যৌন হয়রানি রোধে মাদ্রাসায় নারী মেন্টর
২৬ মে ২০১৯নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতারোধে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তের আলোকে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এই আদেশ জারি করেছে৷ আদেশে বলা হয়েছে:
১. যৌন হয়রানিসহ নারী ও শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে৷
২. প্রতিটি মাদ্রাসায় একজন নারী শিক্ষককে মেন্টর নিযুক্ত করে মাদ্রাসার ছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি করতে হবে৷
৩. পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত জেন্ডার সম্পর্কিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা, মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক ও পরিচ্ছন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে৷
৪. নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে যে সকল আইন, নীতিমালা ও হাইকোর্টের যে নীতিমালা আছে তা প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে৷
৫. ফ্রি হেল্পলাইন-১০৯ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে৷
২২মে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড এই নির্দেশনা জারি করেছে৷ এর আগে ১৯মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বিভাগ আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোতে নির্দেশনা জারির আদেশ দেয়৷
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম ছায়েফ উল্যা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু নারী মেন্টর নয়, তাঁর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করতে বলা হয়েছে যেখানে নারী শিক্ষকদের প্রাধান্য থাকবে৷ আইনে আছে শিক্ষকদের কমপক্ষে ৩০ ভাগ নারী হতে হবে৷ তাই এই কমিটি গঠন নিয়ে নারী শিক্ষকের সংকট হবেনা৷ যেসব মাদ্রাসায় ৩০ ভাগ নারী শিক্ষক নেই তারা যদি কোটা পূরণ না করে তাদের এমপিও বতিল করে দেয়া হবে৷''
মেন্টর ও কমিটির কর্মপরিধি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘কোনো প্রয়োজনে কোনো ছাত্রীকে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সরাসরি ডাকতে পারবেন না৷ তাঁকে মেন্টর ও কমিটির মাধ্যমে ডাকতে হবে৷ তাদের উপস্থিতিতে ওই ছাত্রীর সাথে কথা বলতে হবে৷ আর এটা শুধু প্রিন্সিপাল নয়, যদি কোনো শিক্ষকের মাদ্রাসায় আলাদা কক্ষ থাকে সেক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে৷ ছাত্রীরা কোনো ধরনের যৌন হয়রানি বা অশোভন আচরণের শিকার হলেও মেন্টর ও কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবে৷ তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবেন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ছাত্রীরা যাতে তাদের সমস্যার কথা বলতে পারে সেজনই এই নারী মেন্টর ও কমিটি৷ নারীদের কাছে নারীরা তাদের কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন৷''
এ কে এম ছায়েফ উল্যা বলেন, ‘‘ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছাত্রী নুসরাতকে যৌন হয়রানি করেছে৷ এরপর তাঁকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ এই ধরনের কমিটি আগে থাকলে এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটতো না বলে আমি মনে করি৷ আমাদের সিদ্ধান্ত হলো কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের যৌন হয়রানির প্রমাণ পেলে তাঁকে সরাসরি বরখাস্ত করে দেব৷ আমরা যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারি তাহলে এটা বন্ধ হবে৷''
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৯ হাজারেরও বেশি আলিয়া মাদ্রাসা আছে৷ আর এসব মাদ্রাসায় সহশিক্ষা প্রচলিত৷ মাদ্রসাগুলোতে ছাত্রী প্রায় ৫০ ভাগ৷ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘আমাদের নির্দেশের পর এরমধ্যে প্রায় সব মাদ্রাসায় কমিটি হয়ে গেছে৷''
মাদ্রাসাগুলো যা ভাবছে:
মোহাম্মদপুর বায়তুল ফজল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ৩০০ শিক্ষার্থী৷ তাদের মধ্যে ৫০ ভাগই ছাত্রী৷ আর ২৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ৭ জন নারী৷ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা গোলাম মাওলা পটোয়ারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা পত্রিকার মাধ্যমে এই নির্দেশনার কথা জেনেছি৷ তবে এখনো কোনো লিখিত আদেশ পাইনি৷ আমরা কমিটি গঠন করব৷ আর কমিটি গঠনের জন্য আমাদের নারী শিক্ষক আছেন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘যা পরিস্থিতি শুরু হয়েছে তাতে এধরনের কমিটি গঠন ছাড়া উপায় নেই৷ এই কমিটি হলে আমার মনে হয় ভালো হবে৷ আর সরকারি নির্দেশতো মানতেই হবে৷''
আর দক্ষিণের বরগুনা জেলার উত্তর কাঠালিয়া দখিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু সালাম মোহাম্মদ জমিরউদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা নির্দেশ পেয়েছি এবং এরইমধ্যে কমিটি গঠন করেছি৷ কিন্তু আমাদের মাদ্রাসায় কোনো নারী শিক্ষক না থাকায় পুরুষ শিক্ষক দিয়েই কমিটি করা হয়েছে৷ আশাপাশ থেকে কয়েকজন নারী তাদের সঙ্গে থাকবেন৷ এখন রমজানের বন্ধ৷ রমজানের পর আমরা ঠিক করবো কিভাবে কমিটি কাজ করবে৷''
কিন্তু, নারী শিক্ষক ছাড়া কিভাবে কমিটি হয় আর নারী শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক হলেও নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সরকারের আদেশ তাই আমরা কমিটি গঠন করে তালিকা পাঠিয়েছি৷ আর আমাদের পদ খালি নেই দেখে নারী শিক্ষক নিতে পারছি না৷ খালি হলেই নেব৷ কমিটিতে এমনিতে নারীদের নাম দিয়েছি৷''
তিনিও মনে করেন, ‘‘এই ধরনের কমিটি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে৷''
সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কমিটি করতে হবে:
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নারী মেন্টর ও কমিটি সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই করতে হবে৷ আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সেই সিদ্ধান্তই হয়েছে৷ মাদ্রাসাগুলোতে আগেই শুরু হলো৷ ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত যৌন হয়রানি প্রতিরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল৷ তবে তা অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই মানেনি৷
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আলমগীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আন্তঃমন্ত্রণালয় বেঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠন করতে হবে৷ মাদ্রাসাগুলোতে এরইমধ্যে কমিটি প্রায় হয়ে গেছে৷ আর মাদ্রাসার জন্য আমাদের একটা বাড়তি নির্দেশনা আছে৷ তাদের অবশ্যই ৩০ ভাগ নারী শিক্ষকের কোটা পূরণ করতে হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘নারীদের নেতৃত্বে এই কমিটিগুলো হলে যৌন হয়রানিসহ আরো অনেক সমস্যা সমাধান সহজ হবে৷ কারণ নারীরা নারীদের কাছে তাদের সমস্যা বা অভিযোগ সহজে বলতে পারেন৷''