যে সহিংসতা চোখে দেখা যায় তা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা হয়। আর যে ব্যথা মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয়. সেই সহিংসতার শাস্তি কী হবে?
বিজ্ঞাপন
ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকেই কন্যা সন্তানদের উপর এক রকম বৈষম্য এবং গণ্ডির ঘেরাটোপ থাকে। কন্যাসন্তানদের উপর পরিবারের পুরুষদের, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বাবার যৌন নির্যাতনের ঘটনাও বার বার সামনে এসেছে। সেই নিপীড়ন খালি চোখে দেখা যায়। ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/IMAGO
পারিবারিক সহিংসতার পোশাকি নাম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা ডিভি। মে মাসের গোড়ায় প্রকাশিত হয়েছে ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশনের এই বছরের প্রথম কোয়ার্টারের রিপোর্ট। প্রথম চার মাসে মোট সাড়ে সাত হাজার জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে সিংহভাগই এই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স সংক্রান্ত। হিসেব বলছে, মোট অভিযোগের ২০ শতাংশ পারিবারিক সহিংসতার কারণে। গতবছর জাতীয় মহিলা কমিশনে নথিভুক্ত মোট অভিযোগের ২৬ শতাংশ ছিল পারিবারিক সহিংসতাজনিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বছরেও তার কাছাকাছি যাবে সংখ্যাটা।
বিজ্ঞাপন
নীরব সহিংসতার ক্ষত
লিঙ্গবৈষম্য আমাদের উপমহাদেশের ডিএনএ-তে আছে। নারীর উপর আক্রমণের ঘটনা তাই সহজাত। পারিবারিক বা গার্হস্থ্য সহিংসতা বললে চট করে আমরা ধরে নিই বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে নারীদের উপর অত্যাচার। স্বামী এবং তার পরিবারের বাকি সদস্যদের নারীর শরীর এবং জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং আক্রমণ পারিবারিক সহিংসতার সিংহভাগ গঠন করে। ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্সের ঘটনা আমাদের দেশে আকছার ঘটে। তবে তার বাইরেও যে দুটি বিষয় বাস্তব হলেও উপেক্ষিত থেকে যায়, তা হলো, মানসিক অত্যাচার এবং বিয়ের আগে নিজের বাড়িতেই অত্যাচার (মানসিক বা শারীরিক)।
ভারতে প্রায় ২০ বছর হলো পারিবারিক সহিংসতা প্রতিহত করতে প্রোটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স (পিডাব্লিউডিভি) অ্যাক্ট পাশ হয়েছে। আইন থাকলেও ভারতে স্বজন যখন নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটায়, তখন তা পুলিশ বা মহিলা কমিশন পর্যন্ত যেতে অনেক দিন সময় লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাওয়াই হয় না। যে নিগ্রহ চোখে দেখা যায়, শরীরের ক্ষত রেখে যায় তাকে চেনা সহজ। রোজ মার খেতে খেতে একদিন কোনো নারী পুলিশের কাছে চলে যান হয়তোবা। প্রচণ্ড গালিগালাজ, বা পণ সংক্রান্ত নিপীড়নের একটা সহ্যের সীমা থাকে।
পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেল কেন?
