তিন মেয়ে গাড়িতে করে ঘুরছিল৷ হঠাৎ ছোট্ট এক জঙ্গলের পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল তারা৷ পাশেই নদী৷ আর সেই নদীর টলটলে পানিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে যায় তাদের একজন৷ ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা৷
বিজ্ঞাপন
একটা বড় কুমির মুহূর্তেই পানিতে টেনে নিয়ে যায় মেয়েটাকে৷ তাঁর বান্ধবীদের তা দেখা আর চিৎকার করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না৷ বলছি একটি ভিডিও-র কথা৷ ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিওটির শেষ দৃশ্যে একটি ব্যাগ ভেসে উঠতে দেখা যায়৷
ভিডিওটি বানানো৷ চামড়া না ব্যবহারে উৎসাহ দিতেও সেটি তৈরি হয়নি৷ তবে সেটি ইন্টারনেটে এমনভাবে ছড়িয়েছে যাতে মনে হয় মেয়েটি কুমিরের চামড়ার তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করায় সেটির প্রতিশোধ নিয়েছে একটি কুমিড়৷ কুমিড় কিংবা অন্য প্রাণীরা ঠিক কতটা প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠতে পারে আমি ঠিক জানি না৷ তবে এতটুকু জানি, তাদের সেই সাধ্য থাকলে মানবজাতির উপর বড় ধরনের প্রতিশোধই নিত তারা৷
ভাবছেন কেন বলছি এ কথা? কিছুদিন আগে প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠন পেটা-র একটি ভিডিও দেখার সুযোগ হয় আমার৷ সেখানে দেখানো হয়েছে, কিভাবে জীবন্ত প্রাণীর চামড়া ছিলে ফেলা হয় চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে৷ বিভৎস সেই দৃশ্য কুমিড়ের ভিডিও-র মতো বানানো নয়৷ বরং অনেকক্ষেত্রে প্রাণীকে পিটিয়ে বেহুশ করে ফেলা হয় সেটি চামড়া বের করে নিতে৷ সেই ভিডিও দেখার পর চামড়াজাত পণ্য ব্যবহার বেশ কঠিন৷
যারা পশুপ্রাণীকে কষ্ট দিতে চাননা, তারা একটু কষ্ট করে চামড়াজাত পণ্য ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে পারেন৷ আর যদি সেটা করতে গিয়ে কিছু কারণের দরকার হয়, তাহলে লেখার বাকি অংশও পড়ুন৷
প্রথম কারণ হতে পারে, অনেকে মনে করেন, চামড়া বোধহয় মাংস উৎপাদনের ‘বাই প্রোডাক্ট' হিসেবে আসে৷ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা কিছুটা সত্য বটে৷ তবে বৈশ্বিক বিবেচনায় বিষয়টি সেরকম নয়৷ গরু ছাড়াও আরো অনেক প্রাণী যেমন কুমিড়, সাপ, ক্যাঙ্গারুর মতো প্রাণীর চামড়াও ব্যবহার করা হয় অনেক পণ্য তৈরিতে৷ আর এসব প্রাণীর থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয় বর্বর উপায়ে৷ সেগুলোকে মেরে ফেলা হয় শুধু চামড়ার জন্য৷
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে প্রাণী নির্যাতনের কথা৷ চামড়ার অন্যতম উৎস হচ্ছে গরু৷ তবে শুধু গরু জবাই করে চামড়া সংগ্রহ করা হয় সেটা ঠিক নয়৷ বরং প্রাণী সংরক্ষণবিদদের দাবি, চামড়া তৈরি করতে গিয়ে গরুকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়৷ অনেকক্ষেত্রে সেগুলোকে বেদম পেটানো হয়৷ পাশাপাশি ওষুধ খাইয়ে সেগুলোর ওজন বাড়ানো হয়৷ আর সবচেয়ে নরম চামড়া কিন্তু বুড়ো গরু থেকে আসে না৷ সেটা সংগ্রহ করা হয় গরুর বাছুর হত্যা করে৷
তৃতীয় কারণ হিসেবে বেছে নিতে পারেন চামড়া শিল্পের শ্রমিকদের দুর্দশাকে৷ পশুর শরীর থেকে চামড়া আলাদা করার পর সেটিকে শুকাতে হয়৷ সেই শুকানোর প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ৷ আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে চামড়া শুকানোর প্রক্রিয়ায় কাজ করা শ্রমিকদের কোনোরকম প্রতিরোধক ব্যবস্থা ছাড়াই কাজটা করতে হয় যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর৷
এ সব কারণ বিবেচনায় এনে চামড়াজাত পণ্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে পারেন৷ তাছাড়া ‘সিনথেটিক লেদার', যা তৈরিতে কোনো প্রাণীকে হত্যা করা হয় না, সেই লেদারের জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ সবই এখন সহজে পাওয়া যায়৷ বিকল্প হিসেবে সেগুলো ব্যবহারের কথাও বিবেচনা করতে পারেন৷
দূষিত মাটি, রাসায়নিক বর্জ্য আর ইলেকট্রনিক আবর্জনার মধ্যে বাস করছেন পৃথিবীর প্রায় বিশ কোটি মানুষ৷ গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশনের পরিবেশ দূষণ প্রতিবেদন বলছে একথা৷ চলুন দেখা যাক, পৃথিবীর কোন স্থানগুলো সবচেয়ে দূষিত?
