একটা সময় ঋণ শোধ হলো৷ দীর্ঘ সৌদি প্রবাসে থাকার কারণে আরবি ভাষাটাও বলতে পারলাম ভালোই৷ ফলে ভালো কাজ জুটলো৷ আর অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকল৷
বিজ্ঞাপন
২০০৫ সালে ৫ ভাই-বোনের সংসারের অভাব ঘোচানোর তাগিদেই অনেক কষ্ট আর ঋণ করে পাড়ি দিয়েছিলাম মরুদেশ সৌদি আরব৷ দেশে থাকতে একটি পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে টুকটাক কাজ করতাম৷ প্রবাসে সে সুযোগ হয়ে পড়লো সীমিত৷
প্রথম দিকে প্রবাসে যা বেতন পেতাম সবই সংসারে মাসে মাসে পাঠিয়ে দিতাম৷ এরই মাঝে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারের পুরো চাপ আসে আমার উপর৷
প্রবাসের বাঙালিরা
কেমন আছেন প্রবাসে বাঙালিরা? কেমন লাগে প্রবাসে স্বজন ছাড়া থাকতে? দেশ নিয়ে কী বা তাঁদের চিন্তা? ডয়চে ভেলের সাথে দেখে আসা যাক বিভিন্ন দেশে থাকা বাঙালির জীবনযাত্রা, তাঁদের নিজেদের জবানিতে৷
ছবি: privat
আসাদুজ্জামান খান, চীন
প্রায় এক দশক হতে চলল, পথে-প্রবাসে৷ চীনে এসেছিলাম উচ্চশিক্ষার জন্যে৷ এরপর কর্মজীবনে প্রথমে চীন, তারপর ম্যাকাও, ভিয়েতনাম ঘুরে আবার চীনে৷ বর্তমানে কাজ করছি সিচুয়ান প্রদেশের লুঝৌ শহরের সাউথওয়েস্ট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে, ‘রিসার্চ প্রফেসর’ হিসেবে৷ সুবিশাল এবং বৈচিত্রময় চীনে কাটানো এতদিনের অভিজ্ঞতা জীবনের বিশেষ প্রাপ্তি বলেই আমি মনে করি৷ এখানকার মানুষের সততা, কর্মস্পৃহা আমাকে মুগ্ধ করেছে বরাবর৷
ছবি: privat
রফিক আহমদ খান, মালয়েশিয়া
বছরের পর বছর ভিসা-পাসপোর্ট ও আইনি জটিলতা এবং বহু প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেই ১৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় যাপন করছি প্রবাসজীবন৷ এই প্রবাসেও লেখালেখি করি প্রাণের টানে৷ লিখি মালয়েশিয়ায় প্রবাসী প্রায় দশ লাখ বাংলাদেশির সুখ-দুঃখের কথা৷ তুলে ধরতে চেষ্টা করি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সোয়া কোটি প্রবাসীর মনের কথা৷
ছবি: privat
শিপু ও শারমিন, লন্ডন
প্রবাস জীবনটা আমাদের কাছে বেশ ক্যালকুলেটিভ৷ কারণ প্রতিনিয়ত অনিশ্চিয়তা ঘিরে রয়েছে চারদিকে, বিশেষ করে আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য৷ পরিবার থেকে দূরে যান্ত্রিক জীবন হলেও কিছু সুবিধার জন্য কষ্টগুলো এক নিমিষে দূর হয়ে যায়৷ প্রবাস শিখিয়েছে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভরশীল হতে৷ বিপুল নাগরিক সুবিধাও রয়েছে৷ সে কারণেই আমাদের কাছে মনে হয় প্রবাস জীবন হচ্ছে প্রচণ্ড শীতের মাঝে এক টুকরো রোদের হাসি...!
