মিয়ানমারের কাছে তাঁরা অপয়া৷ সুযোগ পেলেই তাঁদের মেরে, কেটে দেশান্তরি করছে দেশটির সামরিক বাহিনী৷ নিজের দেশে নির্মম নির্যাতনের শিকার এই মানুষরা বাংলাদেশে এসে পাচ্ছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক স্বাদ৷
বিজ্ঞাপন
মার্টিনার সঙ্গে দেখা ঢাকা বিমানবন্দরে৷ কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক বিমান ছাড়বে একটু পর৷ হঠাৎ করে এক ভিআইপির সঙ্গে আরো তিন-চারজন প্রবেশ করলেন ওয়েটিং রুমে৷ নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের চেক করার সাহস অবধি পেলেন না৷ এমন অবস্থা দেখে খানিকটা বিরক্ত হন মার্টিনা৷
বিরক্ত আমিও হয়েছিলাম৷ ভিআইপি হলেই কি তাঁরা নিরাপত্তার তল্লাশির আওতামুক্ত নাকি? এই নিয়ে বিরক্তির সূত্র ধরেই আসলে মার্টিনার সঙ্গে আলাপ হয়৷ ইউরোপের এই বাসিন্দা ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন কক্সবাজারে, উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটানো৷ আমি তাঁর কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম৷ একজন ইউরোপীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যেতে পারে এমনটা আমার ভাবনাতেও ছিল না৷
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস
একটা সময় ছিল যখন কয়েকজন রোহিঙ্গা মিয়ানমার সংসদে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ আর এখন রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ারই অধিকার নেই৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
স্বাধীনতার আগে
বর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে দাবি অনেক ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন (১৮২৪-১৯৪৮) ছিল তখন বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিল৷ তবে তারা যেহেতু ব্রিটিশ আমলে এসেছে তাই স্বাধীনতার পর মিয়ানমার তাদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করে৷ প্রতিবেদন পড়তে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters/Z. Bensemra
রোহিঙ্গা সাংসদ
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সংসদকে জানান, বার্মায় ১৯৫১ সালের নির্বাচনে পাঁচজন ও ১৯৫৬ সালে ছ’জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ সব মিলিয়ে মিয়ানমার সংসদে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গা সাংসদ ছিলেন বলে জানান তিনি৷ এর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad
অভ্যুত্থান
১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর সব নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন কার্ড করতে বলা হলেও রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছিল বিদেশি পরিচয়পত্র৷ ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য চাকরি ও পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়৷ ছবিটি ১৯৬২ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP
প্রথমবার বিতাড়ন
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে তাড়াতে ১৯৭৭ সালে নির্যাতন শুরু করা হয়৷ ফলে ১৯৭৮ সালের মে মাসের মধ্যে প্রায় দু’লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর জুলাইতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ জাতিসংঘও মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Huda
‘গোপন’ চুক্তি
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ঐ চুক্তির উপর ‘সিক্রেট’ অর্থাৎ ‘গোপন’ শব্দটি লেখা ছিল৷ ২০১৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়টি চুক্তিটি প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের একসময় জাতীয় নিবন্ধন কার্ড ছিল তাঁদের মিয়ানমার সরকার ‘বার্মার বৈধ বাসিন্দা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ চুক্তিটি পড়তে উপরে (+) চিহ্ন ক্লিক করুন৷
ছবি: http://dataspace.princeton.edu
রাষ্ট্রহীন
১৯৮২ সালে পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বস্তুত রাষ্ট্রহীন করে দেয়া হয়৷ ঐ আইনে মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম নেই৷ এই আইনের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য পড়াশোনা, চাকরি, ভ্রমণ, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া ইত্যাদি সীমিত হয়ে যায়৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/C. McNaughton
