ইউরোপে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধির পর বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জার্মানি৷ এর ফলে বাল্যবিবাহের শিকাররা সুবিধা পেলেও বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির কারণগুলো থেকে যাবে৷
বিজ্ঞাপন
এপ্রিলের শুরুতে বার্লিনের মন্ত্রিসভা একটি প্রস্তাবিত আইনের ব্যাপারে একমত হয়েছে, যাতে জার্মানিতে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, বিয়ে শুধুমাত্র তখন আয়োজন করা যাবে যখন বর এবং কনে উভয়ের বয়সই কমপক্ষে আঠারো বছর হবে৷ বর্তমানে যে কোনো একজন সঙ্গীর বয়স কমপক্ষে ষোল বছর হলেই বিয়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে৷ সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র পারিবারিক আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হয়৷
প্রস্তাবিত নতুন আইনে বর বা কনে কারো বয়স ষোল বা সতের হলে বিয়ে দেয়া যাবে না৷ তবে এক্ষেত্রে বিশেষ ধারা রাখা হয়েছে, যেখানে কমবয়সি সঙ্গী যদি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেন, তাহলে সেই বিয়ে বৈধ হতে পারে৷
প্রস্তাবিত এই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে জার্মানিতে ২০১৫ সালে শরণার্থীদের প্রবেশের পর বেড়ে যাওয়া বাল্যবিবাহের হার নিয়ন্ত্রণ করা৷ আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালে জার্মানিতে ১,৪৭৫টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৩৬১টি ঘটনায় ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুরা ভুক্তভোগী৷
যেসব দেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ইউনিসেফ-এর ‘স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন’ রিপোর্টে বিভিন্ন দেশের বাল্যবিবাহের হিসাব রয়েছে৷ মেয়েদের বয়স ১৮ হওয়ার আগে বিয়ে হলে সেটিকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণনা করে ইউনিসেফ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/P. Hatvalne
নাইজার (৭৬%)
ইউনিসেফ বলছে, আফ্রিকার এই দেশটিতেই বাল্যবিবাহের হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷ সেখানে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৫৷ তবে এটি পরিবর্তন করে ১৮ করার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার পেছনে দরিদ্রতা একটি অন্যতম বড় কারণ হিসেবে কাজ করে৷ এছাড়া বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে সামাজিকভাবে যে হেনস্তার শিকার হতে হয়, তা এড়াতেও মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার৷
ছবি: picture alliance/Godong
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (৬৮%)
দ্বিতীয় স্থানে থাকা এই দেশটিতে মেয়েদের বিয়ে করার বা দেয়ার বৈধ সর্বনিম্ন বয়স ১৮৷ তবে বাবা-মা ১৩ বছর বয়সি মেয়েরও বিয়ে দিতে পারেন, যদি আদালত অনুমতি দেয় কিংবা মেয়েটি যদি গর্ভবতী হয়৷ বাবা-মায়ের অনুমতি সাপেক্ষে তার চেয়েও কমবয়সি মেয়েদের বিয়ে দেয়া বৈধ সেখানে৷
ছবি: Reuters
চাড (৬৮%)
২০১৫ সালের জুনে চাডের সংসদে পাস হওয়া অর্ডিন্যান্সে, মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৫ থেকে বাড়িয়ে ১৮ করা হয়েছে৷ এছাড়া বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িতদের জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/O.Cicek
মালি (৫৫%)
মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৬ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর৷ তবে শরিয়া আইন অনুযায়ী ১৬ বছরের কমবয়সি মেয়েদেরও বিয়ে দেয়া যেতে পারে৷ কমবয়সি মেয়েদের সাধারণত দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করে থাকে বেশি বয়সি পুরুষরা৷
ছবি: Joel Saget/AFP/Getty Images
বাংলাদেশ (৫২%)
মেয়েদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ১৮, ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১৷ তবে সম্প্রতি পাস হওয়া একটি আইনে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ বিবেচনায় ১৮ বছরের কম বয়সিদেরও বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বুর্কিনা ফাসো (৫২%)
২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি নারী, যাদের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে, তাদের সংখ্যা ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ইউনিসেফ৷ ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে৷ বুর্কিনা ফাসোতে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার ১০ শতাংশ৷ আর ১৮ বছরের কমবয়সিদের ক্ষেত্রে হারটি ৫২ শতাংশ৷
ছবি: Getty Images/P.Parrot
গিনি (৫২%)
মা-বাবা’র অনুমতি নিয়ে বা না নিয়ে ১৮ বছরের ছেলে কিংবা মেয়ে সেখানে বিয়ে করতে পারেন৷ দেশটিতে যার যতজন অল্পবয়সি স্ত্রী আছে তার সামাজিক মর্যাদা তত বেশি বলে ধরে নেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. von Trotha
দক্ষিণ সুদান (৫২%)
চরম দারিদ্র্য, যুদ্ধ, দেশের অস্থির পরিবেশ, শিক্ষিতের হার কম হওয়া, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগের অভাব - এসব নানা কারণে আফ্রিকার সবচেয়ে নবীন দেশটিতে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ অল্প বয়সি মেয়ে ও তাদের পরিবার মনে করে, বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/M.Elshamy
মোজাম্বিক (৪৮%)
মেয়েদের জন্য বিয়ের বৈধ সর্বনিম্ন বয়স ১৮৷ তবে পরিবারের সম্মতিতে ১৬ বছর বয়সিরাও বিয়ে করতে পারে বা তাদের বিয়ে দেয়া যায়৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/S.Mohamed
ভারত (৪৭%)
মেয়েদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ১৮, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১৷ দেশটিতে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের মধ্যে বিয়ের হার প্রায় ১৮ শতাংশ৷ ভারতের অনেক সমাজে মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে বোঝা মনে করা হয়৷ বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সেই বোঝা স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যায় বলে মনে করে অনেক পরিবার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/P. Hatvalne
10 ছবি1 | 10
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সংজ্ঞা অনুযায়ী, যে কোনো আনুষ্ঠানিক বিয়ে বা অনানুষ্ঠানিক সহবাস, যেখানে বর বা কনের একজন বা উভয়ের বয়স আঠারো বছরের নীচে, সেটি বাল্যবিবাহ হিসেবে বিবেচিত হবে৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘গার্লস নট ব্রাইডস-'এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মী সুন্দরমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর পনের মিলিয়ন মেয়ের বয়স ১৮ বছর পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়৷ গোটা বিশ্বে বাল্যবিবাহের শিকার নারীর সংখ্যা বর্তমানে সত্তর কোটি, সে তুলনায় পুরুষের সংখ্যা সাড়ে পনেরো কোটি৷
বাল্যবিবাহের কারণে একজন মেয়ে অল্প বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়৷ আর প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগে গর্ভধারণের কারণে নানারকম শারীরিক জটিলতার মধ্যে পড়ে নারী৷ মোটের উপর তাদের জীবনের অনেক সম্ভবনাও বাল্যবিবাহের কারণে শেষ হয়ে যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
জার্মানিতে বাল্যবিবাহ বন্ধের নতুন আইনকে স্বাগত জানালেও একটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন মিশায়েল৷ তিনি জানান, ষোল বছর বয়সি কেউ যদি জার্মানিতে আসেন, যিনি অন্য দেশে পনেরো বছর বয়সে বিয়ে করেছেন, তা হলে তাঁর বিয়ে জার্মানিতে স্বীকৃতি পাবে না৷ ফলে দেখা যাবে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখবে সেই দম্পতি৷ আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অল্পবয়সি মানুষটি, মনে করেন মিশায়েল৷