ছবি: privat
জাহাঙ্গীর কবীর বাপপি, আরব আমিরাত
দু’দশক ধরে আছি আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে৷ ২০১২ সালে দেশটি বাংলাদেশিদের জন্য পযর্টন ভিসা বাদে সব ধরনের ভিসা এবং অভ্যন্তরীণ ভিসা ট্রান্সফার বন্ধ করে দেয়ায় আমরা বেশ বিপদে রয়েছি৷ চাই এ অবস্থার অবসান৷ এখানে থেকে শত সংকটের মাঝেও ভালো লাগে তখন, যখন দেশে রেমিটেন্স পাঠাই৷
ছবি: privat
আরিফুর রহমান, সৌদি আরব
পারিবারিক স্বপ্নপূরণের আশায় ২০০৮ সালে সৌদি আরব এসেছি৷ কম্পিউটারের কাজ জানা থাকলেও ভিসায় প্রভিশন ইলেকট্রিশিয়ান হওয়ায় অন্য কাজ করতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে৷ অনেক সময় রিয়াদের এক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও বেতন পাইনি৷ কপিল আকামা নতুন করে না দেয়ায় অবৈধ হতে হয়েছে৷ না খেয়ে সৌদির মরুভূমির রাস্তায় দিনাতিপাত করতে হয়েছে৷ এখন একটি ট্র্যাভেল কোম্পানিতে কাজ করছি৷ দেশ-মা-মাটিকে ভালোবাসি৷ মনে পরে সবকিছু...৷
ছবি: privat
মোয়াজ্জেম হোসেন তারা, প্যারিস
ঢাকার একটা কলেজে শিক্ষকতা করতাম৷ সমাজের পিছিয়ে পড়াদের আলোকিত করার স্বপ্ন দেখতাম৷ কিন্তু সমাজে গেড়ে বসা ধর্মান্ধদের জন্য স্বদেশ প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে এবং সেইসাথে আলোকিত সমাজ গড়ার স্বপ্নে বিভোর অসংখ্য তরুণ মেধা হারিয়ে ডুকরে কাঁদছে৷ প্রবাসে ভালো আছি৷ ধর্মান্ধের চাপাতির কোপ পড়ার আশঙ্কা নেই৷ তবে স্বদেশ আলোকিতের স্বপ্ন নিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়৷ যতদূরে থাকি না কেন প্রার্থনায় রয় জননী মাতৃভূমি তোমার মঙ্গল কামনা!
ছবি: privat
নাঈম আব্দুল্লাহ, অস্ট্রেলিয়া
১৯৯৫ সালের শেষ দিকে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে নিউজিল্যান্ড গিয়েছিলাম৷ আপেল বাগানে পিঠে ১৫ কেজির ঝুড়ি আর মই হাতে দৌড়ে আপেল পারার প্রতিযোগিতায় আমি মোটেই সিদ্ধহস্ত ছিলাম না৷ তাই ঐ কাজ ছেড়ে ট্যাক্সি ক্যাব চালাতাম৷ সুবিধা করতে না পারায়, পেলাম হাসপাতালে চাকরি৷ ২০০০ সালে চলে এলাম অস্ট্রেলিয়ায়৷ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে পেলাম ব্যাংকের চাকরি৷
ছবি: privat
মো. ফারুক হোসেন, ওমান
ভিনদেশে থেকে স্বদেশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না৷ জীবিকার তাগিদে বসবাস এখন ওমানে৷ মরুদেশের সাথে পলিমাটির বাংলার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর৷ আরব সাগরের ধারে খুঁজি কক্সবাজারের সৌন্দর্য্য, ওমানের পাহাড়-পর্বতে খুঁজি রাঙামাটি-বান্দরবন, খারিফ (বর্ষা) মৌসুমে সবুজ সালালায় পাই বাংলাদেশের ঘ্রাণ আর কৃত্রিমতায় ভরপুর দুবাই শহরে পাই যান্ত্রিক ঢাকার টান৷ জোড়াতালির এত মিলের পরও অমিলের হাহাকার থাকে বারো আনা৷
ছবি: privat
8 ছবি1 | 8
একদিন বাবা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সকাল বেলায় না খেয়ে এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে এক লাখে বছরে ৩০ হাজার টাকা সুদে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিলাম৷ বাকি ২ লাখ টাকা প্রবাসী বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে বাবাকে দেশে পাঠালাম৷
এদিকে ছোট ভাই-বোনের স্কুল কলেজের মাসিক ফি মাস শেষ হবার আগেই দিতে হতো৷
নিজেকে বিলিয়ে দিলাম কাজের মধ্যে৷ ঋণ শোধের চিন্তায় কত রাত যে নির্ঘুম কেটেছে৷ অপেক্ষা ছিল কখন শেষ হবে ঋণ৷ আর মর্মে মর্মে বুঝতে পারলাম ঋণ থাকলে প্রবাস জীবনটা কত যন্ত্রণার ও কষ্টের৷ মাসে মাসে যা বেতন পাই তার বেশিরভাগই ঋণ শোধ করতে বেরিয়ে যেত৷
এ সময়টা আগের মতো টাকা বাড়িতে দিতে পারতাম না বলে বাড়ির সবাই আমাকে নানা কথা বলতে লাগে৷ খুব খারাপ লাগতো তখন৷ শূন্য অনুভূতি হতো৷
অভিমানে মনে হতো দেশ ছেড়ে কেন একা একা জ্বলছি দূর প্রবাসে! আমি তো চেয়েছিলাম সবাইকে নিয়ে সুখে থাকতে৷ কী পেলাম আপনজনদের থেকে যন্ত্রণা ছাড়া? কাদের জন্য জীবনের অনেকগুলো বছর যন্ত্রণার প্রবাসে ঘাম ঝরিয়েছি৷ কাদের সুখের জন্য তবে কবর দিয়েছি সৌদি মরুতে আমার যৌবন!
