সিরাজগঞ্জ জেলার ফুলকুচা এলাকার ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়৷ এই বিদ্যালয়ে ঘটে গেছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা৷ প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলটি স্বাস্থ্য বিশেষ করে যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে৷ কথায় বলে না, ‘শূন্য থেকে শুরু'?
বিজ্ঞাপন
আসলে স্কুলটিতে যৌন শিক্ষা আজ আর কোনো লজ্জার বিষয় নয়৷ প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা সহজেই তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন কখন, কী করতে হবে৷ কোন ধরণের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে৷ আর শিক্ষার্থীরা বুঝে গেছে বয়ঃসন্ধিকাল কাকে বলে৷ বুঝে গেছে এর লক্ষণ৷ এটা যে স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নিয়ম – তা আর তাদের এখন বুঝতে বাকি নেই৷ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রুবিনা ইয়াসমিন বললেন, ‘‘আমার মা-বাবাও এখন বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে কথা বলেন স্বাভাবিকভাবেই৷ আমিও আমার মাকে জানাই, কথা বলি৷''
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক সাইদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘শুরুতে অবশ্য বিষয়টি এত সহজ ছিল না৷ শিক্ষকরাও প্রথমে যৌন শিক্ষা বা প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়টিকে সহজেভাবে নিতে পারেননি৷ তাই তাদের আগে বোঝাতে হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, উপজেলা প্রশাসনকেও বোঝাতে হয়েছে৷ আর তাদের মাধ্যমেই স্কুলের টয়লেট এবং পানির সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এমনকি স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্যও ফান্ড দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন৷''
যৌনতা: অনন্তকাল ধরে বিতর্কিত
‘সেক্স’ কথাটা উঠলেই বিতর্ক শুরু হয়ে যায়৷ সেক্স নিয়ে যেমন বহু কেলেঙ্কারি, সেভাবেই যৌনতা নারীমুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বন শহরের একটি প্রদর্শনীতে জার্মান সমাজে যৌনতা নিয়ে বিভিন্ন ঝড়ঝাপটার একটা খতিয়ান দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নিষিদ্ধ’ বিষয়
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যৌনতা সংক্রান্ত মনোবৃত্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে৷ জার্মানিতে ‘ব্রাভো’-র মতো টিনেজার ম্যাগাজিনগুলিতে খোলাখুলি সেক্স সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷ এর আগে ফিল্মেও যা ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় ছিল, তাই নিয়েই তৈরি হয় ১৯৬৮ সালের হিট ছবি ‘সুয়র জাখে, শ্যাটসেন’ বা ‘পথে এসো, প্রেয়সী’৷ এখানে ছবির নায়ক-নায়িকা ভ্যার্নার এঙ্কে ও উশি গ্লাস; মাঝের মহিলাটি হলেন পরিচালিকা মাই স্পিল্স৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মা যা ছিলেন
পঞ্চাশের দশকেও দুনিয়াটা ‘ঠিকঠাক’ ছিল – অন্তত নবীন পশ্চিম জার্মানির নীতি-নৈতিকতা যাদের দায়িত্বে, তাদের চোখে৷ নারীর স্থান ছিল গৃহে, সংসারে, পতিব্রতা স্ত্রী, স্নেহময়ী জননী, নিপুণা গৃহকর্ত্রী হিসেবে৷ কাজে যেতেন শুধু পুরুষরা৷ জনসমক্ষে সেক্স নিয়ে কথা বলা কিংবা রাস্তায় চুমু খাওয়া চলত না৷ ব্যক্তিগত জীবন ও নৈতিকতা ছিল গির্জা বা সরকারের তাঁবে৷
ছবি: DW/H. Mund
আদম ও হবার কাহিনি
