সাগরের পানির নীচে এক ধরনের শামুক থাকে, যার বিষ নাকি মুহূর্তের মধ্যে একটা মাছকে কাবু করে ফেলতে পারে৷ কিন্তু সেই বিষ থেকে আবার এমন ব্যথা সারানোর ওষুধ তৈরি করা যায়, যা মর্ফিনের চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী৷
বিজ্ঞাপন
টর্স্টেন নিকেল্স টানা চার বছর পিঠের ব্যথায় ভুগেছেন৷ স্পাইনাল ডিস্কে ছ'বার অপারেশন হয়েছে; এমনকি মর্ফিন নিয়েও ব্যথা কমেনি৷ টর্স্টেন জানালেন, ‘‘বার বার অপারেশন করা হয়েছে, কিন্তু ব্যথা যা ছিল, তাই থেকে গেছে৷ আমি যে আর কখনো ব্যথা ছাড়া বাঁচতে পারব, এ আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম৷''
টর্স্টেন নিকেল্স শেষমেষ এক ডাক্তার খুঁজে পান, যিনি তাঁকে একটি বিশেষ কার্যকরি পেইনকিলার প্রেস্ক্রাইব করেন৷ এই ব্যথার ওষুধটি তৈরি হয়েছে একটি সামুদ্রিক শামুকের বিষ থেকে৷
পেটের অ্যাবডোমিনাল ওয়ালের তলায় রাখা একটি পাম্প দিয়ে ওষুধটা ছোট ছোট ডোজে স্পাইনাল ম্যারো বা মেরুদণ্ডের মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ ডোজটা ঠিক হওয়া চাই, সেটাই হলো ডাক্তারদের পক্ষে আসল চ্যালেঞ্জ৷ সুবিধে হলো, মর্ফিনের মতো এ ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ পেইন থেরাপিস্ট ডক্টর বার্বারা ক্লাইনমান জানালেন, ‘‘এই ওষুধটা তৈরি করতে পারাই একটা চমকে যাওয়ার মতো ব্যাপার৷ ওষুধটা মর্ফিনের চেয়ে এক হাজার গুণ শক্তিশালী৷ আমার মতো বহু ব্যথার ডাক্তার এ ধরনের একটা ওষুধের খোঁজে ছিলেন৷''
বিষধর ওষুধ
বিষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের প্রাণনাশক হতে পারে৷ কিন্তু কথায় বলে বিষে বিষ ক্ষয়৷ তাইতো সাপ, বিছা কিংবা মাকড়সার মত বিষধর প্রাণীর বিষ থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়৷
ছবি: San Diego Shooter/nc/nd
বিষ থেকে হৃদরোগের ওষুধ
অস্ট্রেলিয়ার এই সাপটি সবচেয়ে বিষধর সাপ বলে ধারণা করা হয়৷ অথচ এই সাপের বিষ হৃদরোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিছা বেশ কাজের
কাকড়া বিছার বিষ ভয়াবহ এবং এই বিষে মানুষের মৃত্যু হতে পারে৷ কিন্তু এর বিষ ব্যথা কমানোর ওষুধে এবং হৃদরোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: Fotolia/scorpsnakes
মাকড়সা থেকে ওষুধ
এই বিষধর মাকড়সার দেখা মেলে চিলিতে৷ আর হৃদরোগ উপশমে ব্যবহার করা হয় এটিকে৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা এটির বিষ বন্ধ্যাত্ব দূর করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷
ছবি: Pedro Avaria
বাতের ব্যথা সারায় মৌমাছির হুল
বাতের ব্যথা কমাতে ‘মৌমাছির হুল’ চিকিৎসা করা হয়৷ দেহের যে স্থানে ব্যথা থাকে সেখানে হুল ফোটানো হয়৷ চিকিৎসার এই ধরন প্রায় তিন হাজার বছরের পুরানো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলজাইমারের চিকিৎসা
বিজ্ঞানীরা বলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় হলুদ রংয়ের এই সাপের বিষ স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে৷ অর্থাৎ আলজাইমারের ক্ষেত্রে এই সাপের বিষ অত্যন্ত ভালো ওষুধ৷
ছবি: San Diego Shooter/nc/nd
বেদনানাশক শামুক
শামুকের মুখ থেকে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ বের হয়৷ এটি বেদনানাশক ওষুধে ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: picture-alliance