একটা সময় ঋণ শোধ হলো৷ দীর্ঘ সৌদি প্রবাসে থাকার কারণে আরবি ভাষাটাও বলতে পারলাম ভালোই৷ ফলে ভালো কাজ জুটলো৷ আর অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকল৷
প্রবাসে থাকার শেষ বছরটা কিছুটা ভালো কাটছিল আমার৷ নিজের লেখালেখিতে ফিরে যেতে পেরেছিলাম৷ বাংলাদেশের একটি চালু অনলাইন পত্রিকায় লেখা শুরু করেছিলাম৷ ওই পত্রিকায় সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করছিলাম৷
প্রচুর মানুষের সাথে পরিচিত হই৷ সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সাথেও পরিচিত হই৷ আমরা এখানে যৌথভাবে কাজ করতাম৷
আমি মূলত একটি আন্তর্জাতিক চেইন শপের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতাম৷
এদিকে থিতু হওয়ার পর থেকেই আমার স্ত্রী দেশে স্থায়ীভাবে ফেরার তাগিদ দিতে থাকে৷ তাছাড়া এর মধ্যে বেশ কয়েকবার দেশে গিয়েছি স্বল্প সময়ের জন্য৷ আর এ কারণে আমার সন্তানও হয়েছে৷ তাকেও খুব দেখতে ইচ্ছা করে৷ তার শৈশবের দিনগুলোতে পাশে না থাকার যন্ত্রণাও আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়৷ এদিকে দেশে ফিরে কী করবো, সে চিন্তাও আমাকে পেয়ে বসেছিল৷ এটা ছিল একটা প্যারাডক্স! ফেরা আর না ফেরার দোলাচল৷
কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত যেন প্রকৃতি নিয়ে নিলো৷ সৌদি সরকারের অথর্নৈতিক সংস্কার উদ্যোগের কারণে সব ধরনের দোকানে সৌদি নাগরিক ব্যতীত অন্য দেশের কর্মীদের নিয়োগে আইনগত নিষেধাজ্ঞা এলো৷ ফলে চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরির পেছনে ছুটতে হচ্ছিল৷
ঠিক এ সময়েই সিদ্ধান্ত নেই, ‘‘অনেক হয়েছে, দেশে ফিরে যাবো৷ নতুন করে সেখানেই কিছু করার চেষ্টা করবো৷'' গত এপ্রিলে দেশে ফিরে আসি৷ পেছনে পড়ে থাকে যৌবন আর পরাহত প্রবাস জীবন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
যে ১০ জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদেশে গেছেন
বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫৭ লক্ষ ৭৪ হাজার ৫৪০ জন বাংলাদেশি কর্মসূত্রে বিদেশে গেছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Naamani
১. কুমিল্লা
সবচেয়ে বেশি গেছে এই জেলা থেকে৷ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা থেকে মোট ৬ লক্ষ ১৯ হাজার ১৩৮ জন বিদেশ গেছেন, যেটা রপ্তানি হওয়া মোট জনশক্তির প্রায় ১০.৯৪ শতাংশ৷