাটো
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর ৩২টি পশ্চিমা রাষ্ট্রের সামরিক জোট ন্যাটোর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, আবার ফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি।
ছবি: Gints Ivuskans/Getty Images/AFP
ন্যাটোয় ঢুকবে ইউক্রেন?
ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ কয়েকবছর ধরেই। কিন্তু দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করে রাশিয়ার আক্রমণের পর, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। ইউক্রেনের প্রতি ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সদস্যপদ প্রাপ্তি এখনও অনেক দূরের পথ। অনেক দেশই মনে করে এমন পদক্ষেপ রাশিয়াকে আরো উসকে দিতে পারে। তাছাড়া দেশটির বিভিন্ন নীতি এখনও ন্যাটোর মানে পৌঁছায়নি বলেও মনে করে অনেক দেশ।
ছবি: Artur Widak/NurPhoto/picture alliance
ন্যাটোর নতুন সদস্য
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর দীর্ঘদিন ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলা দুই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোয় যোগ দিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত ফিনল্যান্ডের। সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যান্ড আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, এমন ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা থেকেই মূলত নিরপেক্ষতা নীতি ভেঙে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাটোতে যোগ দেয় দেশটি। সুইডেন জোটে যোগ দেয় ২০২৪ সালের মার্চে।
ছবি: Pond5 Images/IMAGO
পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর উপস্থিতি
রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের আশঙ্কায় রয়েছে পূর্ব ইউরোপের নানা দেশ। পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশে ন্যাটোর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। ন্যাটো জানিয়েছে, এর মাধ্যমে জোটটি আবারও স্পষ্ট করছে, 'জোটের এক সদস্যের ওপর আক্রমণের মানে সবাইকে আক্রমণ'। পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশে ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া।
ছবি: U.S. Army/Zuma/imago images
বাল্টিকে সবচেয়ে বড় মহড়া
বাল্টিক সাগর এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে ১৯৭১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক মহড়া করে আসছে ন্যাটো। এই মহড়াকে সংক্ষেপে বলা হয় বাল্টোপস। ২০২৪ সালের ৭ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাল্টোপসের ৫৩তম সংস্করণ ন্যাটোর ইতিহাসে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া। ২০টি দেশ থেকে আসা নয় হাজার সৈন্য অংশ নেন এতে। ৩০টি যুদ্ধজাহাজ ছাড়াও স্থল ও আকাশপথেও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
নড়বড়ে মার্কিন অবস্থান
২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে ইউরোপে ন্যাটোর সহযোগীদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ন্যাটোর চুক্তি অনুসারে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের জিডিপির দুই শতাংশ ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বাজেট হিসাবে দেয়ার কথা। বেশিরভাগ দেশই তা না করায় যুক্তরাষ্ট্রকেই জোটের প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ বহন করতে হয়। এ নিয়ে সমালোচনা করায় জোটের অংশীদারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
ছবি: Nicholas Kamm/AFP
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার জিততে পারেন ডনাল্ড ট্রাম্প। ন্যাটোর সদস্যদের নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্য ভাবিয়ে তুলেছে অনেককে। ফেব্রুয়ারিতে প্রচারণায় তিনি বলেছেন, কোনো দেশ বাজেট বরাদ্দ না করলে তাদের আক্রমণে তিনি রাশিয়াকে 'উৎসাহিত' করবেন। এই মন্তব্যকে 'ভয়াবহ এবং অনাকাঙ্খিত' বলে নিন্দা জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ। এসব মন্তব্যে 'ন্যাটোর সদস্যরা ঝুঁকিতে পড়ছে' বলে মন্তব্য করেছেন ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ।
ছবি: picture-alliance/dpa/E. Vucci
শীর্ষে সম্ভাব্য পরিবর্তন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে জোটের নতুন প্রধান নিয়োগ দেয়া হতে পারে। বর্তমান প্রধান নরওয়ের ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গের মেয়াদ বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। তবে এবার সে পদে বিদায়ী ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বেশ এগিয়ে রয়েছেন। হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাকে সরাসরি সমর্থনও জানিয়েছে। ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নানা বিষয়ে সহজে বোঝাপড়ার করার ইতিহাস রয়েছে তার।
ছবি: NATO
ইউরোপিয়ান সেনাবাহিনী
ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে ইউরোপের নিরাপত্তা বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব সংকটে পড়েছিল। এরপরই ইউরোপের রাজনীতিতে জোরেসোরে উচ্চারিত হতে থাকে ন্যাটোর বিকল্প একটি ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের মূলে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ। তবে এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা এ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনায় পৌঁছাতে পারেননি।