চাষের জমি বা গরু চরানোর জমির অবনতি ঘটে নানা কারণে৷ অথচ এই অবনতি না রুখলে বিশ্বের তিন’শ কোটি মানুষ তাদের খাদ্যের উৎস হারাবে৷ একটি সমাধান হচ্ছে চাষিদের টেকসই চাষের পদ্ধতি শেখানো৷
বিজ্ঞাপন
চাষবাসের উর্বর জমি মানবসভ্যতার পক্ষে অপরিহার্য৷ বিজ্ঞানীরা কিন্তু দেখছেন, জমির গুণগত উৎকর্ষ কমে আসছে৷ বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জমি এভাবে বিপন্ন৷ চাষের জমি, গরু চরানোর জমি বা বনজঙ্গল নষ্ট হওয়ার ফলে প্রায় তিন'শ কোটি মানুষের পেটে টান পড়তে পারে; বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলার৷
বন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর ইওয়াখিম ফন ব্রাউন বলেন, ‘‘বিশ্বে জমির পরিস্থিতি শঙ্কাজনক৷ এবং তা ক্রমেই আরো খারাপ হচ্ছে৷ জমির উর্বরতা কমছে, কেননা জমির সযত্ন ও সুবিবেচক ব্যবহারের জন্য চাষিদের কোনো উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না৷ অবকাঠামো আর শহর বাড়ায় ক্রমেই আরো বেশি জমি নষ্ট হচ্ছে৷ জমির অবনতি ঘটলে, সভ্যতা বাঁচবে না৷ ইতিহাস তা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে৷''
পানির উপর হচ্ছে সবজি চাষ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামের বেশিরভাগই বছরের পুরোটা সময় জলাবদ্ধ থাকে৷ এ সব গ্রামের মানুষেরা ভাসমান পদ্ধতিতে গাছের চারা এবং সবজি উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন৷
ছবি: DW
কৃষকের কৌশল
বছর জুড়েই জলাবদ্ধতা, সাথে কচুরিপানার মিছিল৷ ফলে পিরোজপুরের নাজিরপুর এলাকার নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক উপায়ে কৃষিকাজ কার্যত অসম্ভব৷ তবে বৈরী এই পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে নাজিরপুরের কৃষকরা নিজেদের কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষিকাজ৷
ছবি: DW
ভাসমান কৃষিক্ষেত্র
নাজিরপুরের মুগাঝোর এলাকার জলাভূমিতে ভাসমান কৃষিক্ষিত্র৷ নিজেদের উদ্ভাবিত ‘ধাপ’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন এ সব এলাকার মানুষরা৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল’ হিসেবেও স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে নাজিরপুরে উদ্ভাবিত ভাসমান পদ্ধতির এ চাষাবাদ৷
ছবি: DW
যেভাবে তৈরি হয় ধাপ
নাজিরপুরের পানিতে ডোবা নিম্নাঞ্চল কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জল সহিষ্ণু ঘাসসহ নানান জলজ উদ্ভিদে ভরপুর৷ এ সব জলজ উদ্ভিদকে স্তূপ করে পচিয়ে তারা তৈরি করেন ভাসমান এক ধরণের ধাপ৷ এই ভাসমান ধাপের উপরেই চাষাবাদের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তাঁরা৷
ছবি: DW
পুরনো ধারা
কৃষি জমির বিকল্প হিসেবে জলাশয়ে ভাসমান চাষাবাদ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে এ অঞ্চলে৷ কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিতে কৃষির উৎপাদনশীলতা জমির চেয়ে ১০ গুণ বেশি৷
ছবি: DW
জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ
ধাপ পদ্ধতির এ চাষাবাদ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে৷ রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই বললেই চলে৷ ফলে উৎপাদন খরচও কম এবং স্বাস্থ্যকর৷
ছবি: DW
ভাসমান বীজতলা
জলাভূমিতে প্রথমে কচুরিপানা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জলজ ঘাস স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়৷ এগুলো কয়েকদিন ধরে পচানো হয়৷ একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০-৬০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার চওড়া হয়৷
