জার্মানিতে মহাজোট সরকার গঠনের প্রাক-প্রাথমিক আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে৷ সিডিইউ ও এসপিডি মহাজোট সরকার গঠনের আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে৷ কিন্তু এ পর্যন্ত আসতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বামপন্থি অংশটার অনেক আপত্তিই অগ্রাহ্য হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
প্রায় টানা একদিন দর কষাকষির পর শেষ পর্যন্ত শুক্রবার জার্মানির দুই বড় দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসপিডি) ঘোষণা দেয়, যে আলোচনা অনেকটাই ফলপ্রসূ হয়েছে৷
এতে করে আনুষ্ঠানিকভাবে মহাজোট সরকার গঠনের পথে আলোচনার পথ খুলল৷ সব পরিকল্পনা মতো এগুলে শিগগিরই নতুন মহাজোট সরকার দেখতে পাবেন জার্মানরা৷
সবদিক থেকে দেখলে ম্যারাথন এ আলোচনার পর মুখের হাসি সবচেয়ে চওড়া হয়েছে চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের৷ কারণ, তাঁর হাতে অন্য যে দু'টি উপায় ছিল সেগুলো হলো, হয় পার্লামেন্টে সংখ্যালঘুদের নিয়ে এক নড়বড়ে সরকার গঠন করা, নয়তো আবারো নির্বাচন করা৷
এসপিডির বামপন্থিদের পরাজয়
দীর্ঘ এই আলোচনার ফলাফল ২৮ পৃষ্ঠার একটি সম্মতিপত্র, যেখানে দুই শিবিরের নেতারা যেসব পলিসিতে একমত হয়েছেন তার তালিকা আছে৷
এখন তাদের দলের নেতৃবৃন্দের সামনে এগুলোর যথার্থতা তুলে ধরতে হবে৷
আর এ কাজটা যতটা না কঠিন সিডিইউর বাভেরিয়ান সহযোগী, যাকে সিডিইউর ডানপন্থি অংশও বলা হয়, সেই সিএসইউ'র নেতা হর্স্ট সেহোফারের জন্য, তারচেয়ে অনেক বেশি কঠিন এসপিডি নেতা মার্টিন শুলৎসের জন্য৷ ২১ জানুয়ারি এক বিশেষ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে দলটি৷
এসপিডির বামপন্থি অংশটির এমনিতেই এই মহাজোটে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল৷ তাদের বেশ কিছু দাবি ছিল৷ যেমন, উচ্চ আয়ের মানুষদের আয়কর বাড়ানো, শরণার্থীদের পরিবারের সঙ্গে একত্রিত হবার সুযোগ দেয়া এবং স্বাস্থ্য বীমার একটি নতুন পলিসি করা৷ এই দাবিগুলো প্রাক-প্রাথমিক এই আলোচনায় অনেকটাই অগ্রাহ্য করা হয়েছে৷
প্রাথমিক আলোচনায় যেসব সিদ্ধান্ত
পারিবারিক পুনর্মিলন: সিডিইউ-এসপিডি মহাজোটের বর্তমান সরকার শরণার্থীদের খুবই ‘সীমিত শর্তে' পরিবারের সদস্যদের জার্মানিতে আনার সুযোগ দেয়া হয়৷ আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মাসে ১,০০০ জনের বেশি এই সুযোগ পাবেন না৷ এছাড়া আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি হতে পারবে না৷
আয়কর: আয়কর না বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছে সিডিইউ ও এসপিডি, যদিও এসপিডির দাবি ছিল সর্বোচ্চ আয়কর ৪২ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ ভাগ করা৷
সলিডারিটি ট্যাক্স: দুই জার্মানি একত্রিত হবার সময় সাবেক পূর্ব জার্মানদের উন্নয়নের জন্য এই কর ধার্য করা হয়েছিল ১৯৯০ সালে৷ এখন তা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলার ব্যাপারে একমত হয়েছে দুই দল৷ গেল ক'বছর ধরে এ নিয়েও বিতর্ক চলছে৷
স্বাস্থ্য বীমা: এসপিডির উদারপন্থিদের দাবি ছিল, একটা সাধরণ সিটিজেন ইনস্যুরেন্স করা, যার আওতায় সরকারি ও বেসরকারি সব স্বাস্থ্য সেবাই থাকবে৷ কিন্তু তা বাদ দিয়ে দুই দল চাকরিদাতা ও চাকরিজীবী দুই পক্ষের জন্য একই স্বাস্থ্য বীমা চালু করতে চাইছে৷
এছাড়া, ভবন তৈরির হার বাড়ানো, ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবার জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি বাতিল এবং গ্লাইফোসেট কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হওয়া গেছে এই আলোচনায়৷
এখন দেখার বিষয়, সিডিইউ, সিএসইউ ও এসপিডি দলের কর্মীরাকিভাবে এই সিদ্ধান্তগুলোকে নেন কিংবা নেতারা কিভাবে তাদের দলের লোককে বোঝাতে পারেন৷ তার ওপরেই নির্ভর করছে মহাজোট সরকার৷
যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করেন ম্যার্কেল
এমনকি ২০১৭ সালের নির্বাচনের আগেও তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো রাজনীতিবিদদের নিষ্ক্রিয় বা পাশে সরিয়ে দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ নিজের দল বা বিরোধী দলের অনেক নেতাকেই নানাভাবে ঠেকিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ANP/R. De Waal