১৯৫১ সালের জার্মান ছবি ‘দি জ্যুন্ডারিন’ বা ‘পাপিনী’ জার্মান ফিল্ম জগতে কেলেংকারির অবতারণা ঘটায়৷ রক্ষণশীল চ্যান্সেলর কনরাড আডেনাউয়ার-এর আমলে এ ধরনের ‘নোংরামি’ সেন্সর করা উচিত, এই ছিল অধিকাংশ মানুষের অভিমত৷ ‘পাপিনী’ ছবির যৌনোদ্দীপনামূলক দৃশ্যগুলো ছিল অতি সংক্ষিপ্ত, তা সত্ত্বেও ছবিটিকে কেন্দ্র করে নৈতিকতা ও প্রকাশ্য যৌনতা নিয়ে বিপুল তর্ক শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: ullstein - Thomas & Thomas
নারীমুক্তি
শেরিং কোম্পানি যখন ১৯৬১ সালে প্রথম গর্ভনিরোধক ‘পিল’ বাজারে ছাড়তে শুরু করে, তখন জার্মানির গির্জায় গির্জায় ‘যুবসমাজের নৈতিক অধোপতন’ সম্পর্কে ভাষণ শোনা গেছে৷ পিল নেওয়ার ফলে মহিলাদের যৌন আসক্তির খবর বেরোয় পত্রপত্রিকায়৷ সব সত্ত্বেও, গর্ভনিরোধের নতুন উপায়গুলি মহিলাদের স্বনির্ধারণে সাহায্য করে৷
ছবি: DW/H. Mund
ছাত্র বিপ্লব, যৌন বিপ্লব
ষাটের দশকের শেষে জার্মানিতে যে ছাত্র বিপ্লব দেখা দেয়, তার সঙ্গে তথাকথিত ‘কাউন্টার কালচার’ বা বিকল্প সংস্কৃতিরও যোগ ছিল৷ সেই বিকল্প সংস্কৃতি – হিপি আমলের রূপরেখা অনুযায়ী – খোলা এবং স্বাধীন যৌনতায় বিশ্বাস করত, যার একটা প্রমাণ পাওয়া যায় ‘কমিউন ওয়ান’-এর মতো কুখ্যাত কলোনিতে স্ত্রী-পুরুষের একসঙ্গে বাস ও সহবাসে৷ যে কারণে রাইন্যার লাংহান্স এবং উশি ওবারমায়ার-এর মতো চরিত্র আজও অবিস্মৃত৷
ছবি: picture-alliance/KPA TG
যৌনশিক্ষা
৬৮-র ছাত্র বিপ্লব পশ্চিমে পরিবারজীবনের সংজ্ঞাই বদলে দেয়৷ তরুণ বাবা-মায়েরা নিজেদের ‘বাবা’ কি ‘মা’ বলে অভিহিত না করে, নাম ধরেই ডাকতে শুরু করেন৷ ১৯৬৯ সালে স্কুলের জীববিজ্ঞান ক্লাশে একটি যৌনশিক্ষার ‘মানচিত্র’ চালু করা হয়৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অর্থানুকুল্যে সৃষ্ট ‘হেলগা’ নামধারী একটি যৌনশিক্ষার ফিল্ম দেখতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হতো৷
ছবি: DW/H. Mund
মেইল-অর্ডার যৌনতা
‘বেয়াটে উজে’ বললেই জার্মানির শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ আজও বোঝেন: মেইল-অর্ডার সেক্স-শপ৷ যদিও সে-ধরনের দোকানে বাস্তবিক ঢোকার মতো সাহস আজও সকলের নেই – লোকলজ্জা বলে একটা কথা আছে তো৷ বেয়াটে উজে-র বাণিজ্যিক সাফল্যের সূচনা ১৯৪৮ সালে, যখন তিনি মহিলাদের গর্ভনিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেন৷ তার পরে আসে তাঁর মেইল-অর্ডার সেক্স-শপ৷
ছবি: imago
পশ্চিমের আগে পুব
সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষরা তাদের পশ্চিমের সতীর্থদের চেয়ে অনেক বেশি যৌন স্বাধীনতা ভোগ করেছেন৷ গোটা পূর্ব জার্মানি জুড়ে ছিল নিউডিস্ট ক্লাব৷ যৌনতার বিচারে পুবের মেয়েরা পশ্চিমের মেয়েদের চেয়ে বেশি ‘স্বাধীন’ ছিলেন, বাচ্চাদের সরকারি ডে-কেয়ারে জমা করে প্যান্ট-শার্ট পরে কাজে যেতেন৷ স্বাধীনতার অপরপীঠে ছিল রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা৷ যেমন এই সাইনটিতে পূর্ব জার্মানির মায়েদের ‘ধন্যবাদ’ জানানো হচ্ছে৷
ছবি: DW/H. Mund
‘বিকারগ্রস্ত সমাজ’
যে সব চিত্রপরিচালক সর্বপ্রথম সমকামিতা নিয়ে ছবি তৈরি করেন, রোজা ফন প্রাউনহাইম ছিলেন তাঁদের অন্যতম৷ ১৯৭১ সালে তিনি একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন, যার বক্তব্য ছিল: সমকামী নিজে বিকারগ্রস্ত নয়, বিকারগ্রস্ত হল তার সমাজ৷ এভাবেই তিনি জার্মানির ‘গে’ এবং ‘লেসবিয়ান’ সম্প্রদায়ের জন্য সম্মান ও সমানাধিকার আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগ-যুগান্তের সংস্কার