গত ৭ মাসে পারিবারিক সহিংসতায় ৩২২জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৩৩জন নারী। পারিবারিক সহিংসতা কি হঠাৎই বেড়েছে? কেন? এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে নিজেদের মতামত জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষ৷
এই সরকার যখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন ধারা সংশোধন করে শাস্তি কমিয়ে দিচ্ছে, তখন অন্যায়ের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। যেমন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আগে শারীরিক সম্পর্ক করলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এই সরকার এটা কমিয়ে ৭ বছর কারাদণ্ড করে দিয়েছে। যৌতুকের ধারাগুলোও সংশোধন করা হয়েছে। এসব কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
নারীদের উপর নির্যাতনকে এই সরকার কখনো মব, কখনো ন্যায্য ক্ষোভ বলছে: নুজিয়া হাসিন রাশা, শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বলছে, অভ্যুত্থানের পর নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। অথচ এই অভ্যুত্থান নারীদের হাত ধরেই হয়েছে। টার্নিং পয়েন্টে নারীরা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এখন নারীরাই সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত। নারীদের উপর নির্যাতনকে এই সরকার কখনো মব, কখনো ন্যায্য ক্ষোভ বলছে। ফলে এরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এই সরকার নারীদের কর্তৃত্বের জায়গায় রাখেনি। বৈষম্য বিরোধী যে কন্ঠস্বর, সেটা দিনে দিনে নাই হয়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
এমন পদক্ষেপ দেখছি না যে কারণে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হবে, ফলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে: নূর খান লিটন, মানবাধিকার কর্মী
সমাজে সব ধরনের অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব স্তরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। দৃশ্যমান এমন কোনো পদক্ষেপ দেখছি না যে কারণে মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হবে। ফলে পারিবারিক সহিংসতাসহ অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
মূলত বিচারহীনতার কারণে যে কোনো অপরাধ বাড়ে, তার প্রতিফলন আমরা দেখছি: তাসনিম আফরোজ ইমি, শিক্ষার্থী
এক বছরে বিচারব্যবস্থা বা আইন-শৃঙ্খলার যে অবস্থা, সেকারণে পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতন বলেন, সেটা বেড়ে যাচ্ছে। এই সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। মূলত বিচারহীনতার কারণে যে কোনো অপরাধ বাড়ে, তার প্রতিফলন আমরা দেখছি। অস্থিতিশীল পরিস্থিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকেন নারীরা। মব, বিচারহীনতা, আইনশৃঙ্খলা সবকিছুই একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত। বর্তমান সরকারের সক্ষমতা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে।
ছবি: Samir/DW
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা কমতে থাকবে: জামিউল আহসান সিপু, সাংবাদিক
নারীর প্রতি পুরুষের, পুরুষের প্রতি নারীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়ার কারণে পারিবারিক সহিংসতা বা নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেই পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা অপেক্ষাকৃতভাবে কমতে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
ছবি: Samir/DW
নারীরা বর্তমানে আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন: মামসুরা আলম, ছাত্রদল নেত্রী
নারীদের প্রতি সহিংসতা বা পারিবারিক সহিংসতা অন্য যে কোনো ধরনের অপরাধের থেকে আলাদা। নারীরা বর্তমানে আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এই কারণে যেমন পরিবারে, তেমনি বাইরেও মবের শিকার হচ্ছেন, হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। কয়েকদিন আগেও দেখলাম একজন নারীর পোশাক ধরে কয়েকজন পুরুষ টানাটানি করছে, সেটা আবার ভিডিও করা হচ্ছে। আশপাশে শত শত মানুষ, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছে না। এসব কারণেও নারীরা আরো বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ছে।
ছবি: Samir/DW
পথে-ঘাটে নারীকে পেটাচ্ছে, সরকার যেন চুপ করে তাকিয়ে আছে: শরীফা বুলবুল, সাংবাদিক
মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের মধ্য দিয়ে যে নারীত্বের অবমাননা হয়েছে, এখনও যেন সেই অবস্থা চলছে। এটা না থামার কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা। এ যাবৎ কোনো নারী নির্যাতনের সঠিক বিচার আমরা পাইনি। এই সরকারের আমলে বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে নারীরা। পথে-ঘাটে নারীকে পেটাচ্ছে, সরকার যেন চুপ করে তাকিয়ে আছে। আমরা এখন রাস্তায় বের হতেই ভয় পাচ্ছি।
ছবি: Samir/DW
আর্থিক অচ্ছলতা এবং অনেক বেশি মোবাইলে আসক্তির কারণে অনেক পরিবারে অশান্তি হচ্ছে: মো. হানিফ, গার্মেন্টস কর্মী
আর্থিক অচ্ছলতার কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের হাতে টাকা নেই, আর টাকা না থাকার কারণে পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। এর সঙ্গে আছে মোবাইল ফোন। অনেক বেশি মোবাইলে আসক্তির কারণেও অনেক পরিবারে অশান্তি হচ্ছে।
ছবি: Samir/DW
কোনো ধরনের শাস্তির নজির না থাকার কারণে নারী নির্যাতন এত বেড়ে গেছে: তানজিলা তাহসীন, সাংবাদিক
শুধু তো নারী নয়, শিশুরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় দায় প্রশাসনের। কোনো ঘটনাতেই প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কোনো ধরনের শাস্তির নজির না থাকার কারণে নারী নির্যাতন এত বেড়ে গেছে। নারীর পোশাক নিয়ে কটুক্তির কারণে যাকে গ্রেপ্তার করা হলো, তাকে আবার জেল থেকে বের হওয়ার পর ফুলের মালা দেওয়া হচ্ছে। লঞ্চ ঘাটে দুই নারীকে বেল্ট দিয়ে পেটানো হচ্ছে। অথচ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থাই নিলো না।
ছবি: Samir/DW
এই সরকারের সময় আইনের শাসন বলতে কিছু নেই: অনিকা বিনতে আশরাফ, শিক্ষার্থী
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে। নারীর উপর প্রভাব বিস্তার করার প্রবণতা থেকেও নির্যাতন হচ্ছে। এই সরকারের সময় আইনের শাসন বলতে কিছু নেই। এখানে যে কেউ চাইলেই মব সৃষ্টি করতে পারছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই হচ্ছে না। এইসব কারণে নির্যাতনকারীরা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Samir/DW
10 ছবি1 | 10
কিন্তু যে অত্যাচার দৃশ্যত নীরব, তার খেয়াল কে রাখে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারীর জীবনের গল্প টেনে এনে এই অচ্যাচারের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করব। বাড়ির ছোটমেয়ে। পড়াশুনায় ভালো। স্নাতকোত্তর স্তরে ডিস্টিংশন পেয়ে, বিএড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন একটা হাই স্কুলে চাকরি পেলেন তখন বিয়ে হলো। স্বামীর চাকরি হায়দ্রাবাদে। ফলে চাকরি তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
তখন আশির দশক। স্বামী অত্যন্ত যত্নশীল। বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান। তার চাকরিতে আপত্তি স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির সবারই। তা-ও সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় এবং খানিকটা জেদে আবার একটি স্কুলে চাকরি পেলেন। স্বামীর ট্রান্সফারের চাকরি। শ্বশুর, শাশুড়ি, সন্তানসহ সারা ভারত ঘুরতে গিয়ে থিতু হয়ে চাকরি করা হলো না কৃতী এই নারীর।
অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়াই যে তার লক্ষ্য ছিল শ্বশুরবাড়িতে তা বারবার বলেও লাভ হয়নি। কেবলমাত্র চাকরিতে মানা, তাই নয়, এই নারীর স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলতেন শ্বাশুড়ি। কী পোশাক পড়বেন, কোথায় যাবেন, স্বামীর সঙ্গে নিভৃতে কতটা সময় কাটাবেন, এই সব বিষয়ে মন্তব্য করতে ছাড়তেন না বাড়ির বড়রা। স্বামী যত্নশীল হলেও বাবা মায়ের মন্তব্যকে 'মৃদু শাসন' ধরে নিয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন মেনে নিতে। 'কী আর এমন বলেছে? সংসারে একটু মানিয়ে গুছিয়ে তো নিতেই হয়,' বলেছিলেন নারীর মা।
স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রায় ৪০ বছর সংসার করার পর আপাত সুখী সেই নারী গুরুতর মানসিক হীনমন্যতার শিকার হন। ডিপ্রেশন এমন মাথা চাড়া দেয় যে মনস্তত্ববিদের সাহায্য নিতে হয় দীর্ঘদিন। সেই মনস্তত্ববিদ জানান, এই নারীর স্বাধীন চেতনা অবদমিত হতে হতে মনের ভিতর ক্ষত তৈরি হয়েছে। তিনি এই ঘটনাক্রমকে এক প্রকার 'পারিবারিক হিংসা' বলেন। হতবাক এই নারী এবং তার স্বামী আকাশ থেকে পড়েন। যাকে তারা 'হিংসা' হিসেবে চিহ্নিত করেননি তার জেরে এই মুহূর্তে নিয়মিত চিকিৎসাধীন এই নারী।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যে দশটি কাজ করতে পারেন
