সীমান্ত হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ আর ভারত যৌথ তদন্তের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা সতর্ক৷ তাঁদের কথায়, ভারত অতীতে সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি, কমেনি সীমান্ত হত্যা৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের জীবননগর উপজেলার নতুনপাড়া সীমান্তে স্কুলছাত্র শিহাব উদ্দিন সজলকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ১৪ই মে সাতজন বিএসএফ সদস্যকে ‘সাসপেন্ড' করা হয়৷ ভারতের কৃষ্ণনগর ১১৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট মাহেন্দ্র কুমার বানপুর হালদারপাড়া কোম্পানি কমান্ডার ইন্সেপেক্টর অনুভব আত্রাইয়াসহ ঐ সাত বিএসএফ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তের এ আদেশটি দেন৷ এ ঘটনায় বিএসএফ-এর মহাপরিচালক কে কে শর্মাও দুঃখ প্রকাশ করেন৷
এরপর ১৬ই মে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর মধ্যে ছয় দিনব্যাপী সম্মেলন শেষে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ জানান, ‘‘বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে হত্যার ঘটনায় দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যৌথভাবে তদন্ত করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে৷''
বিশ্বের কয়েকটি বিপজ্জনক সীমান্ত
দুই দেশের মধ্যে সীমানা নিয়ে যুদ্ধ কিংবা উন্নত জীবনের আশায় এক দেশের নাগরিকের প্রতিবেশী দেশে যাওয়া – ইত্যাদি কারণে বিশ্বের কয়েকটি সীমান্ত বিপজ্জনক বলে পরিচিত৷ ছবিঘরে থাকছে সেগুলোর কথা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত
এই সীমান্তের ৪০টি ‘স্পর্শকাতর’ অংশে ‘লেজার’-এর বেড়া দেয়া হবে বলে জানিয়েছে ভারত৷ পাকিস্তান থেকে ভারতে অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ এর ফলে বেড়ার সংস্পর্শে কিছু আসলে উচ্চস্বরে সাইরেন বেজে উঠবে৷ ২০১১ সালের জুনে ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮০০ মাইল দীর্ঘ এই সীমান্তে নিহত হয়েছে এক লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ৷ প্রতিবেদনটি পড়তে উপরে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে ৪৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে৷ আহত হয়েছে ৭৩ জন৷ এছাড়া অপহরণ করা হয়েছে ৫৯ জনকে৷ কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত শিগগিরই বেড়া দেয়ার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানান৷
ছবি: Str/AFP/Getty Images
যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত
উন্নত জীবনের আশায় মেক্সিকো থেকে প্রতিবছর অনেক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন৷ আর তা করতে গিয়ে প্রাণ যায় অনেকের৷ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, গত ১৪ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ৬,০০০ এর বেশি লোক নিহত হয়েছে৷ প্রতিবেদনটি পড়তে উপরে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Gordon Hyde
ভূমধ্যসাগর
যুদ্ধ আর সংঘাত এড়াতে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশ করছে৷ এদের একটি বড় অংশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে৷ এতে প্রাণ যায় অনেকের৷ জার্মান ম্যাগাজিন ‘ডেয়ার স্পিগেল’ গত অক্টোবরে এক প্রতিবেদনে ভূমধ্যসাগরকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত বলে আখ্যা দেয়৷ ২০১৫ সালে ভূমধ্যসাগরে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩,৭৭০৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Palacios
আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত
প্রায় দেড় হাজার মাইল দীর্ঘ ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে পরিচিত সীমান্ত এখনও মেনে নেয়নি আফগানিস্তান৷ পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখা রাজ্যের পশতুন অধ্যুষিত এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে আফগানিস্তান৷ এই সীমান্তকে ঘিরে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে৷
ছবি: Reuters
উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া
বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত সীমান্ত বলা হয় একে৷ ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রায় দেড়শো মাইল দীর্ঘ এই সীমান্তের দুই পাশ থেকে সৈন্যদের সরিয়ে দেয়া হয়৷ তখন থেকেই দুই দেশের সৈন্যরা প্রায় আড়াই মাইল প্রশস্ত এই সীমান্তের দুই পাশে অবস্থান করছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
6 ছবি1 | 6
সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলির বিষয়ে বিএসএফ মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, ‘‘ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা দেখা না দিলে বিএসএফ গুলি করে না৷ তবে কিভাবে এই গুলি করার বিষয়টি একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে৷''
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত তিন বছরে বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বেড়েছে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা৷ এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷ এছাড়া আরো একজনকে কিভাবে হত্যা করা হয়, তা জানা যায়নি৷
