প্রয়োজনে ফোন করুন ৯৯৯-এ
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯কদিন আগের ঘটনা৷ মোহাম্মদপুরের এক পরিবারের সদস্যরা ঢাকার বাইরে পটুয়াখালী চলে গেছেন৷ বাসায় ছিলেন বিবাহিত বড় ভাই৷ তাঁর দাম্পত্য কলহ ছিল৷ তিনি রাত সাড়ে ১২টার দিকে পটুয়াখালীতে তাঁর বোনকে ফোন করে জানান, ‘‘আমি আত্মহত্যা করছি৷ এছাড়া আরা কোনো উপায় নেই৷'' ঢাকার বাসায় আর কেউ ছিলেন না যে তাঁর পরিবারের সদস্যরা পটুয়াখালী থেকে ফোন করে কিছু একটা করতে বলবেন৷ ঢাকায় তেমন কোনো আত্মীয় স্বজনও ছিলেন না৷ তারপর ৯৯৯-এ ফোন৷ মাত্র ছয় মিনিটে পুলিশ পৌঁছে যায় মোহাম্মদপুরের বাসায়৷ তাঁকে উদ্ধার করা হয়৷ জীবন রক্ষা পায়৷
ঐ ব্যক্তির বোন নওশীন আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তখন কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না৷ সবাইকে বিষয়টি বলাও যায়না৷ হঠাৎ আমার ৯৯৯-এর কথা মনে পড়লো৷ ভাবলাম ফোন করে দেখি যদি কোনো সহায়তা পাওয়া যায়৷ ফোন করলাম৷ এরপরই দ্রুত ঘটনা ঘটতে থাকে৷ মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ মাত্র ছয় মিনিটের মধ্যে বাসায় গিয়ে আমার ভাইকে উদ্ধার করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘অনুরোধ করেছিলাম আমরা ঢাকা না আসা পর্যন্ত আমার ভাইকে যেন পুলিশের কাছে রাখা হয়৷ তারা তাই করেছেন৷ পুলিশের এই আচরণে আমি মুগ্ধ এবং বিস্মিত৷ আমরা যে ধরণের পুলিশকে চিনি এরা তার ঠিক উলটো৷ এত মানবিক আচরণ পাব তা কল্পনাও করতে পারিনি৷''
পুলিশের এই কলসেন্টার সেবা চালু হয় ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর৷ শুরুতে এটা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক হিসেবে চালু হলেও এখন এটা পুরোপুরিই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে৷ ৩০ সিটের কলসেন্টার দিয়ে শুরু হলেও এখন কলসেন্টারের সিটের সংখ্যা ১০০৷ এটা আরো বাড়ানোর কাজ চলছে৷ একসঙ্গে ১০০ কল স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিসিভ করতে পারে এই সেন্টার৷ এর সেবা ২৪ ঘণ্টা এবং ঢাকাসহ সারাদেশে৷
কলসেন্টারের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মিরাজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এখানে জরুরি সেবাগুলোই আমরা দেয়ার চেষ্টা করি৷ বিষয়টি পুলিশের হলে আমরা যে এলাকার ঘটনা সেই এলাকার পুলিশকে সংযুক্ত করি৷ ফায়ার সার্ভিস বা অন্য কোনো বিভাগের হলে আমরা তাদের সংযুক্ত করি৷ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুনের ঘটনায়ও ফার্ষ্ট রেসপন্ডার ছিল ৯৯৯৷ ওখানকার একজন কর্মচারী আমাদের প্রথম ফোন করেন৷ আর সম্প্রতি দু'টি আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনা রোধ করে আমরা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছি৷''
কত কল আসে?