কোবরার বিষ
গলায় কালো রংয়ের এই কোবরা বা কেউটে সাপের বৈশিষ্ট্য হল, এরা ফনা তুলে বাতাসে বিষ ছোড়ে৷ এর বিষ অত্যন্ত মারাত্মক৷ কিন্তু এই বিষই অনেক রোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বহুমূত্র রোগের চিকিৎসা
এই প্রজাতির টিকটিকির বিষ ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়৷ এর লালায় বিশেষ ধরনের একটি রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে৷
ছবি: Fotolia/www.bitis.de
8 ছবি1 | 8
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালদোমেরা অলিভেরা-র সংগ্রহে এই হিংস্র সামুদ্রিক শামুকটির কিছু বিরল ভিডিও ছবি আছে৷ বিষযুক্ত বাণ ছুঁড়ে এই শঙ্খ জাতীয় প্রাণীটি মুহূর্তের মধ্যে শিকারের প্রাণ নিতে পারে৷
সারা বিশ্বের গবেষকরা চেষ্টা করছেন, সামুদ্রিক শামুকের বিষের রহস্য ভেদ করার৷ নিউরোফিজিওলজিস্ট প্রফেসর হাইনরিশ টের্লাউ জানালেন, ‘‘শামুকরা শ্লথগতি, তাদের শিকারের পিছনে ধাওয়া করা সম্ভব নয়৷ শুধুমাত্র যে সব শামুকের বিশেষভাবে কার্যকরি বিষ আছে, একমাত্র তারাই বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকতে পেরেছে৷ এভাবেই এই ‘কোন শেল' বা ‘কোন স্নেইল', অর্থাৎ শঙ্খাকৃতির শামুক তার বিষ সৃষ্টি করতে পেরেছে, যা যেমন শক্তিশালী, তেমনই দ্রুত কাজ করে৷''
এ ধরনের প্রায় পাঁচ'শ শামুক আছে৷ তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধরনের বিষ আছে – সে বিষও আবার নানা পদার্থের সংমিশ্রণ৷ বিজ্ঞানীরা এক একটি করে সেই সব পদার্থের প্রকৃতি ও পরিচয় বোঝার চেষ্টা করছেন৷ সাফল্যও পাচ্ছেন; যেমন একটি পদার্থ বহুমূত্র রোগীদের রক্তে শর্করা কমাতে সক্ষম, কেননা তা থেকে শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন বাড়ে৷ টের্লাউ জানালেন, ‘‘প্রত্যেক প্রজাতির শামুক একশো থেকে দু'শো ধরনের পদার্থ সৃষ্টি করেছে৷ তাদের বিষে লক্ষ লক্ষ পদার্থ পাওয়া যাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি৷ তার মধ্যে মাত্র কয়েকটিকে আমরা চিনি৷''
সাগরে শিক্ষা ট্যুর
এটা একটি বিশেষ ধরনের বিদেশ ভ্রমণ৷ সারা জার্মানি থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা অ্যাটলান্টিকের বুকে কাটায় দীর্ঘ ছয় মাস৷ সেখানে তারা বিদেশি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে৷ জাহাজেই চলে এই ক্লাস৷ এমনকি জাহাজটিও চালায় তারা নিজেরাই৷
ছবি: KUS-Projekt
‘টোর হায়ারডাল’
গত প্রায় ২৫ বছর যবত তিন-তিনটি মাস্তুল বিশিষ্ট ‘টোর হায়ারডাল’ নামের এই জাহাজ যুব শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের সাগরের ওপর দিয়ে নিয়ে গেছে বিশ্বের নানা দেশে৷ ২০০৮ সাল থেকে এই জাহাজটি অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ‘সাগরে ক্লাসরুম’ নামের এই প্রজেক্টটির জন্য ‘রিজার্ভ’ করা থাকে৷
ছবি: KUS-Projekt
দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য প্যাকিং
মোট ১৯০ দিন সাগরে বসবাস, কাজেই সবকিছু সাথে নিতে হয়৷ বলা বাহুল্য তার মধ্যে খাবার-দাবার অন্যতম৷ ভ্রমণের চারদিন আগে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের নতুন ‘বাড়ি’, মানে এই জাহাজে সব জিনিস-পত্র তোলার ব্যাপারে একে-অন্যকে সাহায্য করে থাকে৷
ছবি: KUS-Projekt
আনন্দদায়ক এক জাহাজ