আসক জানায়, ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছিল ৩৩ জন বাংলাদেশিকে৷ এর মধ্যে গুলি ও নির্যাতন করে সমান সংখ্যক বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়৷ পরবর্তীতে, অর্থাৎ ২০১৫ সালে হত্যা করা হয় ৩৭ জনকে৷ এদের মধ্যে ২৫ জনকে গুলি এবং বাকিদের নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল৷
ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ-এর বৈঠকে এ কথাো জানানো হয় যে, গতবছরের ১লা আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত বিএসএফ-এর গুলিতে মোট ২৪ জন বাংলাদেশি নিহত হন৷
সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে নূর খান
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সীমান্ত হত্যার তদন্ত দুই দেশ যৌথভাবে করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে স্বাগত জানাই৷ তবে এখনও আস্থা রাখতে পারছি না৷ কারণ এর আগেও ভারত সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করাসহ আরো অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ কিন্তু তার কোনোটারই বাস্তবায়ন হয়নি, সীমান্ত হত্যা কমেনি৷''
তাই তিনি বলেন, ‘‘যৌথ তদন্তের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াটি বোঝো এবং বাস্তবে যে কাজটি শুরু হয়েছে তা দেখেই মন্তব্য করতে চাই৷ আমরা চাই যেভাবেই হোক সীমান্তে নিরীহ মানুষ হত্যা বন্ধ হোক৷''
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কথায়, ‘‘এই যৌথ তদন্তের বিষয়টি আমরা কার্যকরভাবে দেখতে চাই৷ অতীতের নানা প্রতিশ্রুতির মতো এটাও যেন শুধুমাত্র একটা প্রতিশ্রুতি হয়েই থেকে না যায়৷''
প্রসঙ্গত, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ অবশ্য সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের যৌথ তদন্ত কিভাবে হবে, যৌথ তদন্ত দল কীভাবে কাজ করবে, তা বিস্তারিতভাবে জানাননি৷ তাছাড়া এই যৌথ তদন্ত কবে থেকে শুরু হবে, তাও স্পষ্ট নয়৷
ভারতের সিদ্ধান্তে সমস্যায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মানুষ যেন গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয় সেজন্য ভারত থেকে বাংলাদেশ গরু পাচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
সীমান্তরক্ষীদের নতুন দায়িত্ব
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত পাহারা দেয়ায় নিয়োজিত প্রায় ৩০ হাজার ভারতীয় সৈন্যকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ সেটা হলো, ভারতীয় গরু যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে পৌঁছতে না পারে৷ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিএসএফ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন যেন ‘বাংলাদেশের মানুষ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়’৷
ছবি: Str/AFP/Getty Images
গরু পবিত্র
হিন্দুদের কাছে গরু একটি পবিত্র প্রাণী৷ তাই ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করতে চায়৷ রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘ আরএসএস এর পশ্চিমবঙ্গের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘গরু জবাই কিংবা চোরাই পথে চালান, আর হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করা বা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা একই কথা৷’’
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
চার যুগের ইতিহাস
ভারত থেকে চোরাই পথে আসা গরুই এতদিন বাংলাদেশের মানুষের মাংসের প্রধান উৎস ছিল৷ গত চার দশক ধরে সেটা হয়ে আসছে৷ এর সঙ্গে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য জড়িয়ে আছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
দাম বেড়ে গেছে
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গরুর মাংস রপ্তানিকারক বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব গত জুলাই মাসে রয়টার্সকে জানান, ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাঁর কোম্পানির মাংস রপ্তানি প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Asia News Network/Jofelle P. Tesorio
চাকরি হারিয়েছে প্রায় ৪,০০০
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শাহীন আহমেদ জানিয়েছেন, জুন পর্যন্ত চামড়া শিল্পে কর্মরত প্রায় চার হাজার কর্মীর চাকরি গেছে৷ আর ১৯০টি ট্যানারির মধ্যে ৩০টি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
ভারতীয় গরুর মাংস ভালো
বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব বলেন, তিনি এখন নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে মাংস আমদানির চিন্তা করছেন৷ কিন্তু ভারতীয় মাংস ও চামড়ার মান ভালো বলে জানান তিনি৷ উল্লেখ্য, ভারত গরুর মাংসের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভারতের সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন মাংসের জন্য বাংলাদেশকে নতুন উৎস খুঁজে বের করতে হবে কেননা ভারত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে৷