1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রক্তদান: বদলাচ্ছে মানসিকতা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩ জুন ২০১৯

বাংলাদেশে এখন বছরে ৬ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন৷ এর ৯০ ভাগই পাওয়া যায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে৷ তাই পেশাদার রক্তদাতাদের দৌরাত্ম অনেকটাই কমে গেছে৷ আশা করা হচ্ছে, ৫ বছর পর পেশাদার রক্তদাতা আর থাকবে না৷

Frankreich Zentrum für Blutspenden in Paris
ছবি: Getty Images/AFP/M. Berard

ঢাকার বিভিন্ন প্রাইভেট ব্লাড ব্যাংকে ৫ বছর আগেও বড় বড় অভিযানের খবর পাওয় যেতো৷ উদ্ধার করা হতো মানব শরীরে ব্যবহারের অনুপযোগী রক্ত৷ হাসপাতালগুলোতে গেলেই দেখা মিলত পেশাদার রক্তদাতাদের,যাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন রক্ত দেয়ার অনুপযোগী৷ তাঁদের বড় একটি অংশই ছিলেন মাদকাসক্ত৷ তখন পেশাদার রক্তদাতাদের মাধ্যমে অনেক জটিল এবং কঠিন রোগ ছড়াতো৷

এখানো যে পেশাদার রক্তদাতা নেই, তা নয়৷ মাঝে মাঝে কথিত ব্লাড ব্যাংকে অভিযানও হয়৷ তবে দৌরাত্ম কমেছে৷ মানুষ সচেতন হয়েছে৷ চাইলে রক্ত পাওয়া যায় ভিন্ন সংগঠন থেকে৷ অনলাইনে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের গ্রুপ আছে৷ আর সেখানে রক্তের চাহিদার সাথে ডোনারদের সম্মীলন ঘটিয়ে দেয়া হয়৷ ব্লাড ব্যাংকে সংরক্ষিত রক্ত লাগে না৷ সরাসরি ডোনারের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে  রোগীদের দেয়া হয়৷  বিভিন্ন সংগঠনের সাথে নিবন্ধিত এরকম সেচ্ছায় রক্তদাতা বিশ লাখের কম হবে না৷ নিন্ধনের বাইরেও প্রচুর মানুষ এখন নিয়মিত সেচ্ছায় রক্ত দেন৷

বাংলাদেশে এই রক্তদানের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছেন শিক্ষার্থীরা৷ তাঁদের রক্তদানের সংগঠনগুলোই এগিয়ে৷

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে৷

রক্তদানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠছে: আহসান উল্লাহ পাঠান

This browser does not support the audio element.

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই রক্তদানের ক্ষেত্রে এখন অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে৷ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে রক্ত পেতে হলে হাসপাতালের স্লিপ লাগে৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে রক্ত পেতে তা লাগে না৷ বিরল কোনো গ্রুপের রক্ত হলেও ফেরায় না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম৷ সেই অভিজ্ঞতার কথাই ডয়চে ভেলেকে বলেন নুরুজ্জামান লাবু নামে একজন৷ তিনি বলেন, ‘‘ ৪ মাস আগে আমার ১৩ বছর বয়সি ভাগ্নি রিফাত জাহানের হাঁটুতে অপারেশন হয় ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে৷ তার রক্তের গ্রুপ ছিল এবি পজিটিভ৷ আমি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার পরে অন্তত ১০ জন যোগাযোগ করেন৷ তাঁদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র কাছাকাছি থাকায় তাঁর কাছ থেকে আমরা রক্ত নিই৷ এরপরও আরো অনেকে যোগাযোগ করেন৷ তখন আমি আপডেট ফেসবুকে জানিয়ে দেই৷'' আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে ফেসবুকের মাধ্যমে রক্ত চাইলে নিরাশ হতে হয় না৷''

যাঁরা রক্তের জন্য কাজ করেন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বাঁধন' গড়ে ওঠে ১৯৯৭ সালে৷ এখন ঢাকাসহ সারা দেশে ৫২টি জেলায় ১২৭টি ইউনিটের মাধ্যমে তাদের স্বেচ্ছায় রক্তদানের কাজ চলে৷ তাদের এই রক্তদান কার্যক্রম শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাদের সেন্টারগুলো করা হয়েছে হাসপাতালের কাছাকাছি৷ আর শিক্ষার্থীরা সেচ্ছাশ্রমে এইসব সেন্টারে পালা করে ২৪ ঘন্টা কাজ করেন৷