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে চালু হওয়ার পর এপর্যন্ত প্রায় ১৭ লাখ কলে সেবা দিয়েছে ৯৯৯৷ এখন প্রতিদিন গড়ে ১৩-১৪ হাজার কল আসে৷ এরমধ্যে ১৮ থেকে ২০ ভাগ কলে সেবা দেয়া হয়৷ আর অনেক কল আসে যা শেষ পর্যন্ত সার্ভিসের উপযুক্ত হয়না৷ অনেকে কৌতূহলী হয়েও ফোন করেন৷ আর শিশুরাও ফোন করে৷ তারা অনেকটা মজা করার জন্যই ফোন করে৷
তবে কোনো অপ্রয়োজনীয় ফোনেই এখনো কোনো কল ব্লক চালু করা হচ্ছে না৷ কারণ তাঁরা চান নাগরিকরা আগ্রহী হোক, উৎসাহ পাক৷ তবে ভবিষ্যতে বিরক্তিকর কলের জন্য কলব্লক ব্যবস্থা চালু হবে৷
৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন রেকর্ড সংখ্যক কল আসে একদিনে৷ ওই দিন ৩০ হাজার ৯০৬টি কল আসে৷
নাগরিকরা যে ধরনের সেবা চান
পুলিশের এই কল সেন্টারের কল জরিপেই দেখা যায় যত কল আসে তারমধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই হলো পুলিশি সহায়তা চেয়ে৷ এরপরেই রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তার জন্য, শতকরা ২০ ভাগ৷ আর অ্যাম্বুলেন্সের জন্য শতকরা পাঁচ ভাগ৷ ঢাকাসহ সারাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবাদানকারী হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠান এখন ৯৯৯-এর সঙ্গে যুক্ত৷ এই নাম্বারে ফোন করা সহজ বলে নাগরিকরা এখন ফায়ার সার্ভিসের অনেক ডিজিটের নাম্বারে ফোন না করে এখানেই ফোন করেন৷ পুলিশের যেসব সেবা নাগরিকরা চান, তার মধ্যে অপরাধের তাৎক্ষণিক প্রতিকার চাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন অপরাধের তথ্যও দেন৷
যেভাবে চিহ্নিত করা হয়
কেউ কল করলে তার ঘটনা জানার পর তার অবস্থান নিশ্চিত হয় কল সেন্টার৷ যিনি ফোন করেন তিনি তার অবস্থান বলেন৷ আশপাশের স্থাপনা বা কোনো দোকান, হোটেল রেস্টুরেন্টের নাম বলেন৷ এরপর কল সেন্টার থেকে ডিজিটাল ম্যাপের মাধ্যমে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সবচেয়ে কাছের থানা, পুলিশ ফাঁড়ি বা টহল পুলিশের গাড়ির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে তাঁর কাছে পৌঁছানো হয়৷ কল সেন্টারে এখন মোট জনশক্তি ৪৭০ জন৷
কল সেন্টার নিয়ে জনসচেতনতার কাজও করা হয়৷ চলতি সপ্তাহেই পাবনার একটি স্কুলের সাথে কল সেন্টার প্রোগাম করা হয়৷ স্কুলের শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে কলসেন্টারে কল করে সরাসরি শিখানো হয় কীভাবে কলসেন্টারে কল করে সেবা নিতে হয়৷
এএসপি মিরাজুর রাহমান বলের, ‘‘দক্ষিণ এশিয়ায় এই ধরণের ৯৯৯-এর মাধ্যমে জরুরি সেবা বাংলাদেশেই প্রথম৷ আমরা নাগরিকের যেমন সাড়া পাচ্ছি, তেমনি আমরাও আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি তাদের সেবা দিতে৷''
রেসপন্ড টাইম আরো কমে যাবে
রেসপন্ড টাইম কমানোর জন্য প্রত্যেক থানা পর্যায়ে একটি করে ডিসপার্স সিস্টেম দেয়া হয়েছে৷ প্রত্যেক মেট্রোপলিটন থানায় গাড়িতে একটি করে মোবাইল ডাটা টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে৷ এগুলো অনলাইনে যুক্ত করা হয়েছে৷ ফলে কোনো কলারের অবস্থান এবং তার নিকটবর্তী থানা চিহ্নিত করা যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে৷ ফলে রেসপন্ড টাইম কমে আসবে৷
পুলিশের ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন?
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘‘পুলিশের এই কলসেন্টার নিয়ে যেমন উচ্ছ্বাস আছে, তেমনি সেবা না পাওয়ারও অভিযোগ আছে৷ তারপরও এটা পুলিশের একটা ইতিবাচক কাজ৷ মানুষ নতুন একধরনের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছে৷ তবে এই কাজ দিয়ে পুরো পুলিশের ভাবমূর্তি পরিবর্তন সম্ভব নয়৷ এর জন্য পুলিশের পুরো প্রক্রিয়ায় আমুল পরিবর্তন আনতে হবে৷ পুলিশ তার ভাবমূর্তি পরিবর্তন করতে চাইলে বেআইনি কাজ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে থেকে বিরত থাকতে হবে৷''