‘রক্তগঙ্গা থামাতে সিপাহী বিদ্রোহকে সমর্থন দিয়েছিলাম’
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ টকশোতে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এই মন্তব্য করেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে বাংলার সাপ্তাহিক ইউটিউব টকশোর এবারের পর্বে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী৷ এবারের পর্বে আলোচিত হয় বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বর্তমান অবস্থা, ভূমিকা ও তাদের আন্তঃসম্পর্কের নানা প্রসঙ্গ৷
পাশাপাশি, আলোচিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিয়েও৷ এই প্রসঙ্গে উঠে আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতিও৷ বাংলাদেশে শাসন ক্ষমতা সামরিক নিয়ন্ত্রণে যাওয়া প্রসঙ্গে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘‘...খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখলের পর সেনা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি সাংঘর্ষিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল৷ আমরা একটি সিপাহী বিদ্রোহকে সমর্থন দিয়েছিলাম, সেখানে রক্তগঙ্গা থামাতে, গৃহযুদ্ধ থামাতে৷ আমরা সর্বদলীয় নির্বাচনের পথে গিয়েছিলাম৷''
তিনি বলেন, ‘‘কিন্তু আমাদের এই অভ্যুত্থানের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারার কারণে জেনারেল জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে অন্য সামরিক অফিসারদের দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সামরিক শাসনের ফাঁদে বাংলাদেশকে ঠেলে দেন৷ সেই অভ্যুত্থানের সময় সেখানে নানা পক্ষের সৈনিকরা ছিলেন৷ নিরপেক্ষ ছিলেন, জিয়াউর রহমানের সমর্থক ছিলেন, ছিলেন খালেদ মোশারফের সমর্থকরাও৷ সেখানে মারামারির সুযোগ থাকলে সর্বাত্মক বিদ্রোহ হতো না, গোলাগুলি হতো৷''
এই বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, ‘‘জিয়াউর রহমান দেশকে সামরিক শাসনের জাঁতাকলেতো ফেলেনই নি, বরং তিনি সেখান থেকে তুলে নিয়েছেন৷ সামরিক শাসন দিয়েছিলেন সায়েম, তার আগে মোশতাক৷ বরং তিনি দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ শতফুল ফোটার সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসলেন৷''
হাসানুল হক ইনুকে প্রশ্ন করা হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো প্রসঙ্গে জাসদের প্রাথমিক ভূমিকা নিয়ে৷ উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আমি তখন আত্মগোপনে ছিলাম৷ আমরা সেদিন হত্যাকাণ্ডের পর গোপন বৈঠক করে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করি৷ সিদ্ধান্ত নিই যে শেখ মুজিবের সরকারের বিকল্প কোনো সামরিক সরকার হতে পারে না, মোশতাক সরকার হতে পারে না৷ সেই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে জাসদ যাবে, সেই সিদ্ধান্ত আমরা নিই৷''
তিনি বলেন, ‘‘ছাপানো লিফলেটের মাধ্যমে মোশতাক সরকারকে প্রত্যাখ্যান করি৷ ছাপানো লিফলেটে হত্যাকাণ্ড সমর্থন করিনি সেটা বলা ছিল৷ তখন আমরা নিষিদ্ধ দল৷ প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে পারিনি৷ তিনটি দল মিলে আমরা লিফলেটে বলি যে এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করিনি৷''
টকশোতে এছাড়াও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের সাথে সরকারের ভূমিকা, প্রধানমন্ত্রীর ছোটবড় দলের প্রতি মনোভাব ও বিরোধী দলের প্রসঙ্গটিও আলোচিত হয়৷
এসএস/এআই
বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বিচারের আদ্যোপান্ত
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক এবং অন্ধকারতম অধ্যায়৷ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং বিচার না করার প্রত্যক্ষ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে বিচারের বিস্তারিত থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: bdnews24
সেদিনের ঘটনা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে একদল বিপথগামী সেনাসদস্য হত্যা করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে৷
ছবি: bdnews24
নিহত পরিবারের সদস্য ও অন্য যারা
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, বঙ্গবন্ধুর শিশু সন্তান শেখ রাসেল, আরো দুই ছেলে শেখ কামাল, শেখ কামাল এবং তাদের স্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল (ব্রিগেডিয়ার পদে মরণোত্তর পদোন্নতিপ্রাপ্ত) এবং সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককেও সেদিন হত্যা করা হয়৷
ছবি: AP
শেখ ফজলুল হক মণি ও সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা
একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা করে৷ এরপর বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা চালিয়ে সেরনিয়াবাত, তার ছেলে, মেয়ে, নাতি, বড় ভাইয়ের ছেলে এবং এক আত্মীয়কে হত্যা করে৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় রক্ষা পান৷
ছবি: bdnews24.com
বিচার রোধের প্রক্রিয়া
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দু মাস ২২ দিনের (১৫ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর) রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষায় ‘ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স’ জারি করেন৷ ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান একে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন৷
ছবি: imago/Belga
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
প্রথমে জার্মানি এবং তারপর ভারতে দীর্ঘ নির্বাসনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা৷ দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর গড়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন৷
ছবি: DW/M.Rahman
২১ বছর পর...
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান তিন আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও তাহের উদ্দীন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ওই বছরই বঙ্গবন্ধুর পি এ এএফএম মোহিতুল ইসলাম ১৫ আগস্টের ঘটনায় থানায় এফআইআর করেন৷
ইনডেমনিটি আইন বাতিল ও বিচার শুরু
১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়৷ ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে ২০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল এবং ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়৷
নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পর ২০০০ সালে হাইকোর্ট বিভক্ত রায় দেন৷ পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে৷ বিএনপি-জামাত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
৩৪ বছর পর রায়
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হলে আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন৷ ১৯ তারিখ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল আবেদন খারিজ করে দেন৷
ছবি: bdnews24
জাতির দায়মুক্তি
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহম্মেদ (আর্টিলারি) এবং মহিউদ্দিন আহম্মেদ (ল্যান্সার)-এর ফাঁসি কার্যকর হয়৷ ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল আব্দুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১২ এপ্রিল তারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: Bdnews24.com
পলাতক যারা
খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এএম রাশেদ চৌধুরী এবং এসএইচ নূর চৌধুরী এখনও পলাতক৷