জার্মানিতে সমকামিতা ছিল একটি বিতর্কিত বিষয়, রাজনীতিকরাও যা নিয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন৷ আইনের যে সূত্র – ১৭৫ নং অনুচ্ছেদ – দু’টি পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করেছিল, সেই অনুচ্ছেদটি ১৯৬৯ সালে কিছুটা নরম করার পর, ১৯৯৪ সালে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়৷ কিন্তু – বিশেষ করে খেলাধুলার জগতে – সমকামীদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব আজও পুরোপুরি উধাও হয়নি৷
ছবি: DW/H. Mund
নারী না পুরুষ?
ট্র্যান্সভেস্টাইট আর্টিস্ট, ২০১৪ সালের ইউরোভিশন সং কনটেস্ট বিজয়ী কনচিটা ভুয়র্স্ট ওরফে টম নয়ভির্থ আজ একজন সেলিব্রিটি৷ দাড়ি-সম্বলিত, ইভনিং গাউন পরিহিতা কনচিটা ২০১৫ সালের ইউরোভিশন গানের প্রতিযোগিতায় উপস্থাপিকা ছিলেন৷ তা-তে কারো কোনো আপত্তি দেখা যায়নি – আপাতদৃষ্টিতে৷...
ছবি: DW/H. Mund
ইতিহাস
জার্মানির ‘ড্র্যাগ কুইন’ তথা টিভি হোস্ট লিলো ভান্ডার্স এই প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন৷ ‘নির্লজ্জ? পরিবর্তনের মুখে যৌন নৈতিকতা’ প্রদর্শনীটি চলবে ২০১৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি অবধি, বন শহরের ‘হাউড ডেয়ার গেশিস্টে’ বা ইতিহাস ভবনে৷
ছবি: DW/H. Mund
12 ছবি1 | 12
তবে বাংলাদেশের সব এলাকাতেই যে একইরকম চিত্র, তা কিন্তু নয়৷ বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মিরুখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেনের অভিজ্ঞতা ভিন্ন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাঠ্যপুস্তকে স্বাস্থ্য এবং যৌন স্বাস্থ্যের বিষয়টি এখন অন্তর্ভুক্ত হলেও, স্থানীয়ভাবে পাঠদানের ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় পড়তে হয়৷ প্রথমত শিক্ষকরা এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি৷ ছাত্র-ছাত্রীরাও বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছে না৷ তাছাড়া কখনো কখনো অভিভাবকরাও আপত্তি করেন৷ তাই অনেক শিক্ষক ক্লাসে এই বিষয়গুলো শেষ পর্যন্ত আর পড়ান না৷''
বাংলাদেশে ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুয়ায়ী, ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে পাঠ্যপুস্তকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে৷ শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নামের বইয়ে একটি অধ্যায় বরাদ্দও করা হয়েছে৷
সপ্তম শ্রেণির বইয়ে বিষয়গুলো এভাবে রাখা হয়েছে – আমাদের জীবনে বয়ঃসন্ধিকাল, শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন, ভ্রান্ত ভাবনা, নিরাপদ থাকার উপায়, ঝুঁকি ও নিরাপত্তা প্রভৃতি৷ এছাড়া এইডস ও এইচআইভি নিয়েও আলাদা অধ্যায় আছে৷
বাংলাদেশ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক টেক্সটবুক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র পাল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা প্রতিবছরই লেখাগুলো ‘আপডেট' করি৷ যদি কোনো ভুল থাকে, তা সংশোধন করি৷ নতুন বছরের বইয়ে স্বাস্থ্য এবং যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে আরো নতুন লেখা এবং তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি৷