ছবি: Blacksmith Institute
জীবনযাপন কোথায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ?
পৃথিবীর বিশ কোটি মানুষ প্রতিদিন সরাসরি পরিবেশ দূষণের ক্ষতি মোকাবিলা করছেন৷ ভারী ধাতুর কারণে দূষিত হচ্ছে মাটি, রাসায়নিক বর্জ্য উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে আর ইলেকট্রনিক আবর্জনা জমছে নদীতে৷ গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশনের পরিবেশ বিষয়ক প্রতিবেদনে এরকম অনেক বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/JOKER
ঘানার আবোব্লশি ভাগাড়
ঘানার রাজধানী আক্রায় পশ্চিম আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহৎ ইলেকট্রনিক আবর্জনার ভাগাড়ে রয়েছে অসংখ্য পুরনো স্যাটেলাইট ডিশ এবং ভাঙা টেলিভিশন৷ গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশনের ‘দ্য এনভায়রনমেন্টাল টক্সিন রিপোর্ট’ অনুযায়ী এটি পৃথিবীর অন্যতম দূষিত স্থান৷ আবোব্লশি-র আশেপাশের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, মাটিতে বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৫ গুণ বেশি৷
ছবি: Blacksmith Institute
চিতারুম নদী, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার চিতারুম নদীর পানি সাধারণ পানীয় জলের তুলনায় এক হাজার গুণ বেশি দূষিত৷ এই পানিতে বিপুল পরিমাণ অ্যালুমিনিয়াম এবং আয়রনের মিশ্রণ রয়েছে৷ প্রায় দু’হাজার ফ্যাক্টরি এই নদীর পানি ব্যবহার করে এবং একইসঙ্গে শিল্প বর্জ্য এই নদীতেই ফেলে৷ অথচ চিতারুম নদী কয়েক কোটি মানুষের পানির মূল উৎস৷
ছবি: Adek Berry/AFP/Getty Images
জ্যারজিনস্ক শিল্প কেন্দ্র, রাশিয়া
রাশিয়ার রাসায়নিক শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র জ্যারজিনস্ক৷ ১৯৩০ থেকে ১৯৯৮ সাল সময়ের মধ্যে এই এলাকার প্রায় তিন লাখ টক রাসায়নিক বর্জ্য ঠিকভাবে বিনাশ করা হয়নি৷ ফলে সেগুলো ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করেছে এবং বাতাসে মিশে গেছে৷
ছবি: Blacksmith Institute
চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্র, ইউক্রেন
এখন অবধি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল চেরনোবিলে৷ ১৯৮৬ সালের ২৫শে এপ্রিল সেই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলের ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সব জীব মারা গেছে৷
ছবি: Blacksmith Institute
হাজারিবাগের চামড়া কারখানা, বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মধ্যে হাজারিবাগে সবচেয়ে বেশি চামড়া কারখানা রয়েছে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন ২৭০টি কারখানা থেকে ২২ হাজার ঘন লিটার দূষিত আবর্জনা বের হয় হাজারিবাগে৷ এই আবর্জনায় হেক্সাভ্যালেন্ট ক্রোমিয়াম রয়েছে, যার কারণে ক্যানসার হতে পারে৷ অথচ এই সব বর্জ্যই ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মেশে৷
ছবি: Blacksmith Institute
কাবওয়ের সীসা খনি, জাম্বিয়া
জাম্বিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কাবওয়ের শিশুরা শরীরের রক্তে অতিরিক্ত সীসা সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছে৷ গত এক শতক ধরে এখানকার সীসা খনিগুলো থেকে ‘ধূলি কণা’ মাটি এবং শহরের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে৷
ছবি: Blacksmith Institute
কালিমান্তানের সোনার খনি, ইন্দোনেশিয়া
বোর্নিও দ্বীপের ইন্দোনেশিয়ার অংশে অবস্থিত কালিমান্তান৷ সোনার খনির জন্য এই এলাকা বিশেষভাবে পরিচিত৷ সোনা খুঁজে পেতে অনেক খনি মার্কারি ব্যবহার করে যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর৷
প্রায় পাঁচ হাজার ফ্যাক্টরির আবর্জনা গিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার মাতানসা-রিয়াচুয়েলো নদীতে৷ এই নদীর দূষণের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখছে রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারীরা৷
ছবি: Yanina Budkin/World Bank
নাইজার ডেল্টা, নাইজেরিয়া
নাইজার নদীর বদ্বীপ নাইজেরিয়ার অন্যতম জনঅধ্যুষিত এলাকা হিসেবে বিবেচিত৷ সে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর আট শতাংশের বাস এখানে৷ দুর্ঘটনা এবং তেল চুরির ঘটনার কারণে প্রতি বছর গড়ে ২৪০,০০০ ব্যারেল পেট্রল নাইজার বদ্বীপে গিয়ে পৌঁছায়, যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে৷
ছবি: Terry Whalebone
শিল্প শহর নোরিলস্ক, রাশিয়া
রাশিয়ার শিল্প শহর নোরিলস্কে প্রায় ৫০০ টন কপার এবং নিকেল অক্সাইড ও দুই মিলিয়ন টন সালফার অক্সাইড বাতাসে মিশে গেছে৷ এখানকার বাতাসে দূষণের তীব্রতা এত বেশি যে ফ্যাক্টরির কর্মীদের আয়ু রাশিয়ার গড় আয়ুর চেয়ে দশ বছর কমে গেছে৷