তাঁরা ব্লাড ব্যাংকে রক্ত সংগ্রহ করে রাখেন না৷ তাঁদের ডোনারদের অনলইন এবং অফলাইন তালিকা আছে৷ হাসাপতালের বৈধ স্লিপ নিয়ে এলে ওই তালিকা থেকে স্বেচ্ছা ডোনারদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয়৷ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালে তাঁদের একটি ট্রান্সমিশন সেন্টার আছে৷ সেখানে সন্ধ্য ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ব্লাড নেয়া হয়৷

পেশাদার রক্তদাতাদের রক্ত নেয়া বন্ধ করা উচিত: ডা. মনি লাল আইচ

This browser does not support the audio element.

বাঁধনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আহসান উল্লাহ পাঠান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে দাবি করেন, ‘‘গতবছর আমরা প্রায় ৬৮ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছি৷'' তিনি বলেন, ‘‘রক্তদানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠছে৷ আমাদের কাছে কেউ এলে, তাঁর গ্রুপ একই হলে আমরা তাঁকেই প্রথম রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করি৷ অনেক সময়ই তা সফল হয়৷ অথবা তাঁকেও আমরা ডোনারে পরিণত করি৷ আমরা রক্তের ফ্রি গ্রুপিং করে দিই৷ আর সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম চালাই৷'' তাঁর মতে, ‘‘স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে৷ প্রফেশনাল রক্তদাতা এখন আর সেরকম নেই৷''

চিকিৎসকরা জানান, ১৮ বছর থেকে ৫৫ বছর বয়সি যে-কোনো সুস্থ মানুষ প্রতি চার মাস পরপর রক্ত দিতে পারেন৷ তবে তাঁকে হতে হবে নিরোগ৷ কিছু বিশেষ রোগ না থাকলেই হবে৷ আর স্বেচ্ছায় রক্তদাতারাই আসলে ভালো রক্তের উৎস৷ বাংলাদেশে এই কাজ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম ১৯৭৭ সালে শুরু করে মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্রদের সংগঠন সন্ধানী৷ এখন এটি অনেক বড় প্রতিষ্ঠান৷ ঢাকায় একটি ৬ তলা ভবনে তারা কাজ করে৷ আর পুরো কাজই হয় স্বেচ্ছাশ্রমে৷ সন্ধানী বছরে  গড়ে ৫০ হাজার ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করে৷ তারা নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এই রক্ত সংগ্রহ করে ব্লাড ব্যাংকে রাখে৷ আবার কেউ যদি তাদের রোগীর জন্য সেচ্ছায় রক্তদাতা নিয়ে আসে, সেই রক্ত সংগ্রহ করে রোগীকে পৌঁছে দেয় সন্ধানী৷

আমরা রক্ত দানের জন্য সচেতনতা তৈরি করি: নজরুল ইসলাম

This browser does not support the audio element.

সন্ধানীর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ লিটু ডয়চে ভেলকে বলেন, ‘‘রক্তদান নিয়ে মানুষের ভীতি এখন কমে গেছে৷ ৯০ ভাগই আসে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে৷ সংগঠনের বাইরেও এখন প্রচুর মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দেন৷ আমার মনে হয় পেশাদার রক্তদাতাদের রক্ত নেয়া পুরেপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত৷ সরকার সংগঠনগুলোকে একটি সমন্বিত উদ্যোগের মধ্যে নিলে ওই ১০ ভাগও পুরণ করা যাবে৷ বিশেষ করে সরকারের প্রতিষ্ঠান রেডক্রিসেন্টকে এই কাজে আরো উদ্যোগী করতে হবে৷''

বাংলাদেশে এখন লায়ন ও রোটারি ক্লাব এই স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পরিচালনা করে৷ রেডক্রিসেন্ট অনেক বড় কাজ করছে৷ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন পরে শুরু করলেও তাদের সাফল্যও উল্লেখ করার মতো৷ তারাই এখন সবচেয়ে বেশি রক্ত সংগ্রহ করে৷ বছরে এক লাখ ব্যাগ৷ আর সরকার ‘নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন কর্মসূচি' নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সন্ধানীসহ এইসব সংগঠনকে সহায়তা করে৷

