স্কুলের পরীক্ষা হচ্ছে, অথচ নম্বর নিয়ে চিন্তা নেই৷ প্রোমোশন পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই ঠিক করে, তারা কোন বিষয় কীভাবে শিখবে৷ জার্মানির বোখুম শহরের ভিডার স্কুলে সে এক নতুন ধরনের পড়া৷
বিজ্ঞাপন
বোখুম-এর ভিডার স্কুলে টিফিনের ছুটি৷ এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় কতো নম্বর পেল, পরের ক্লাসে প্রোমোশন পাবে কিনা, সে সব নিয়ে মাথা না ঘামিয়েই পড়াশুনা করতে পারে৷ তারা নিজের থেকেই শেখে, নিজের গরজে এবং নিজের দায়িত্বে৷ শিক্ষক হলেন তাদের গাইড – তিনি এমন সব প্রস্তাব দেন, যেগুলো ছাত্রছাত্রীরা কাজে লাগাতে পারে – আবার ইচ্ছে না হলে নয়৷ সব সত্ত্বেও এই সব ছাত্রছাত্রী স্কুলের পড়া শেষ করে ফাইনাল পরীক্ষা দেয় এবং পাশ করে৷ লেখাপড়া করার মজাটা তারা ভোলে না, কেননা তারা দেখে, তারা অসহায় নয়, তাদের মর্জির একটা দাম আছে৷ স্কুল উপদেষ্টা মিশায়েল হারসলেম বলেন:
‘‘শিশুদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হল যে, তারা দেখবে, তারা স্কুলে এবং লেখাপড়ায় নিজেরাই সক্রিয় ও কার্যকরী৷ এই কার্যকারিতার অর্থ যে, আমি দেখছি, আমার সক্রিয়তার ফলে কিছু একটা ঘটছে৷ শিশুদের জন্য এটা গোড়া থেকেই খুব প্রয়োজনীয় যে তারা দেখবে: আমি যদি এখানে সচেষ্ট হই, তাহলে আমি কিছু একটা করতে পারি, বদলাতে পারি৷ আমি যত অনুশীলন করব, ততই আমি ভালো হবো৷''
সবাই শেখে নিজের মতো করে
ক্লাস ওয়ানের ছেলে-মেয়েরা কারিগরি ক্লাসে তরোয়াল তৈরি করতে শেখে৷ এখানে তারা খেলার ছলে সব কায়দাকানুন, রীতিনীতি শেখে৷ দেখা যায়, প্রতিটি শিশুর কাজ করার ধরন আলাদা৷ এই বৈচিত্র্য থেকেই শেখার আনন্দটা বেঁচে থাকে, বলেন মিশায়েল হারসলেম: ‘‘শেখার আনন্দটা বাঁচিয়ে রাখার সেরা পথ, ছোটদের তাদের নিজেদের মতো করে শিখতে দেওয়া৷ তার অর্থ, শিক্ষক হিসেবে আমাকে ক্লাসে নানা ধরনের শেখার পদ্ধতি অ্যালাউ করতে হবে – যা বহু শিক্ষকের পক্ষে সমস্যাকর হয়ে দাঁড়ায়৷''
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
নিজের শেখার পদ্ধতিটা আবিষ্কার করার অর্থ, পাঠ্য বিষয় অনুধাবন করার নিজস্ব উপায় উদ্ভাবন করা; নিজের কার্যক্রম উদ্ভাবন করা – যেমন হয়তো একটা ভিডিও ফিল্ম তৈরি করা৷ ভিডার স্কুলের ওয়ার্কশপগুলোয় ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই খুঁজে বার করে, তারা কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে চায়৷ এই পন্থায় তারা নিজেরাই ঠিক করে, তারা কী শিখবে৷ হারসলেম বলেন:
‘‘আসলে সব ছাত্রছাত্রীরাই জানে, তারা কী শিখতে চায় – যদি তাদের কী শেখা উচিত, সেটা আমরা বড়রা বলে কিংবা বেঁধে না দিই৷ ওদের স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ ও কৌতূহল হলো এই বিশ্বকে নিয়ে, কেননা ছোটরা চিরকালই দুনিয়াটাকে চিনতে চায়, আবিষ্কার করতে চায়৷ এবং সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই একটা ধারণা আছে, সে বিশ্বটাকে কীভাবে আবিষ্কার করবে৷ এবং আমি যদি তার অনুমতি দিই, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দ করেই শেখে৷''
শিক্ষার বাই-প্রোডাক্ট
ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের খুঁজে নিতে দিলে তারা যে গাছপালা লাগানো, ছবি আঁকা কিংবা গল্প লেখার মতো ‘বিষয়' পছন্দ করবে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ কিন্তু তা থেকে কি কিছু শেখার আছে? ও সব করে কি ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যে-বুদ্ধি বাড়বে? হারসলেম-এর মত হলো: ‘‘জ্ঞানটা হল শিক্ষার একটা বাই-প্রোডাক্ট, শিক্ষা থেকে উপজাত একটা ফসল৷ অপরদিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজের জন্যে শেখার কতগুলো কৌশল বার করা এবং খেয়াল রাখা, কোন কৌশলগুলো আমার সঙ্গে খাপ খায়, কোন কৌশল দিয়ে আমি অজানা বিশ্বের কয়েকটা অচেনা এলাকা জয় করতে পারি৷''
সাধারণ পড়াশুনার বিষয়গুলিতেও নিজের শেখার কৌশল কাজে দেয়৷ এক্ষেত্রে কী এবং কতটা শিখতে হবে, তা বলে দেওয়া আছে বটে; তা সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য বিষয়টির সঙ্গে খানিকটা নিজেদেরই পরিচিত হতে হয়৷ শিক্ষক যদি ছাত্রছাত্রীদের তাদের নিজেদের আগ্রহ অনুযায়ী পড়াশুনা করার অনুমতি দেন, তাহলে আশ্চর্য সব ব্যাপার-স্যাপার ঘটতে পারে৷ যেমন রুশ ভাষা শেখার ক্লাসে৷ হারসলেম শোনালেন সে কাহিনি:
‘‘ছাত্রছাত্রীরা টেলিভিশনে রুশ পপ গোষ্ঠী পুসি রায়ট-এর খবর শুনেছে এবং সে বিষয়ে আরো জানতে চায়৷ শিক্ষকের সেটা কাম্য না হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছাত্রছাত্রীদের তা করতে দেন – ছাত্রছাত্রীরা পুসি রায়ট-কেই প্রোজেক্ট হিসেবে বেছে নেয়৷ এবং সেটা পাঠ্যবইতে যা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি শক্ত রুশ ভাষায়! এবং এই অনেক বেশি শক্ত টেক্সট তারা নিজেরাই আগ্রহ করে শিখেছে৷ সেক্ষেত্রে ওরা সাধারণ পাঠ্যক্রমের চেয়ে অনেক বেশি নতুন শব্দ ও ব্যাকরণ শিখেছে৷''