বিশ্বের সবদেশেই কমবেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইম্যান নারীদের সুরক্ষায় সহায়তার দশটি উপায়ের কথা জানিয়েছে৷
ছবি: Daniel Mihaulescu/AFP/Getty Images
ভুক্তভোগীর কথা শুনুন
একজন নারী সহিংসতার শিকার হওয়ার পর মুখ খোলার অর্থ হচ্ছে, তিনি সেই সহিংস পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছেন৷ তখন সমাজের সবার উচিত তিনি যাতে তার কথা বলতে পারেন, সেরকম নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা এবং তার কথা শোনা৷ এক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার নারীর পোশাক, যৌন পরিচয় বা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নিয়ে কথা বলার মাধ্যমে ভুক্তভোগীকেই দায়ী করার চেষ্টার বিপরীতে অবস্থান নিতে হবে৷
ছবি: Maurizio Gambarini/dpa/picture alliance
পরবর্তী প্রজন্মকে শেখান
আমরা পরবর্তী প্রজন্মের সামনে যে উদাহরণগুলো তৈরি করবো সেগুলো ভবিষ্যতে লিঙ্গ, সম্মান এবং মানবাধিকার বিষয়ে তাদের মনোভাব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে৷ যেসব প্রচলিত ধ্যানধারণায় ভুল আছে, সেগুলো সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করতে হবে৷ তাদের মধ্যে যে যেমন, তাকে সেভাবে গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করতে হবে৷ পাশাপাশি পৃথিবী সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের মতামতও শুনতে হবে৷
ছবি: Aref Karimi/DW
ভুক্তভোগীর সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করুন
সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তি যাতে দ্রুত সহায়তা পেতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে৷ দ্রুত সহায়তা বলতে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, হটলাইন, পরামর্শের মতো বিষয়গুলো, যাতে ভুক্তভোগীর নাগালের মধ্যে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. May
সম্মতির বিষয়টি বুঝতে হবে
একজন মানুষ মুক্তভাবে এবং উৎসাহের সাথে সম্মতি দিচ্ছেন কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে৷ যৌনতায় একজন নারী সম্মতি দিচ্ছেন কিনা সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে৷ ‘‘সে এটা চেয়েছিল’’ বা ‘‘ছেলেরা এমনই’’ এ ধরনের কথাবার্তা বলে একজন নারীর সম্মতি প্রদানের বিষয়টি এড়ানোর সুযোগ তৈরি করা যাবে না৷
নিগ্রহের নানা রূপ আছে এবং নির্যাতনের কারণে ভুক্তভোগীর উপর মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক প্রভাব পড়তে পারে৷ আপনার যদি মনে হয় যে, আপনার কোনো বন্ধু নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাহলে তাকে সহায়তার চেষ্টা করুন৷ আপনার যদি মনে হয় কেউ আপনাকে নিপীড়ন করছে, তাহলে তা প্রতিরোধে সহায়তা নিন৷
ছবি: Imago Images/Panthermedia
আলোচনা করুন
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, যা দশকের পর দশক ধরে ঘটছে৷ এই চর্চা বিস্তৃত হলেও অবধারিত নয়, যদি আমরা চুপ না থাকি৷ ফলে নারীর প্রতি সহিংতার বিপরীতে শক্তভাবে অবস্থান নিন৷
ছবি: Frank Hoermann/Sven Simon/imago images
প্রতিবাদ করুন
ধর্ষণ সংস্কৃতি হচ্ছে এমন এক সামাজিক পরিবেশ, যেখানে যৌন সহিংসতাকে স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ যুগ যুগ ধরে চলে আসা লিঙ্গ-বৈষম্য আর লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক ভ্রান্ত ধারণার কারণে বিষয়টি এমন হয়েছে৷ ধর্ষণ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সবার উদ্যোগী হতে হবে৷
ছবি: Christin Klos/dpa/picture alliance
নারী বিষয়ক সংগঠনগুলোকে সহায়তা করুন
নারী অধিকার এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করা স্থানীয় সংগঠনগুলোকে সাধ্যমতো সহায়তা করতে পারেন৷ জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেন এই বিষয়ক স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে৷
ছবি: Asif Hassan/AFP/Getty Images
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন
কর্মক্ষেত্রে বা জনপরিসরে যৌন নিপীড়নসহ সহিংসতা নানাভাবে ঘটতে পারে৷ আপনার সামনে আপত্তিকর কিছু ঘটলে প্রতিবাদ করুন৷ এভাবে সবার জন্য নিরাপদ একটি পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করতে পারেন আপনি৷