২০ বছরে ৭২ বার রক্তদান

১৮ বছর বয়স থেকে রক্ত দেন নজরুল ইসলাম৷ কাজ করেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে৷ তাঁর বয়স এখন ৩৮ বছর৷ ২০ বছরে তিনি রক্ত দিয়েছেন ৭২ বার৷ প্রতি চার মাস পর রক্ত দেয়ার নিয়ম থাকলেও আধুনিক পদ্ধতিতে এখন শুধু প্লাটিলেট দেয়া যায়৷ আর এটা দেয়া যায় ১৫ দিন পরপর৷ রফিকুল সরাসরি রক্ত দেয়া ছাড়াও নিয়মিত প্লাটিলেটও দেন৷ রফিকুল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা এখন একটি কল সেন্টার স্থাপন করেছি, যার নাম ডোনেট ব্লাড বিডি৷ এটা একটা ফেসবুক গ্রুপ৷ আমাদের ২-৩ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিয়মিত রক্ত দেন৷ আমরা ফেসবুকের মাধ্যমেই চাহিদা জানি এবং স্বেচ্ছা ডোনার সংগ্রহ করে দিই৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমরা মূলত রক্ত দেয়ার জন্য সচেতনতা তৈরি করি৷ আর পরিবারের মধ্য থেকেই রক্ত দেয়ার ওপর জোর দেই৷ আমরা এই সচেতনতা কর্মসূচির অংশ হিসেবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বাইসাইকেলে ভ্রমণ করেছি৷'' তিনি মনে করেন, ‘‘আরেকটু সচেতনতা বাড়লে বাংলাদেশে পেশাদার রক্তদাতার দরকার নেই৷''

পেশাদার রক্তদাতাদের অনেকেই রোগাক্রান্ত: মৃদুল দাস

This browser does not support the audio element.

এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে

বাংলাদেশে এখনো কিছু কথিত ব্লাড ব্যাংক পেশাদার রক্তদাতাদের দিয়ে তাদের রক্তব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা মৃদুল দাস৷ আর এই পেশাদার রক্তদাতাদের বড় একটি অংশ মাদকাসক্ত এবং  নানা জটিল রোগে আক্রান্ত৷ পেশাদার রক্তদাতারা এখন আগের মতো না থাকলেও ব্যবসার প্রয়োজনেই ওই ব্লাড ব্যাংকগুলো তাদের টিকিয়ে রাখছে৷ আর তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিছু হাসপাতালের কর্মচারীর৷ এইসব ব্লাড ব্যাংকের রক্ত সংরক্ষণ পদ্ধতিও উন্নত নয় বলে জানান তিনি৷ তারা প্রতিব্যাগ রক্ত ১২শ' থেকে ১৫শ' টাকায় বিক্রি করে৷

তিনি বলেন, ‘‘এখন যেসব সংগঠন ব্লাড ডোনেশনের কাজ করে, তারা বিনিময় পদ্ধতি চালু করেছে৷ এক ব্যাগ নিলে অন্য যে-কোনো গ্রুপের আরেক ব্যাগ রক্ত দেয়া৷ এটা বাধ্যতামূলক নয়৷ উৎসাহিত করা হয়৷ এতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷'' আর সন্ধানীর নীতি হচ্ছে কেউ যদি এক ব্যাগ রক্ত দেন, তাঁর মানে হলো তিনি একব্যাগ রক্ত জমা রাখলেন৷

জানা গেছে, যেসব রোগীর নিয়মিত বা প্রায় প্রতিদিন রক্তের প্রয়োজন হয়, তাঁদের রক্ত সংকট এখনো আছে৷ যেমন, থ্যালেসেমিয়া রোগী৷ আবার সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা দুর্ঘটনার শিকার যাঁরা হন, তাঁদের তাৎক্ষণিকভাবে রক্তের প্রয়োজন হয়৷ এর সুযোগ নেয় ওইসব ব্লাড ব্যাংক ও পেশাদার রক্তদাতারা৷ কিন্তু তাদের রক্ত জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে জীবন বিপন্নের কারণ হতে পারে বলে ডা. মনি লাল আইচ লিটু জানান৷ রফিকুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘পরিবারের সদস্যদের জন্য অন্য সদস্যদের রক্ত দেয়ার আগ্রহ যত বাড়বে ততই রক্তের সংকট কেটে যাবে৷ আর বিশেষ ধরনের রোগীদের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