জার্মানির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট ৩৪ জন ছাত্র-ছাত্রী ইটালির বিশিষ্ট নাবিক ক্রিস্টোফার কলোম্বাস এবং বিশ্বখ্যাত আবিষ্কারক আলেক্সান্ডার ফন হুমবোল্ড-এর পথ অনুসরণ করছে৷ ছবিতে দেখুন, কেমন করে তারা জার্মানির কিল শহর থেকে বিভিন্ন চ্যানেলের ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ছে নতুন জগতে৷
ছবি: KUS-Projekt
প্রথম দিন
সুন্দর আবহাওয়া, সাগরের জল শান্ত – ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি এমন একটি দিনে শিক্ষার্থীরা সমুদ্র পথে যাত্রা শুরু করে৷ তারা উত্তর সাগরের একটি চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে থেকে ইংলিশ চ্যানেল এবং স্পেনের বিস্কায়া হয়ে টেনেরিফা পর্যন্ত পাড়ি দেয়৷
ছবি: KUS-Projekt
পাহাড়ের ছায়ায় ক্লাস
টেনেরিফার সেন্ট ক্রুজে জাহাজটি প্রথম এসে নাঙর ফেলে৷ সেখানে অতিথি বা ‘হোস্ট’ পরিবারে রাত কাটানোর পর শিক্ষার্থীরা স্পেনের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ‘পিকো ডেল টেইডে’-র চূড়ায় ওঠতে থাকে৷ পথেই ওদের জীববিদ্যার ক্লাস হয়৷
ছবি: KUS-Projekt
সাগরের অনুভূতি
অ্যাটলান্টিক মহাসাগর বা অতলান্ত সাহর পার হওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের নিজেদের অনেকটা নাবিকদের মতোই লাগে৷ জাহাজ ক্রু’র নির্দেশনায় জাহাজের সমস্ত কাজ ছাত্র-ছাত্রীরাই করে৷ এমন কি রান্না এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজও৷
ছবি: KUS-Projekt
যথেষ্ট হয়েছে রোদ আর পামগাছ দেখা
ক্যারিবিকে পৌঁছানোর পর আনন্দ যেন আর ধরে না তাদের! দীর্ঘ ২৪ দিন সাগরে কাটানোর পর এই সবুজ দ্বীপে নাঙর ফেলে এবং এত সুন্দর একটা সমুদ্রসৈকত দেখে শিক্ষার্থীদের মন ভরে যায়৷ এমনটাই তো আশা করেছিল তারা! স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলে আলহামরা-খ্যাত গ্রানাডা শহরেও হোস্ট পরিবার বাড়িতে ওরা রাত কাটায়৷
ছবি: KUS-Projekt
ইন্ডিয়ানাদের সাথে বাস
শিক্ষার্থীরা পানামাতে কয়েকদিন হোস্ট পরিবারে থাকা এবং কফি বাগানে কাজ করার সুবাদে কুনা-ইন্ডিয়ানাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা ও দেখার সুযোগ পেয়ে যায়৷
ছবি: KUS-Projekt
সাইকেলে কিউবা ঘুরে বেড়ানো
সাইকেল চালিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই কিউবার বিখ্যাত তামাক উৎপাদনকারী এলাকায় চলে যায়৷ সেখানে তারা কিউবার শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করে, গল্প করে, আর আড্ডা মারতে মারতে ঘুরে দেখে রাজধানী হাভানা৷
ছবি: KUS-Projekt
দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরা
সব শেষে বারমুডা এবং আৎসোরেন দ্বীপে ছোট্ট একটা বিরতির পর শিক্ষার্থীরা ফিরে আসে নিজ দেশে৷ সাগরে দীর্ঘদিনের এই শিক্ষা ভ্রমণ ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায় তো কাজে লাগবেই, একজন সম্পূর্ণ মানুষ হতেও হয়ত সাহায্য করবে অনেকটাই৷
ছবি: KUS-Projekt
10 ছবি1 | 10
টর্স্টেন নিকেল্স-এর ক্ষেত্রে সাগরের শামুকের কাছ থেকে পাওয়া ওষুধ ইতিমধ্যেই কাজ দিয়েছে৷ টর্স্টেন বললেন, ‘‘এই ওষুধটা পাবার পর আমি খুব ভালো আছি৷ আমি আবার সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে পারছি, কাজ করতে যেতে পারছি৷ আমার ব্যথা ৮০ ভাগ কমে গেছে৷''
সাগর থেকে পাওয়া ওষুধ হয়ত ভবিষ্যতে আরো অনেক রোগীর মুশকিল আসানের কাজ করবে৷