তুরস্কের আইনমন্ত্রী বলেছেন যে, সরকার শিশুদের যৌননিপীড়নকারীদের যৌন তাড়না ‘কমাতে বা নির্মূল করতে' চায়৷ তবে যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চোখে ‘নির্মম'৷
বিজ্ঞাপন
তুর্কি সরকার মঙ্গলবার ঘোষণা করে যে, সংসদে একটি নতুন আইন আনা হবে, যার বলে বিচারকরা শিশু নিপীড়নকারীদের কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন, অর্থাৎ রাসায়নিক নপুংসকরণের নির্দেশ দিতে পারবেন৷
আইনমন্ত্রী আবদুলহামিত গুল বলেন, যে ব্যক্তিদের শিশুদের যৌন নিপীড়নের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তাদের যৌন তাড়না ‘কমানো বা নির্মূল করার জন্য' এই পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে৷ সরকারি আনাদোলু সংবাদ সংস্থার খবর অনুযায়ী, আইনের খসড়াটি কয়েক দিনের মধ্যেই সাংসদদের কাছে উপস্থাপন করা হবে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন৷
দশ বছর আগের তুলনায় ২০১৬ সালে তুরস্কের বিভিন্ন আদালতে চারগুণেরও বেশি শিশু যৌন নিপীড়নের মামলা ওঠে বলে আইন মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি জানিয়েছে৷ ২০০৬ সালে শিশুদের যৌন নিপীড়নের মোট ২১,১৮৯টি মামলা আদালতে ওঠে, যার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মামলায় অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়৷
Turkey: A torture victim speaks out
03:53
রাসায়নিক নপুংসকরণের যেসব ‘অ্যানাফ্রোডিজিয়্যাক' বা কামোদ্দীপনা হ্রাস করার ওষধি প্রয়োগ করা হয়, সেগুলি কামেচ্ছা ও যৌন সম্ভোগের ক্ষমতা সাময়িকভাবে কমাতে পারে বটে, কিন্তু তার ফলে যৌন কামনা স্থায়ী বা পুরোপুরিভাবে নির্মূল হয়ে যায় না৷ ফলে প্রতি তিন মাস অন্তর ওষুধ খেতে হয় বা ইনজেকশন নিতে হয়৷
‘উওমেন্স অ্যাসেম্বলিজ অর্গানাইজেশন' নামের একটি মহিলা সম্মেলন সমিতি এই পদক্ষেপকে ‘মানবাধিকারবিরোধী' ও ‘আধুনিক আইনকানুন বহির্ভূত দণ্ড' বলে অভিহিত করেছে৷
অতীতেও উদ্যোগ রুখে দেওয়া হয়েছে
২০১৬ সালে যৌন অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের রাসায়নিক নপুংসকরণের আরেকটি উদ্যোগ রুখে দেন তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালত ‘কোর্ট অফ স্টেট'৷ সংশ্লিষ্ট আইনের খসড়ায় রাসায়নিক নপুংসকরণের সংজ্ঞা বা সীমা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা হয়নি বলে আদালত অভিমত প্রকাশ করেন৷
একটি সাম্প্রতিক ঘটনার পর জনতার রোষ ও শিশুদের যৌন নিপীড়ন সংক্রান্তঅপরাধীদের রাসায়নিক নপুংসকরণের দাবি আরো জোরদার হয়েছে৷ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সূচনায় এক ২০ বছর বয়সি পুরুষ একটি তিন বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে৷ ঘটনাটি ঘটে দক্ষিণের আদানা প্রদেশের একটি বিয়েবাড়িতে উৎসব চলার সময়৷ সরকারি কৌঁসুলি সংশ্লিষ্ট অপরাধীর ৬৬ বছর কারাদণ্ড দাবি করেছেন বলে আনাদোলু সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে৷
যেসব জনপ্রিয় তারকারা যৌন হয়রানির শিকার
শৈশবে যৌন নির্যাতন-এমন একটি ঘটনা যা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিটির মনে সারাজীবনে প্রভাব ফেলে৷ অনেক তারকার জীবনে এ ঘটনা ঘটলেও অল্প কয়েকজনরই তাদের অভিজ্ঞতা জানানোর সাহস পেয়েছেন৷ এমনই কয়েকজনের কথা তুলে ধরা হলো এখানে৷
‘বে ওয়াচ’ আর ‘প্লেবয়’ পত্রিকার অতি জনপ্রিয় নাম পামেলা অ্যান্ডারসন৷ ১০ বছর বয়সে তাঁর বেবি সিটার পামেলাকে যৌন নির্যাতন করে৷ এরপর মাত্র ১২ বছর বয়সে পামেলার বান্ধবীর এক বড় ভাই-ও তাঁকে ধর্ষণ করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেরিলিন মনরো
হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর শৈশব কেটেছে একটি এতিমখানায়৷ আর সেখানেই বহুবার যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে৷
ছবি: picture alliance/Heritage Images
লেডি গাগা