ছবি: DW
চাষ করা যায় অনেককিছু
ভাসমান এ সব ধাপে সাধারণত লাউ, সিম, বেগুন, বরবটি, করলা, পেঁপে, টমেটো, শশা, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, মরিচ ইত্যাদি শাকসবজি ও মশলার চারা উৎপাদন করে থাকেন কৃষকরা৷ অনেক কৃষক আবার লাল শাক, ঢেঁড়স, হলুদ ইত্যাদিও চাষ করে থাকেন৷
ছবি: DW
নেই কোনো কৃষিঋণের ব্যবস্থা
মুগারঝোরের চাষীদের জন্য কৃষি ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চরা হারে সুদ নিয়ে গরিব এ চাষীরা তাঁদের কৃষি কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন৷ স্থানীয় কৃষক আশুতোষ জানান, সরকার সহজশর্তে ঋণ দিলে তাঁরা ভাসমান এ চাষাবাদের আরও বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন৷
ছবি: DW
বিক্রি হয় কচুরিপানা
নাজিরপুরের মুগারঝোরে নৌকা বোঝাই কচুরিপানা নিয়ে ক্রেতার খোঁজে এক বিক্রেতা৷ এক নৌকা কচুরিপানা সাধারণত বিক্রি হয় ২-৩ হাজার টাকায়৷ এছাড়া নাজিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় এসব কচুরিপানার হাটও বসে৷
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
বন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন৷ জমির অবনতির বিরুদ্ধে অবিলম্বে কিছু একটা করা না হলে, ভবিষ্যতে সেই জমি আবার ঠিক করার খরচ অনেক বেশি হবে৷ এটা একটা বিশ্বায়িত সমস্যা৷ ফন ব্রাউন বলেন, ‘‘বিশ্বের তিনটি বড় এলাকায় জমির খুবই অবনতি ঘটেছে: দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার দক্ষিণাঞ্চল৷ এই হটস্পটগুলো আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আসলে এটা একটা গ্লোবাল প্রবলেম৷ উত্তর অ্যামেরিকা, রাশিয়া, চীনের উত্তরাঞ্চল, ইউরোপের কিছু অঞ্চল – যেমন স্পেন – এর ভুক্তভোগী৷''
সমস্যা ও সমাধান
জমির ক্ষয়ের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা ব্যাপক, অ-টেকসই কৃষিকাজের কথা বলেছেন৷ কম জমিতে বেশি পশুপালন; জঙ্গল কেটে সাফ; কৃষিক্ষেত্র আর চারণভূমির পক্ষে হানিকর পদ্ধতিতে চাষবাস ও গোচারণ৷ শেষমেষ পানি বা বাতাসেও মাটি উড়ে যায়৷ ফন ব্রাউন বলেন, ‘‘জমির নবীকরণ সম্ভব – কিন্তু দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার পলি জমতে কয়েক দশক নয়, কয়েক শতক বা হাজার বছর সময় লেগে যেতে পারে৷ জমি আসলে কোনো নবায়নযোগ্য সম্পদ নয়৷''
বিশেষ করে দরিদ্ররাই জমি খারাপ হওয়ার ফলে সমস্যায় পড়েন, কেননা খাদ্যের দাম বাড়ায় তাদের পক্ষে সেই দাম দেওয়া আর সম্ভব হয় না৷ নয়ত ধনি-দরিদ্র, সকলেই প্রভাবিত হয়৷ বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বাসস্থান বাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে৷ তবে আশা আছে, বিশেষ করে যদি সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা যায়৷ ফন ব্রাউন-এর অভিমত, ‘‘আমরা যদি জমির অবনতি রোখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি, যেমন লাঙল না দিয়ে চাষ, টেকসই সেঁচ, কোন ফলের পর কোন ফলের চাষ, মাত্রাধিক নাইট্রোজেন ব্যবহার না করে সার প্রয়োগ – তাহলে এ সব পদক্ষেপের ব্যয় যতোই হোক না কেন, জমির অবনতি সামাল দিতে যে খরচ পড়বে, তা হবে এর পাঁচগুণ৷''
বাংলাদেশে পাম চাষ
ভোজ্য তেল হিসেবে পাম ওয়েলের ব্যবহার বাংলাদেশে দিন দিন বাড়ছে৷ এই তেলের বেশির ভাগই আমদানি করা হয়৷ তবে কয়েক বছর ধরে দেশেই পাম চাষ শুরু হয়েছে৷
ছবি: AP
পাম তেল
পাম গাছের ফল প্রক্রিয়াজাত করে যে তেল পাওয়া যায় তাকে পাম তেল বলে৷ পাম ফলের মাংসল অংশ ও বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়৷ মাংসল অংশ থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তার নাম পাম তেল৷ আর বীজ বা ক্যার্নেল থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তার নাম পাম ক্যার্নেল তেল৷