ছবি: Beata Zawrzel/NurPhoto/picture alliance
পরিসংখ্যান দেখুন এবং আরো দাবি করুন
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হলে বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে৷ আর এজন্য এ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত জানলে সে অনুযায়ী উদ্যোগী হওয়া সম্ভব
ছবি: Michael McCoy/Reuters
10 ছবি1 | 10
সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ
দৃশ্যত নীরব মানসিক অত্যাচার এই উদাহরণে শেষ হয় না। বরং এই রকমের সহিংসতার হিমশৈলের চূড়ার ইঙ্গিত দেয়।
মানসিক নিপীড়নের আলোচনা আমরা যাও বা করতে শুরু করেছি, সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থেকে যায় বিয়ের আগে নিজের বাড়িতেই পারিবারিক সহিংসতার সঙ্গে 'মানিয়ে নেওয়ার' বিষয়টি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, উপরোক্ত উদাহরণে উচ্চশিক্ষিত এক নারী 'সাংসারিক কারণে' তার উপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা মেনে নিলেন কেন? এর সহজতম উত্তর, ছোটবেলা থেকে নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয়ার পাঠ দেয় আমাদের সমাজ।
ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকেই কন্যা সন্তানদের উপর এক রকম বৈষম্য এবং গণ্ডির ঘেরাটোপ থাকে। কন্যাসন্তানদের উপর পরিবারের পুরুষদের, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বাবার যৌন নির্যাতনের ঘটনাও বার বার সামনে এসেছে। সেই নিপীড়ন খালি চোখে দেখা যায়। অন্যদিকে, ক্রমাগত বৈষম্য, আপোষ এবং 'মানিয়ে নেওয়ার' শিক্ষা, নিজের ইচ্ছাকে দমন করার পাঠ যে আদতে একপ্রকার মানসিন নিপীড়ন তা আমরা বুঝতে পারি না। একটি নারীকে শিশুকাল থেকে শেখানো হয় তাকে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়ার আগে সংসারকে প্রাধান্য দিতে হবে। ফলে, তার অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছেই হোক বা সন্তান গ্রহণ বা না গ্রহণের সিদ্ধান্তই হোক -- বৃহদাংশেই তা পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত।
তার শরীরে এবং মনে যে একমাত্র তারই অধিকার বর্তায় তার কোনো ইঙ্গিত সমাজ দেয় না। ছোটবেলায় মাছের বড় টুকরো তার ভাই পাবে আর বিয়ে হয়ে গেলে বাড়ির পুরুষদের খাওয়া হয়ে গেলে তবেই খেতে বসবেন। এটাই দস্তুর। শিশুকাল থেকে নিজের বাড়িতে এই 'মানিয়ে নেওয়ার' পাঠ আসলে পরবর্তীকালে পারিবারিক সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলে। এর ফলে সহিংসতা সহ্য করার চৌকাঠ এতটাই উঁচু হয়ে যায় যে, শারীরিক আঘাতের আগে বেশিরভাগ নারী বুঝতেই পারেন না তিনি মানসিক ভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। ফলে পারিবারিক সহিংসতা পেরিয়ে থানা, পুলিশ, কমিশন করতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
বাড়িতেই সবচেয়ে কম নিরাপদ নারীরা
জাতিসংঘের একটি গবেষণা জানিয়েছে, ২০১৭ সালে অর্ধেকেরও বেশি নারী খুন হন পরিবারের কোনো সদস্যের হাতেই৷ বর্তমানে নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক নিজেদের বাড়িই৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/S. Moraes
পরিবারেই বিপদ...
জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনওডিসি’র একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই ৮৭ হাজার নারীকে হত্যা করা হয়েছে৷ এর ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার হত্যাই সংগঠিত হয়েছে মৃত নারীদের পরিবারের কোনো সদস্যের দ্বারা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/N. Pisarenko
ঘরের শত্রু...
২০১৭ সালে মোট ৩০ হাজার নারী খুন হয়েছেন তাদের সঙ্গী বা ভালোবাসার মানুষের হাতে৷ জাতিসংঘের তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রতি ঘন্টায় ছয়জন নারী নিজের পরিচিত মানুষের হাতে খুন হন৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
ক্ষমতার অসাম্য
শুধু নারী মৃত্যুর হার বা কারণই নয়, এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য৷ পরিবারের ভেতরে নারী সব সময় পুরুষের তুলনায় কম ক্ষমতার অধিকারী হবার কারণেই বেশি অত্যাচারিত হয়৷ এর কারণ হিসাবে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে লিঙ্গবৈষম্যকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. R. Caivano
সবচেয়ে বেশি যেখানে...
