বাংলাদেশে যৌনরোগী কত, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ একমাত্র এইডস বা এইচআইভি আক্রান্তদের ব্যাপারে একটি সরকারি পরিসংখ্যান আছে৷ এই পরিসংখ্যান না থাকার অন্যতম কারণ গোপনীয়তা৷ যৌনরোগকে আমাদের সমাজ যে আজও নিন্দার চোখে দেখে!
বিজ্ঞাপন
[No title]
আমাদের সমাজে যৌন রোগে আক্রান্তদের ‘খারাপ চোখে' দেখা হয়৷ তাই যারা এমন রোগে আক্রান্ত হন, তারা নিজেরাও রোগটা প্রকাশ করেন না৷ অনেক সময় চিকিৎসাই করান না৷ আবার কোনো কোনো চিকিৎসকও রোগিদের অপ্রয়োজনীয় নানা বিব্রতকর প্রশ্ন করেন, ফলে বিষয়টি নিয়ে রাখঢাক থেকেই যায়৷
রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়া এলাকায় রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি৷ সেখানে সরকারি হিসেবে এ মুহূর্তে ১,৫০০ জন যৌনকর্মী আছেন৷ তাদের চিবিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই৷ তবে বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকটি এনজিও কাজ করে এদের নিয়ে৷ ‘পিয়াকট' নামের এরকমই একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার সহকারী প্রোগ্রাম অফিসার শেখ রাজিব ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘যৌনকর্মীদের একটি অংশ সিফিলিস এবং গনোরিয়ার মতো যৌন রোগে আক্রান্ত হন৷ তবে এইডস বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত হওয়ার রেকর্ড এখনো নাই৷ এমনকি সরকারি উদ্যোগে এটা পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি৷ যা কিছু পরীক্ষা হয়েছে, সবই বেসরকারিভাবে৷''
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
যৌনকর্মীরা তাই শুধুমাত্র এনজিও-র মাধ্যমে যৌনরোগ প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের কিছু চিকিৎসা পেয়ে থাকেন৷ তাদের কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় নিয়মিত৷ অবশ্য তাদের যৌনরোগের বিরুদ্ধে সচেতন করার কাজেই এনজিওগুলো গুরুত্ব দেয়৷ এর মধ্যে অন্যতম হলো ক্লায়েন্টকে আগে চেক করা এবং সে যদি যৌনরোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে গ্রহণ না করা৷
শেখ রাজীব জানান, ‘‘এই যৌনপল্লিতে ক্লায়েন্ট আসে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে৷ তাদের বড় একটা অংশ সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো যৌনরোগে আক্রান্ত৷ এখানে রোগ ধরা পরার পর তারা এখানকার স্থানীয় চিকিৎসকদের কাছেই চিকিৎসা নেন৷''
দৌলতদিয়া এলকার যৌনপল্লির আশেপাশে প্রায় ৭০টির মতো ওষুধের দোকান বা কাম চিকিৎসা কেন্দ্র আছে৷ এইসব দোকান থেকে যৌনকর্মীরা যেমন চিকিৎসা নেন, তার বাইরেও প্রচুর সংখ্যক সাধারণ যৌনরোগীও সেখানে চিকিৎসা নেন৷ ‘পিয়াকট'-এর প্রোগ্রাম অফিসার শাহ আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এখানে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ যৌনরোগীরা দেশের নানা এলাকা থেকে আসেন৷ নিজ এলকায় তারা লজ্জায় চিকিৎসা করান না৷ তবে এ থেকেই বাংলাদেশে যৌনরোগীদের সংখ্যা নিয়ে একটা ধারণা করা যায়৷''
বাংলাদেশে একমাত্র এইডস বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছাড়া অন্য ধরনের যৌনরোগীর সংখ্যা কত – তা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা নেই৷ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘যৌনরোগীরা সাধারণত তাদের রোগের কথা প্রকাশ করতে চান না৷ কেউ কেউ গোপনে চিকিৎসা করান, আবার কেউ কেউ চিকিৎসা করানই না৷ ফলে এই রোগে আক্রান্তদের যেমন সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তেমনি অনেকে চিকিৎসা না করিয়ে এই রোগ ছড়াতে ভূমিকা পালন করেন৷''
বাংলাদেশের এইডস পরিস্থিতি
একটা সময় ছিল যখন এইডস রোগের নাম শুনলেই মানুষ ভয় পেত৷ এখন সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ বাংলাদেশে এইডস প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে৷
ছবি: AP
প্রথম রোগী
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়৷ এইচআইভি-র কারণে সৃষ্ট এই রোগটি শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়৷ ফলে একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে-কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন – যা শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হাজার পেরিয়ে গেছে
