জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনসহ সব কাজ শেষ৷ ট্রাইব্যুনাল-২ যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করবে৷ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ মনে করেন, সব অভিযোগ প্রমাণ করা গেছে৷
বিজ্ঞাপন
জামায়াত নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০১০ সালের ২৯শে জুন৷ ঐ বছরের ২রা আগস্ট তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷ তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা এবং ফরিদপুরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ এবং অগ্নি সংযোগসহ মোট সাতটি অভিযোগ আনে৷
এর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে হত্যা, মে মাসে ফরিদপুরের সংখ্যালঘু এলাকা বৈদ্যডাঙি, মাঝি ডাঙি ও বালা ডাঙি গ্রামে হামলা এবং অগ্নি সংযোগ৷ উল্লেখ্য, সেই হামলায় ৬০ জন নিহত হয়েছিলেন৷
সাঈদীকে ফাঁসির রায়, জামায়াতের তাণ্ডব
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের একাধিক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায় ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির৷ এতে হতাহত অনেক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনালের রায়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ কয়েকটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷
ছবি: AP
রায়ের পরই তাণ্ডব
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির৷ শুধু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৩৫ ব্যক্তি৷ বার্তাসংস্থা এএফপি এবং আমাদের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নিশ্চিত করেছে এই তথ্য৷ তবে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters
আক্রান্ত পুলিশ
বৃহস্পতিবার জামায়াতের তাণ্ডবে প্রাণ হারান চার পুলিশ সদস্য৷ এদের মধ্যে তিনজন নিহত হন গাইবান্ধা জেলায়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম জানিয়েছে, ‘পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে মারা হয় তাদের’৷ অপর একজন প্রাণ হারান চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় সংঘর্ষের সময়৷ বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহত এক পুলিশ সদস্য শুক্রবার প্রাণ হারান৷ সবমিলিয়ে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর শুক্রবার দুপুর অবধি পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা ৫৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী’
জামায়াত দাবি করেছে, ‘‘পুলিশের গুলিতে তাদের ৫০ জন ‘নিরপরাধ’ সমর্থক নিহত হয়েছে৷ পুলিশ তাদেরকে ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যা করেছে৷’’ তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান সুলতানা কামাল পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষও
জামায়াতের তাণ্ডবে পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকও৷ তবে সাধারণ মানুষও মরছে এই তাণ্ডবে৷ ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাণ হারান এক পথচারী, নোয়াখালি এবং বাঁশখালীতে নিহত হন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি৷ শুক্রবারও গাইবান্ধায় এক রিকশা চালক নিহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এবং জামায়াতের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের মাঝে পড়ে৷ নিরীহ প্রাণহানির এরকম খবর আরো শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ফেসবুক বন্ধ’
সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করে স্বাভাবিক উপায়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কারিগরি সমস্যার জন্য এমনটা হয়েছে’৷ তবে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তারা (বিটিআরসি) কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুনরায় আবারো চালু করেছে৷’
সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
জামায়াত-শিবির তাণ্ডব আর নাশকতা রুখতে গোটা দেশে সতর্ক রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷ বৃহস্পতিবার রাতেই বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি৷
ছবি: Reuters
ভিন্ন চিত্র
তবে সাঈদীর ফাঁসির রায়ে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ৷ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন শাহবাগে অবস্থানরতরা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়৷ ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান অগুনতি মানুষ৷
ছবি: Reuters
‘শহীদের আত্মা শান্তি পাবে’
সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার৷ রায় ঘোষণার পরে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় দেশমাতৃকা কিছুটা পাপমুক্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে৷’
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আরো রায় বাকি
এখন পর্যন্ত তিন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি আছে আরো যুদ্ধাপরাধীর বিচার৷ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অপেক্ষায় আছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখার৷ বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাই জেগে আছে প্রজন্ম চত্বরে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এরপর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরের রথখোলা এলকায় রণজিত নামে একজনকে অপহরণের পর হত্যা৷ জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ পাখিকে নির্যাতন৷ আগস্টের পর ঢাকায় সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল এবং আজাদকে হত্যা এবং ১০ই ডিসেম্বর থেকে মুজাহিদের পরিকল্পনায় ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যা৷ এছাড়া, ফরিদপুরের খলিলপুরে ১২ জন সংখ্যালঘুকে হত্যার অভিযোগও আছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে৷
মুজাহিদের পরিকল্পনায় রাজাকার আলবদর এবং শন্তি কমিটিরসদস্যরা এইসব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে৷ মুজাহিদ নিজেও সরাসরি কোনো কোনো হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়৷ এই মামলায় সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী এবং আহত মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ মোট ১৭ জন প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন৷
প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ ডয়চে ভেলেকে জানান যে, মুজাহিদের বিরুদ্ধে তারা সাতটি অভিযোগই প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন৷ তবে শুধু সাক্ষী নয়, তথ্য প্রমাণও হাজির করেছেন তারা৷ তাই তারা আশা করেন, ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবে৷ তবে মুজাহিদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন যে, মুজাহিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করা করতে পারেনি প্রসিকিউশন৷ তাঁর মতে, এটি একটি মিথ্যা এবং সাজানো মামলা হওয়ায় তা প্রমাণের প্রশ্নই ওঠে না৷ তিনি আশা করেন, এই মামলায় মুজাহিদ বেকসুর খালাস পাবেন৷ তাজুল ইসলামের দাবি মিথ্যা মামলার দায়ে প্রসিকিউশনের বিরুদ্ধে মামলার আদেশ দেয়া উচিত ট্রাইব্যুনালের৷
২০১০ সালের ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর এ পর্যন্ত মোট ছয়টি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে৷ এর মধ্যে চারটি মামলার রায়ে তিনজনের ফাঁসি এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ তবে গোলাম আযম ও আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলা এখনও রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে৷