ছবি: CC/Cayambe
বাংলাদেশে প্রথম
জাতীয় ই-তথ্যকোষে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম মালয়েশিয়া থেকে পাম বীজ আনা হয়েছিল৷ তবে জোরেশোরে পাম চাষ শুরু হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে৷ সেসময় সরকারি পর্যায় থেকে পাম চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়৷ কয়েকটি সংস্থাও এক্ষেত্রে প্রচারণা শুরু করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমস্যা
প্রচারণায় উৎসাহী হয়ে অনেক কৃষক ঋণ নিয়ে পাম চাষ শুরু করেছিলেন৷ তবে তিন-চার বছর পর গাছে ফল আসলে, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন তাঁরা৷ কেননা এই ফল থেকে কীভাবে তেল উৎপাদন করতে হবে সে বিষয়ে ততটা জানা ছিল না কৃষকদের৷
ছবি: CC/a_rabin
আশার কথা
মেহেরপুরের কয়েকজন যুবক নিজেদের উদ্যোগে পাম ফল থেকে তেল উৎপাদনের জন্য একটি মেশিন তৈরি করেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture alliance/dpa
মেশিন ছাড়া তেল
গাছ থেকে পরিপক্ক ফল নামিয়ে পাত্রের মধ্যে পানিসহ ফুটিয়ে সেগুলোকে নরম করতে হবে৷ এরপর নরম ফলগুলো হাতে চেপে রস বের করতে হবে৷ তারপর পানি মিশ্রিত এ রসকে একটি পাত্রে রেখে চুলায় কিছুক্ষণ তাপ দিলে রসে বিদ্যমান পানি বাষ্পাকারে বের হয়ে যাবে এবং পাত্রের মধ্যে পাম তেল জমা থাকবে৷
ছবি: WWF/J. Morgan
দুটি পাম গাছই যথেষ্ট
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি পরিবারে দুটি পামঅয়েল গাছ চাষ করলে ঐ পরিবারের সারা বছরের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব৷ এছাড়া প্রতিটি পরিবার যদি পাম চাষে এগিয়ে আসে তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো বাংলাদেশকে তেল আমদানি করতে হবে না বলেও মনে করেন তাঁরা৷
ছবি: picture alliance/dpa
অর্থ সাশ্রয়
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি খাতে প্রতি বছর ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়৷ যে তেল আমদানি করা হয় তার ৬০ শতাংশই পাম তেল৷ তাই পাম চাষ বাড়ানো গেলে এই অর্থের একটা বড় অংশ সাশ্রয় করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ কারণ বাংলাদেশের জমি পাম চাষের বেশ উপযোগী৷
ছবি: AP
7 ছবি1 | 7
সেটা কিভাবে সম্ভব, তা দেখিয়েছেন উজবেকিস্তানের চাষিরা; বনের গবেষকরা এই প্রকল্পে তাদের সাহায্য করছেন৷ এক্ষেত্রে জমি বিশেষ তৈরি করার প্রয়োজন পড়ে না, নয়ত একাধিক ধরনের ফসল একসঙ্গে বোনা হয়৷ এর ফলশ্রুতি হিসেবে চাষের জমি শুকিয়ে যাওয়া অথবা ক্ষয়ের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পায়৷ জমি বেশি চাষ করার দরকার হয় না বলে চাষিদের ডিজেলের খরচ বাঁচে, অথচ আরো বেশি ফসল হয়৷ এটা নাকি সারা বিশ্বে করা সম্ভব৷ ফন ব্রাউন-এর মতে, ‘‘চাষিরা যাতে টেকসইভাবে জমি ব্যবহার করেন, সেজন্য তাদের প্রেরণা দরকার৷ সেই প্রেরণা হবে জমির দীর্ঘমেয়াদি ইজারা অথবা সরাসরি মালিকানা৷ এছাড়া তারা যে জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু সুরক্ষার জন্য কাজ করছেন, পানির অপব্যবহার রোধ করছেন, সেজন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷''
জমি বা মাটি হলো এমন একটি প্রাকৃতিক সম্পদ, যা নিয়ে মানুষ সবচেয়ে কম মাথা ঘামায়৷ এখন জমির অবনতির বিরুদ্ধে কিছু একটা করার সময় এসেছে, নয়ত পৃথিবীতে দারিদ্র্য বাড়বে ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরো সমস্যাকর হয়ে দাঁড়াবে৷