‘ওয়েলনেস অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেল্থ' বিশেষজ্ঞ ডা. রিফাত লুসি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১১ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সাধারণত বয়ঃসন্ধিকাল৷ আমরা ১১ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত যদি ধরি, তাহলে তারা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৩ ভাগ৷ আর এদের জন্য যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা যে কোনো শিক্ষার মতোই সমান প্রয়োজন৷ এটা না থাকায় অনেকেই ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়, যা তাদের পরবর্তী জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ তাই এই শিক্ষা স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য খুবই প্রয়োজন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই শিক্ষা না থাকা মেয়ে বা ছেলে উভয়েরই অল্প বয়সে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷ এর বাইরে নানা রোগ সম্পর্কেও তারা সচেতন থাকে না৷''
শিক্ষা গবেষক এবং ‘বয়ঃসন্ধিকাল ও শিক্ষা' বইয়ের লেখক ফারহানা মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যৌনশিক্ষা একটি জরুরি বিষয়৷ বয়ঃসন্ধিকালে মেয়ে এবং ছেলে উভয়েরই নানা ধরণের শারীরিক পরিবর্তন আসে৷ তারা নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়৷ তাদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়৷ তারা এই পরিবর্তন নিয়ে তুলনা করে হতাশায় ভুগতে পারে৷ কিন্তু বিষয়টি যদি তাদের কাছে পরিষ্কার থাকে৷ তারা যদি জানে যে এটা স্বাভাবিক পরিবর্তন, তাহলে তাদের মধ্যে কোনো সংকোচ থাকবে না৷ তারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে৷''
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের দেশে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা কথা বা শিক্ষা না থাকায় বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েরা জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়৷'' তাই তাঁর মতে, ‘‘যৌন শিক্ষার সঙ্গে যদি ‘জেন্ডার' বিষয়টিও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে অনেক অপরাধও কমে আসবে৷ ‘ইভ টিজিং'-সহ নানা ধরনের যৌন হয়রানি কমবে৷ তবে শিক্ষা হতে হবে গল্পের মতো করে৷''
বাংলাদেশে পাঠ্য পুস্তকে যে যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা থেকে ফল পেতে আরো অনেক দূর যেতে হবে৷ কারণ একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী এরইমধ্যে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেছে৷ তারা পাঠ্যপুস্তক থেকে যৌন শিক্ষা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে৷ চালাচ্ছে নানা অপপ্রচারও৷
এ নিয়ে টেক্সটবুক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা অপপ্রচারে কান দেই না৷ কারণ দেশের মানুষের বড় একটি অংশ এখন বুঝতে পারছেন যে, কেন যৌন শিক্ষা প্রয়োজন৷ তাঁদের ভয় এবং লজ্জা ভাঙতে শুরু করেছে৷ তবে এর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রয়োজন৷''
অন্যদিকে ডা. রিফাত লুসি মসে করেন, ‘‘শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, সবাইকে এই শিক্ষা নেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে৷ মনে রাখতে হবে, যৌন শিক্ষা মানে যৌনতা নয়৷ যৌন শিক্ষা আমাদের স্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য৷’’
আপনি কি পাঠ্য-পুস্তকে যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে? জানিয়ে দিন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