বর্তমানে বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা ১,২৯৯৷ পরিসংখ্যানটা অবশ্য ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সংগৃহীত৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নিজেই চলতি বছরের জুনে সংসদকে এই তথ্য জানিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা
এইডস রোগীর সংখ্যা ১,২৯৯৷ কিন্তু এইচআইভি বা ‘হিউম্যান ইমিউনোডেফিশিয়েন্সি ভাইরাস’-এ আক্রান্তের সংখ্যা ৩,২৪১৷ ২০১৩ সালের ১লা ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবসের এক অনুষ্ঠানে এই তথ্য জানানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিহতের সংখ্যা
ঐ একই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসচিব জানান এইডসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত ৪৭২ জন মারা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিকিৎসা সেবা
আশার আলো সোসাইটি, মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ কনফিডেনশিয়াল অ্যাপ্রোচ টু এইডস প্রিভেনশন (ক্যাপ) নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান এইডস আক্রান্তদের ‘অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল’ বা এআরভি ওষুধ সহ অন্যান্য সেবা দিচ্ছে৷ সরকার ও ‘দ্য গ্লোবাল ফান্ড’-এর কাছ থেকে ওষুধ কেনার অর্থ পায় এই তিন সংস্থা৷
ছবি: AP
সরকারি সেবা
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জুন মাসে জানান আটটি সরকারি হাসপাতালে ‘সিডি-৪’ সেন্টারের মাধ্যমে এইডস রোগীদের শারীরিক অবস্থা নির্ণয় করাসহ এ সব প্রতিষ্ঠানসমূহে রোগীদের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ‘কাউন্সেলিং’ সেবা দেয়া হচ্ছে৷ অবশ্য সেটা ঠিক নয় বলে ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন ‘মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ’-এর নির্বাহী পরিচালক এম এস মুক্তি৷
ছবি: AP
6 ছবি1 | 6
বাংলাদেশে এইডস রোগী
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার এখনও শতকরা ০.১ ভাগের নীচে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১ শতাংশেরও কম৷ ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে এইচআইভি-তে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৯ জন আর মৃত্যু হয়েছে ৯৫ জনের৷ এছাড়া ১৯৮৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত, মানে ১৪ বছরে, মোট এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ১৪৩ জন এবং পরে এইডস রোগ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫৬৯ জনের৷
যারা এইচআইভি-তে নতুন সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের শতকরা ৭৩ ভাগ পুরুষ, ২৫ ভাগ নারী এবং দু'ভাগ ট্রান্সজেন্ডার৷ অন্যভাবে এইচআইভি আক্রান্ত ৩১ শতাংশ অভিবাসী অথবা অতীতে অভিবাসী ছিলেন এমন মানুষ৷
ঢাকায় ‘আশার আলো' নামে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের কাজ করে৷ জানা গেছে, তারা এ পর্যন্ত ২৫ জনকে পুনর্বাসন এবং দু'হাজারেরও বেশি আক্রান্তকে চিকিৎসা দিয়েছেন৷ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক হাবিবা আক্তার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এইডস আক্রান্তরা আমাদের সমাজে এখনো নিন্দিত৷ তাই তাদের গোপনেই চিকিৎসা করা হয়৷ যারা আক্রান্ত হন, তারাও গোপন তা রাখেন৷ যদি কোনোভাবে পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়, তাহলে তাদের সমস্যা হয়৷ অনেককে তো বাড়ি এবং এলাকাও ছাড়তে হয়েছে এর ফলে৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘বাংলাদেশকে এইডসমুক্ত করতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে৷ তার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্তদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল হতে হবে৷ এ জন্য অবশ্য সরকার ইতিমধ্যেই ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ নিয়েছে৷''
বাংলাদেশে যৌন শিক্ষা
পাঠ্যপুস্তকে যৌন স্বাস্থ্যের বিষয়টি ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছে সরকার৷ কিন্তু যৌন শিক্ষা পড়ানো নিয়ে সমস্যা হচ্ছে৷ শিক্ষকরা এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, ছাত্র-ছাত্রীরাও বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছে না৷ কী বলছে আজকের তরুণ সমাজ?