দ্বিতীয় পর্যায়ের বিতাড়ন
১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার৷ ফলে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর তাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল৷ বিবৃতিতে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের বাসিন্দা’ এবং ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল৷
সবশেষ ঘটনা
গত আগস্টের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করে৷ ইতিমধ্যে এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ৷ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছয় লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ তবে তাদের ফিরিয়ে নিতে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
8 ছবি1 | 8
মার্টিনার সঙ্গে পরবর্তীতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও দেখা হয়েছিল৷ সবসময় শিশুরা ঘিরে রাখতো তাঁকে৷ আর তাতে তাঁর চেহারায় ভেসে উঠতো এক প্রশান্তির ছাপ৷ তবে মার্টিনা একা নন৷ কক্সবাজারে তাঁর মতো আরো কয়েকজন বিদেশির সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাঁরা নিজেদের অবসর সময়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন রোহিঙ্গাদের সেবা করতে৷ একদল জাপানিকে দেখেছি প্রতিদিন ঠিক আটটার সময় নিজেদের উন্নয়ন সংস্থার ইউনিফর্ম পরে হোটেল লবিতে জড়ো হতে৷ সেখান থেকে দলবেঁধে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যেতেন তাঁরা৷ সারাদিন কাটিয়ে ফিরতো সন্ধ্যার দিকে৷ তাঁদের চোখে কখনো ক্লান্তি দেখেনি, বরং বিপদে পড়া মানুষদের জন্য কিছু একটা করতে পারার আনন্দ দেখেছি তাঁদের মধ্যে৷
আর শুধু বিদেশিদের কথা বলছি কেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া দেশি মানুষের সংখ্যাও কি কম নাকি! সেনাবাহিনীর ত্রাণ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে ট্রাকভর্তি খাবার, ঔষুধ আর পোশাক নিয়ে হাজির হতে দেখেছি অনেক সাধারণ মানুষকে৷ কেউ কেউ নিরবে এসে নগদ টাকা ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করেছেন৷ তাঁদের সেই টাকা বৈধ কিনা জানিনা, তবে খরচটা মহৎ উদ্দেশ্যেই করেছেন৷
গত কয়েক মাসে ছয়লাখের বেশি রোহিঙ্গা আসায় এমনকি ঢাকা শহরেও নাকি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে৷ সীমান্ত এলাকার মানুষদের তো এই নিয়ে ক্ষোভেরও শেষ নেই৷ তাসত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের প্রতি ভালোবাসায় তাঁদের কোনো কমতি নেই৷ বরং তাঁদের কষ্টের কথা বোঝেন স্থানীয় বাঙালিরা৷ অনেকে সীমান্তের এপাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারে রোহিঙ্গাগ্রামে আগুন জ্বলতে দেখেছেন, শুনেছেন মানুষের আর্তনাদ৷ তাই কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে স্থানীয় মানুষদের রোহিঙ্গাদের প্রতি ভালোবাসায় ঘাটতি দেখা যায় না৷
রোহিঙ্গাদের প্রতি দেশি-বিদেশি মানুষদের ভালোবাসা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, মাঝে কয়েকদিন শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখতে হয়েছিল৷ কেননা, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ত্রাণ পৌঁছে গিয়েছিল রোহিঙ্গাদের ঘরে৷ আর সেগুলো ব্যবহার না করে জমা করায় খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল৷ ফলে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ রাখা হয় যাতে রোহিঙ্গারা ঘরে জমানো খাবার আগে শেষ করেন৷
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যে হয়ত গণমাধ্যমের নজর রোহিঙ্গাদের উপর থেকে সরে যাবে৷ তখন তাঁদের দিকে যে ত্রাণের জোয়ার চলছে তাতে ভাটা পড়বে৷ চাপ বাড়বে বাংলাদেশ সরকারের উপর৷ আমার অবশ্য তা মনে হয় না৷ বরং রোহিঙ্গাদের আগামী কয়েকবছর চালিয়ে নেয়ার মতো রসদ দেশি-বিদেশি দাতারা নিশ্চিতভাবেই দেবে৷ অন্তত রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁদের টান দেখে তাই মনে হয়৷
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