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, নারীরা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয় অ্যামেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলিতে৷ পরিবারের সদস্যদের হাতে নারীদের নিহত হবার সংখ্যাও এই দুই মহাদেশে সর্বোচ্চ৷
ছবি: Imago/Agencia EFEE. Guzman
সবচেয়ে কম যেখানে...
প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, ‘‘নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রুখতে কঠোর আইন ও নীতি থাকা সত্ত্বেও তা পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না৷’’ তবুও ইউরোপের দেশগুলিতে তুলনামূলকভাবে এই প্রবণতা সবচেয়ে কম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NurPhoto/A. Pitton
সমস্যার মোকাবিলা
নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়েছে এই প্রতিবেদন৷ পাশাপাশি, নারীর সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের সরকারকে দ্রুত বিচার করতেও পরামর্শ দেয় এই রিপোর্ট৷
ছবি: UNFPA Nicaragua/Joaquín Zuñiga
পুরুষদের ভূমিকা
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে পরামর্শ হিসাবে বলা হয়েছে, উন্নত আইনব্যবস্থা, সামাজিক নীতি-বদল ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কথা৷ এই সব ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফলাফল পেতে হলে পুরুষদেরও উদ্যোগী হতে হবে বলে প্রতিবেদনটি জানায়৷
ছবি: Imago/ZUMA Press
7 ছবি1 | 7
পারিবারিক সহিংসতা এবং পুরুষ
ভারতে প্রোটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স (পিডাব্লিউডিভি) অ্যাক্ট নারীদের সুরক্ষা দেয়। কেবলমাত্র স্ত্রী-ই নন মা, বোন, বাড়ির বিধবা নারী, লিভ-ইন পার্টনার এমনকি আশ্রিতাও এই আইনের সুরক্ষা পেতে পারেন। তবে শাশুড়িরা এই আইনের সুরক্ষা পান না। এবং পান না পুরুষরা।
পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে এই লেখা শেষ করার আগে এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংখ্যায় কম হলেও এই সহিংসতার পরিসংখ্যানে জায়গা করে নিয়েছেন পুরুষরাও। বিশেষ করে নাবালকরা। লিঙ্গ নির্বিশেষে শিশুকাল থেকে পরিবারের লোকজন, এমনকী বাবা মায়ের হাতেও নানারকম নিপীড়নের শিকার হয় শিশুরা। সম্প্রতি, কলকাতার একটি এনজিও স্বয়ম একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে, এই নিপীড়ন বহুগুণ বেড়েছে কোভিড-কালের লকডাউনের সময় থেকে। শারীরিক নিগ্রহ, মাত্রাতিরিক্ত শাসন, সন্তানের জীবনে নিরন্তর নজরদারিসহ বিভিন্ন বিষয় অপরিবর্তনশীল ট্রমা সৃষ্টি করে শিশুমনে। বিশেষজ্ঞরা একে নেটাল ফ্যামিলি ভায়লেন্স বলে চিহ্নিত করেছেন। এই সহিংসতার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় সন্তান তৃতীয় বা প্রান্তিক লিঙ্গের হলে।
ভারতে বৈষম্য, নিপীড়ন সহ্যের সীমা বেশি। পারিবারিক সহিংসতার পরিসংখ্যান কোনো ব্যতিক্রমী চিত্র দেয় না। বহুদিনের সংগ্রামের ফলে নারীকে সুরক্ষিত রাখার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দেশ। আইন এসেছে। সচেতনা বাড়াতে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংস্থা। বাস্তব না বদলালেও মূলধারার আলোচনায় ঢুকে পরেছে পারিবারিক সহিংসতার মতো বিষয়গুলি। তবে মনের উপর হিংসার বীজ বপন নিয়ে এখনো আমরা উদাসীন। যে নিপীড়ন গায়ে না, মনে কালশিটে রেখে যায়, তার ক্ষত যেমন সহজে দেখা যায় না, তেমন সহজে উপশমও হয় না। সহিংসতার পুঁথিগত পাঠে সেই ব্যাথা আমরা যেন ভুলে না যাই।