‘কোল গার্ল’ যখন গুরুকে ছাড়লেন
দীর্ঘদিন চ্যান্সেলর পদে থাকে হেলমুট কোল ম্যার্কেলকে মন্ত্রিসভায় প্রথম সুযোগ দিয়েছেন এবং তাঁর উত্থানে সহায়তা করেছিলেন৷ কিন্তু ১৯৯৮ সালে চ্যান্সেলর পদ হারানোর পর ম্যার্কেল এবং সিডিইউ তাঁর বিপক্ষে চলে যায়৷ কোল কিছু সূত্র থেকে নগদ অর্থ সাহায্য নিয়েছিলেন৷ কিন্তু সে সব সূত্রের বিস্তারিত তিনি জানাননি যা দলের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছিলেন সেসময় সিডিইউ’র সাধারণ সম্পাদক আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Altwein
গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার – রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি
২০০৫ সালের নির্বাচনে এসপিডি’র চ্যান্সেলর শ্র্যোডারকে পরাস্ত করেন ম্যার্কেল৷ তবে এই পরাজয়ে শ্র্যোডারের নিজের দাম্ভিকতাও কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল৷ সেই নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধানে সিডিইউ’র কাছে হেরে যায় এসপিডি৷ যদিও নির্বাচনের আগে টিভি বিতর্কে তিনি দাবি করেছিলেন, যে জার্মানরা চায় তিনি ক্ষমতায় থাকুন৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এবং তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার - দীর্ঘদিনের সঙ্গী
শুরুতে ম্যার্কেলের অধীনে চারবছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার৷ এরপর ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন সামাজিক গণতন্ত্রীদের এই রাজনীতিবিদ৷ কিন্তু সেই নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি স্টাইনমায়ারের দল৷ পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আবারো ম্যার্কেলের অধীনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন স্টাইনমায়ার৷ আর চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে তিনি জার্মানির প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kembowski
গ্যুন্টার ও্যটিঙার - পথের কাঁটা দূর হলো
ম্যার্কেল যে শুধু তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেন এমন নয়৷ বরং নিজের দলে থাকা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের লোভনীয় অন্য কোন পদেও পাঠিয়ে দেন৷ তাঁর সহকর্মী বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গ্যুন্টার ও্যটিঙারকে ২০১০ সালে তিনি ইউরোপীয় কমিশনে বড় পদে পাঠিয়ে দেন৷ অথচ ও্যটিঙারের সেই পদ পাওয়ার মতো কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Seeger
রোনাল্ড কখ - বাতিলের তালিকায় ফেলে দেয়া
দুই কারণে রোনাল্ড কখ পরিচিত৷ প্রথমত, তিনি দলাই লামার বন্ধু৷ দ্বিতীয়ত, সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব চালুর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য৷ হেসে রাজ্যের এই রাজ্য প্রধান কখনো ম্যার্কেলের উত্থানে বাধা না হলেও হঠাৎ করেই মনে করেছিলেন তাঁকে বার্লিনে বড় পদের জন্য ডাকা হবে৷ কিন্তু ম্যার্কেলকে তাঁকে সেরকম কোন সুযোগ দেননি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ - একজন দুর্ভাগা রাষ্ট্রপতি
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যার্কেলের প্রথম পছন্দ ছিলেন না৷ কিন্তু ২০১০ সালে হর্স্ট ক্যোলার পদত্যাগ করার পর সিডিইউ বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় ভুল্ফ সুযোগ পেয়ে যান৷ ভুল্ফ তখন লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের রাজ্যপ্রধান৷ পরবর্তীতে অবশ্য দুর্নীতির দায়ে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে হয় তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেয়ার স্টাইনব্রুক – সঠিক মানুষ, ভুল সময়
২০১৩ সালে ম্যার্কেল যখন তাঁর ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখন এসপিডি থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেছে নেয়া হয় পেয়ার স্টাইনব্রুক’কে৷ ম্যার্কেলের অধীনে একসময় অর্থমন্ত্রী থাকা এই রাজনীতিবিদের চ্যান্সেলর পদ পাওয়ার সব যোগ্যতাই ছিল৷ কিন্তু সময়টা ঠিক ছিল না৷ ম্যার্কেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুবিধা করতে পারেননি তিনি৷