ছবি: DW/K. Andrade
ফারজানা খানম
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী ফারজানা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হচ্ছে যা থেকে যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়৷ এ শিক্ষা প্রত্যেকের জীবনে প্রয়োজন৷ বাচ্চাদের পরিবার এবং শিক্ষকরা এটা শিখাতে পারেন৷ এছাড়া যৌনতা সম্পর্কে তাদের জানার উৎস হতে পারে পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধব৷ তাছাড়া ইন্টারনেট থেকেও যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়, জানান ফারজানা৷
ছবি: DW
নাফিসা হক অর্পা
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্রী নাফিসা হক অর্পা৷ নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন সম্পর্কে জ্ঞানকেই যৌন শিক্ষা৷ নাফিসার কথায়, ‘‘আমাদের সময়ে ইন্টারনেট এত সহজলভ্য ছিল না৷ তখন বন্ধু, সহপাঠী, আত্মীয়স্বজনরাই ছিলেন মূল ভরসা৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটাকে ট্যাবু হিসেবে না দেখে একে শিক্ষার অংশ করা উচিত৷ এতে করে যৌন বিষয়ক অপরাধ কমবে৷
ছবি: DW
জান্নাতুল ফেরদৌস কনক
নাফিসার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন জান্নাতুল ফেরদৌস কনক, তবে তিনি পড়ছেন পঞ্চম সেমিস্টারে৷ তাঁর মতে, যৌনতা হচ্ছে বয়সের পরিবর্তনে শারীরিক এক ধরণের চাহিদা৷ আগে এ নিয়ে সীমাবধ্যতা থাকলেও, এখন ছেলে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ের যৌন সম্পর্কও বেশ জনপ্রিয়৷ ‘‘বন্ধুদের আড্ডায় এটাই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়’’, জানান কনক৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার দরকার না থাকলেও এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি৷
ছবি: DW
ইমরান খান
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ইমরান খান৷ তিনি যৌন শিক্ষা বলতে যৌনতা সম্পর্কে সব ধরণের ধারণাকে বোঝেন৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা সবার জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়৷ আর এ কথাটা শিশুদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য৷ তবে ইমরানের কথায়, ‘‘সঠিক যৌন শিক্ষা স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, পরিবার থেকেই গড়ে উঠতে পারে৷’’
ছবি: DW
কেডিএস সাকিব
বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাফিসা আর কনকের মতো মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছেন সাকিব, পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো যৌন মিলনের উপর জ্ঞান৷ তবে শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই বন্ধুদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জেনেছেন তিনি৷ সাকিবের মতে, পর্যাপ্ত যৌন শিক্ষা অবশ্যই দরকার৷ যৌনতা সম্পর্কে তাঁর জানার মূল উৎস বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ এবং এ সম্বন্ধে লিখা বিভিন্ন বই৷
ছবি: DW
মাহবুব টিপু
নাফিসা, কনক, সাকিব আর ফারজানার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন মাহবুব টিপু৷ অবশ্য তিনি এখনও দ্বিতীয় সেমিস্টারে৷ যৌন শিক্ষা তাঁর কাছে যৌনতা সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে৷ এ বিষয়ে জানার সবচেয়ে বড় জায়গা বন্ধু-বান্ধব৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো সবারই কম-বেশি জানা থাকে৷ তারপরও এ বিষয়ে শেখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম বিভিন্ন ওয়েবসাইট৷
ছবি: DW
সামিয়া রহমান
সামিয়া রহমানও মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ যৌন শিক্ষা বলতে তিনি বোঝেন নারী ও পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞান৷ তাঁর কথায়, ‘‘যৌন শিক্ষা আমাদের দেশে নিষিদ্ধ একটি বিষয়ের মতো৷ তাই এ বিষয়ে আমি শিক্ষা পায়নি৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা খুবই জরুরি৷ এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় অনেকেই ভুল পথে চলে যায়৷ তাই বাবা-মায়েরও এ বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা উচিত৷