জনপ্রিয় পপ সংগীত শিল্পী লেডি গাগা জানিয়েছেন, ১৯ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তিনি৷ এই ঘটনাকে নিজের গান ‘সোয়াইন’-এ তুলে ধরেছেন তিনি৷ তার চেয়ে ২০ বছরের বড় সেই ধর্ষণকারী একজন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক, যাকে পরবর্তীতে দেখলে গাগা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যেতেন৷ অনেক থেরাপি নেয়ার পর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পান লেডি গাগা৷
ছবি: Reuters/L. Nicholson
অনুরাগ কাশ্যপ
না কেবল নারী তারকারাই নন, পুরুষ তারকারাও ছেলেবেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ এমনই একজন বলিউডের বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ৷ ১১ বছর ধরে টানা তাঁর উপর যৌন নির্যাতন চলেছিল বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি৷ তবে সেই দুঃস্বপ্নকে পেছনে ফেলে অচিরেই সামনে এগিয়ে গেছেন অনুরাগ৷
ছবি: AP
ম্যাডোনা
বিশ্বখ্যাত পপ শিল্পী ম্যাডোনা ১৯ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ প্রথমবারের মতো নিউ ইয়র্কে এসে তিনি যে অ্যাপার্টমেন্টটি ভাড়া নিয়েছিলেন, সেখানেই এক ব্যক্তি তাংর মুখের সামনে ছুরি ধরে তাঁকে ধর্ষণ করে৷ সেই দুঃসহ স্মৃ্তি আজও ভুলতে পারেন না তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অপরাহ উইনফ্রে
টিভি সেলিব্রেটি অপরাহ উইনফ্রে মাত্র ন’বছর বয়সে পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিলেন৷ উইনফ্রেকে তাঁর ১০ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত টানা ধর্ষণ করেছে ঐ ব্যক্তি৷
ছবি: AP
সোফিয়া হায়াত
অভিনেত্রী সোফিয়া হায়াতের শৈশবও খুব একটা সুখকর ছিল না৷ তিনিও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন সেই শৈশবে৷ মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁর এক চাচা তাঁকে যৌন নির্যাতন করেছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
আনুষ্কা শংকর
প্রখ্যাত সেতার বাদক রবি শংকরের কন্যা আনুষ্কা শংকর সেতার বাজিয়ে আজ নিজেও বিশ্বনন্দিত৷ পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির দ্বারা সেই অনুষ্কাও যৌন হয়রানির শিকার হন৷ কিন্তু পরিবারের অতি বিশ্বস্ত হওয়ায় সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরিবারকে কিছু জানাতে পারেননি৷ এতে তাঁর শৈশবের দিনগুলো ছিল ভীষণ পীড়াদায়ক৷ এছাড়া তারকা হওয়ার কারণে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বই তাঁর স্পর্শকাতর অঙ্গ স্পর্শ করেছে বলে জানিয়েছেন আনুষ্কা৷
কাল্কি কোচেলিন
এনডিটিভি-র এক অনুষ্ঠানে অনেক তারকা যখন নিজেদের ছোটবেলার মধুর স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন, কাল্কি কোচেলিন তখন তুলে ধরেছিলেন নিজের জীবনের এক কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথা৷ ছোটবেলায় যৌন হয়রানির ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাঁকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় বলে জানিয়েছিলেন বলিউডের এই অভিনেত্রী৷ নারী অধিকার নিয়ে সর্বদা সোচ্চার কাল্কির অবশ্য স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে কোনোদিনই কোনো সংকোচ ছিল না, আজও নেই৷
ছবি: AP
9 ছবি1 | 9
আইনমন্ত্রী গুল-এর ঘোষণার আগের দিন তুর্কি সরকার শিশুদের যৌন নিপীড়নের সংক্রান্ত ঘটনার মোকাবিলার জন্য একটি কমিটি সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন৷
মঙ্গলবার অপর একটি উপলক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান শিশুদের যৌন নিপীড়নকারীদের ‘চরমতম শাস্তির' হুমকি দেন৷ দলীয় সাংসদদের একটি সম্মেলনে এর্দোয়ান শিশুদের যৌন নিপীড়ককে এমন একটি বিস্ফোরকের সঙ্গে তুলনা করেন, যা ‘‘সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে৷''
অপরাপর একাধিক দেশ শিশুদের যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাসায়নিক নপুংসকরণের ব্যবস্থা রেখেছে – যেমন রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷
এসি/এসিবি (এএফপি, এপি, ডিপিএ)
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?