টিটু রায়ের বিরুদ্ধে ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ‘ধর্ম অবমাননার' অভিযোগ তুলে রংপুরে হিন্দুদের বেশ কিছু বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়, চালানো হয় লুটপাট৷ সেই টিটু রায়কে নীলফামারী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এ তথ্য জানান৷ ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে গিয়ে হিন্দুদের পোড়া বাড়িঘর দেখার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘টিটু রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ টিটু দোষী হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷''
রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, টিটুকে নীলফামারী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ মঙ্গলবার সকালেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
শুক্রবার বিকেলে রংপুর সদরের ঠাকুপাড়ায় হিন্দুদের ৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ আরো ২৫টি বাড়ি ভাঙচুর করা হয়৷ পাশাপাশি ব্যাপক লুটপাটও চালায় হামলাকারীরা৷ হামলার এক পর্যায়ে হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তি মারা যান৷
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, শুক্রবারের ঘটনায় গঙ্গাচড়া থানার এসআই রেজাউল করিম ও কোতোয়ালি থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন৷ মামলায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে৷ এ পর্যন্ত ১২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
নাসিরনগরের হিন্দুরা এখন যেমন আছেন
এক ব্যক্তি ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে- এই অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু জনপদে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ শতাধিক বাড়ি ও বেশ কিছু মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজের বাড়ি-ঘরে হামলা
যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছে তার নাম রসরাজ দাস৷ অভিযোগ ওঠার পরই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তারপরও হামলা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং হবিগঞ্জের মাধবপুরের হিন্দুদের অনেক বাড়ি এবং মন্দিরে৷ নাসিরনগর সদর থেকে ১৬ কিমি. দূরে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে রসরাজের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজ কি সত্যিই ধর্ম অবমাননা করেছে?
২৮শে অক্টোবর রসরাজের ফেসবুক পাতায় ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করা হয় বলে দাবি করা হয়৷ রসরাজ জানিয়েছে, কেউ হ্যাক করে এটি করেছে৷ তারপরও নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবিটি পোস্ট হওয়ায় ক্ষমা চেয়েছেন তিনি৷ তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রসরাজ মাত্র ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে৷ ফলে ফটোশপ করে ছবি ফেসবুকে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে কিনা এই প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Khukon Singha
ফটোশপ করতে জানেন না রসরাজ
এদিকে গ্রেপ্তার করার পর রসরাজকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ৷ নাসিরনগর ঘুরে এসে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ফোর-ফাইভ ক্লাস পাস ঐ যুবকের ফটোশপে কাজ করার মতো দক্ষতা নাই৷ আমরা সরেজমিন তদন্তে ধারণা করছি, একটি সাইবার ক্যাফে থেকে এ কাজ করা হয়েছে৷’’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং মানবাধিকার কর্মীরাও একই কথা বলেছেন৷
ছবি: Khukon Singha
পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়
ধর্ম অবমাননার কথা বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের সময় পুলিশ হামলাকারীদের রুখতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতরা৷
ছবি: Khukon Singha
আবারও হামলা
৩ নভেম্বর আবার হামলা হয় নাসিরনগরে৷ হিন্দুদের বেশ কিছু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া গত কয়েকদিনে গোপালগঞ্জ, রংপুর, বরিশাল, ঠাকুরগাঁওসহ আরো কয়েকটি জায়গায় হিন্দুদের মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি বাড়ি৷
‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে বিক্ষোভ
রসরাজের শাস্তি দাবিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে রোববার বিক্ষোভ-সমাবেশের পরপরই নাসিরনগরে এবং পাশের এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলে পড়ে একদল যুবক৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি৷
ছবি: Khukon Singha
স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতা বহিষ্কার
হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় তিন নেতাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ৷ হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ৷
ছবি: Khukon Singha
চলছে ঘর-বাড়ি ঠিক করার কাজ
পুড়ে যাওয়া ও ভাঙা ঘর-বাড়ি ঠিক করে কোনোমতে মাথা গোঁজার নিশ্চয়তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: Khukon Singha
মন্দিরের বেহাল দশা
এই পুরোহিতের চোখের ভাষা অনেক কিছুই বলে দেয়৷ মন্দিরগুলো কবে যে ঠিক করা হবে, কারো জানা নেই৷
ছবি: Khukon Singha
মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রতিমা
হামলার পর থেকে এখনো মন্দিরগুলোকে ঠিক করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি৷ তাই এই মন্দিরে প্রতিমা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাটিতে৷
ছবি: Khukon Singha
ক্ষতিগ্রস্তরা পাচ্ছেন না ত্রাণ
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৬ হাজার করে টাকা ও টিন দেয়া হয়েছে৷ ক্ষতির তুলনায় তা খুবই কম৷ তবে খোকন সিং ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, বেশিরভাগ পরিবার ছয় হাজার টাকাও পাননি৷ কেউ কেউ এক বান্ডিল টিনের সঙ্গে পেয়েছেন মাত্র তিন হাজার টাকা!
ছবি: Khukon Singha
12 ছবি1 | 12
তবে যে ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য হামলা চালানো হয়, সেই স্ট্যাটাসটি টিটু রায়ের কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ ঘটনার পরই সংবাদমাধ্যমের কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, টিটু রায় সাত বছর ধরে রংপুরে থাকেন না এবং তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই৷ টিটুর পরিবার এবং স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন, লেখাপড়া না জানা টিটুর পক্ষে এমন স্ট্যাটাস দেয়া সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত৷
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘শুনেছি টিটু লেখাপড়া জানেন না৷ তিনি নাকি আট-দশ বছর আগে থেকে বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে থাকেন৷ পুলিশ ঘটনা তদন্ত করছে৷ এটা আসলে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা৷ এজন্য এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে৷ দেশে ষড়যন্ত্র চলছে৷''
সংবাদমাধ্যমকে একই প্রসঙ্গে রংপুর জেলার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘ফেসবুকে তার (টিটু) দেওয়া ধর্ম অবমাননার স্ট্যাটাস খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ এলাকায় বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটানো হয়েছে৷''