ছবি: DW
নাফিউল হক শাফিন
টিপু আর সামিয়ার মতো অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মাস কমিউনিকেশন বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাফিউল৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা জীবনের জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে জানা এবং যৌনতার সঠিক প্রয়োগ ও সতর্কতাকে বোঝায়৷ তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু শেখেননি৷ তবে এই শিক্ষাটা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার জন্য বড় কেউ কিংবা সহপাঠীরাই বড় মাধ্যম৷
ছবি: DW
মালিহা রহমান
মালিহা রহমানও ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো শারীরিক সম্পর্কের হাতে কলমে শিক্ষা৷ অবশ্য তাঁর কথায়, যৌন শিক্ষা একটা স্বাভাবিক বিষয় যেটা মানুষ থেকে শুরু করে সব প্রাণীই প্রাকৃতিকভাবে জানে৷ তাঁর মতে, এ বিষয়ে আগে থেকে জানার কিছু নেই, নেই ভালো কোনো দিক৷ যখন এ বিষয়ে জানার প্রয়োজন হবে তখন এমনিতেই তা জানা যাবে৷
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
চিকিৎসা
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাতটি মেডিক্যাল কলেজসহ মোট ১২টি সরকারি হাসপাতালে এইচআইভি রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ও এইচআইভি আক্রান্তদের বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণসহ বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে৷ এছাড়া কয়েকটি এনজিও-র মাধ্যমে এইচআইভি আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে৷
২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে এইচআইভিমুক্ত দেশে পরিণত করতে সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে৷ এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সিলিং, আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য পজেটিভ লিভিং কাউন্সিলিং, পুষ্টি, চিকিৎসা এবং সাধারণ কাউন্সিলিংয়ের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ স্থাপন করা হয়েছে ন্যাশানাল এইডস কন্ট্রোল সেন্টারও৷''
অন্যদিকে সব সরকারি হাসপাতালেই চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগ নামে আলাদা একটি বিভাগ খোলা হয়েছে৷ ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান জানান, ‘‘হাসপাতালের আউটডোরে আমরা যেসব রোগী পাই, তাদের মধ্যে যৌনরোগীর সংখ্যা অনেক কম৷ কিন্তু যৌনকর্মী, তাদের ক্লায়েন্ট এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট পেশার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে যৌনরোগে আক্রান্তের হার অনেক বেশি৷''
প্রশ্ন হলো, যৌনরোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. খান বলেন, ‘‘একদিকে সামাজিক লজ্জা, অন্যদিকে কিছু চিকিৎসকের আচরণ৷ অতীতে এমনও হয়েছে যে যৌনরোগের চিকিৎসা করাতে গেলে চিকিৎসকরা রোগীদের কান ধরে উঠ-বস করাতেন৷ নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে রোগীদের বিব্রত করতেন৷ তবে এই প্রবণতা নানা ধরনের প্রচারের কারণে এখন অনেক কম৷''
এইসব কারণেই বাংলাদেশে যৌনরোগের অপচিকিৎসা বেশি৷ মঘা, ইউনানী ও স্বপ্ন চিকিৎসার কথা বলে এবং ‘প্রাইভেট চিকিৎসার' নামে এই অপচিকিৎসা চলছে৷ এমনকি যৌনরোগী নয় এমন রোগীকেও যৌনরোগী বানিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশে৷''
ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বলেন, ‘‘যৌনরোগের জন্য রোগী নিজে যে সব সময় সরাসরি দায়ী নয়, তা মানুষকে জানতে হবে জানাতে হবে৷ তাছাড়া এই রোগকে আর দশটা রোগের মতোই বিবেচনা করতে হবে৷ তাহলেই প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ভাঙবে৷''
পিয়াকট-এর প্রোগ্রাম অফিসার শাহ আলম বলেন, ‘‘আমরা সচেতনতার পাশাপাশি কনডম ব্যবহারে উৎসাহিত করছি মানুষকে৷ প্রথমে বিষয়টি বাঁকা চোখে দেখা হলেও, এখন ধীরে ধীরে অবস্থা বদলাচ্ছে৷''
আপনার প্রতিবেশী কোনো যৌন রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর প্রতি আপনার ব্যবহার কী হবে? জানান নীচের ঘরে৷