মেক্সিকান বারোয়িং টোড অথবা ডারউইন্স ফ্রগ৷ ছোট্ট কিন্তু ভারি রঙচঙে একটি ব্যাঙ৷ খুবই দুষ্প্রাপ্য, খুবই বিরল৷ সেই ব্যাঙের খোঁজে যেতে হবে চিলির কনসেপসিওনে, উইলো-উইলো রিজার্ভে৷
বিজ্ঞাপন
কনসেপসিওন থেকে ৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণে এখনও মেক্সিকান বারোইং টোড নামের একটি রঙচঙে ব্যাঙ দেখতে পাওয়া যায়৷ উইলো-উইলো রিজার্ভ হলো একটি হোটেল রিসর্ট; এদের লক্ষ্য হলো পরিবেশবান্ধব পর্যটন৷ সংরক্ষিত এলাকাটি আয়তনে প্রায় ৬,০০০ বর্গকিলোমিটার৷ এখানকার প্রধান জীববিজ্ঞানী হলেন ভেরোনিকা তোলেদো৷ আজ তিনি বারোয়িং টোড-দের খোঁজ করছেন৷
উইলো-উইলো রিজার্ভের জীববিজ্ঞানী ভেরোনিকা তোলেদো বলেন, ‘‘আমি এই ব্যাঙ খুব ভালোবাসি৷ প্রথমবার দেখেই এই বারোয়িং টোডের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম৷ আমি যে তাকে সাহায্য করতে পারি, বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারি, এটা ভেবেই আমার ভালো লেগেছিল৷''
ডারউইনের কোলাব্যাঙ যেখানে থাকে
03:31
ব্যাঙের চর্মরোগ
ভেরোনিকা বছরে চারবার করে এই ব্যাঙের খোঁজে আসেন৷ ব্যাঙগুলো আবার একটি দুরারোগ্য চর্মরোগে আক্রান্ত হয়৷ ভেরোনিকা জানালেন, ‘‘কুইট্রিড ফাঙ্গাস নামের একটি স্কিন ফাঙ্গাস থেকে পৃথিবীর সব উভয়চর প্রাণী বিপন্ন৷ কাজেই আমরা বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে ব্যাঙেদের বাসস্থানের কাছাকাছি আসি৷ ব্যাঙগুলোকে শুধুমাত্র দস্তানা পরা অবস্থায় হাতে নিই, কেননা আমরা জানি না, কোন ব্যাঙগুলোর ঐ রোগ হয়েছে অথবা হয়নি৷ প্রত্যেকটি ব্যাঙ হাতে ধরার জন্য একটা নতুন দস্তানা ব্যবহার করি৷''
কুইট্রিড ফাঙ্গাসের দরুণ সারা পৃথিবীতে উভয়চর প্রাণীর সংখ্যা কমে আসছে৷ ডারউইন্স ফ্রগ নামে পরিচিত ব্যাঙটিরও তাই দশা৷ উইলো-উইলো রিজার্ভে ভেরোনিকা এ পর্যন্ত দু'টি ব্যাঙ খুঁজে পেয়েছেন,যাদের গায়ে ঐ ফাঙ্গাস হয়েছে৷ নয়ত বাদবাকি ব্যাঙেরা ঠিকই আছে, বলে তাঁর ধারণা৷
ব্যাঙও এখন বিলুপ্তির হুমকির মুখে
ব্যাঙ ডাকলে একসময় মানুষ বুঝে নিতো বৃষ্টি হবে৷ গ্রামে তো বটেই, শহরেও ছিল ব্যাঙের ছড়াছড়ি৷ সেই দিন আর নেই৷ অনেক ব্যাঙ এখন কমতে কমতে বিলুপ্ত৷ আসুন, দেখে নিই টিকে থাকা ব্যাঙরাজ্যের বর্ণময়তা৷
ছবি: picture-alliance / dpa
ছিল কাতারে কাতার, এখন বিপদ অপার
লাল-চোখ তাদের৷ নাম ডুলেমানোহিলা৷ এ ধরণের ব্যাঙ এখন উভচর (অ্যাম্ফিবিয়ান) প্রাণীদের ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত৷ নিশাচর এই প্রাণীদের এক সময় ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যেতো কোস্টারিকা এবং পানামায়৷ এখন থাকার জায়গা কমছে, ছত্রাকজনিত বিশেষ ধরণের ভয়াবহ রোগও হানা দিচ্ছে৷ ফলে লাল-চোখা ব্যাঙেরাও এখন বিলুপ্তির পথে৷সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ১৬৫টি প্রজাতির ব্যাঙ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে৷
ছবি: Andreas Hertz
মরছে কেন?
কাইট্রিড এক ধরণের ছত্রাক৷ তাদের কারণে ব্যাঙদের যে রোগ হয় সেই রোগের নাম কাইট্রিডিওমাইকোসিস৷ ব্যাঙ কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসে তাদের গায়ের চামড়া ব্যবহার করে৷ কাইট্রিডিওমাইকোসিস হানা দেয় সেই চামড়ায়৷ পরিণাম- অবধারিত মৃত্যু৷ এমন রোগের কারণও কিন্তু ব্যাঙ৷ আফ্রিকার এক ধরণের ব্যাঙের দেহে এই ছত্রাক আবার নিরাপদে বাস করে৷ ১৯৫০ সালের দিকে মানুষের প্রেগন্যান্সি টেস্টে ব্যবহার করা হতো এই ছত্রাক৷
ছবি: Andreas Hertz
অনিশ্চয়তার পথে এগিয়ে চলা
পানামার এই ব্যাঙটির মতো অনেক ব্যাঙ আছে যারা রেইনফরেস্টে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে একটু বেশি নজর কাড়ে৷ বেশিদিন হয়তো এ অবস্থা থাকবেনা৷ মানুষ গাছ কেটে কেটে বন উজাড় করে দিচ্ছে৷ গাছ না থাকলে ব্যাঙগুলো কোথায় থাকবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং গাছে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারও ব্যাঙের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে৷
ছবি: Andreas Hertz
‘পরিবেশবিদ’ ব্যাঙ
ব্যাঙওপরিবেশবিদ৷ কথাটা মজা করে বললেও, ভেতরে বড় একটা সত্যি লুকিয়ে আছে৷ বিশ্বের অন্য সব প্রাণীর তুলনায় পরিবেশ-প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাঙ অনেক বেশি স্পর্শকাতর৷ পরিবেশের অনেক পরিবর্তন অনেক আগে টের পায় তারা৷ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর আগেভাগে পেয়ে ডেকে ডেকে সবাইকে জানিয়ে দেয়৷ তাই তো ব্যাঙের আরেক নাম, ‘কয়লাখনির খুদে গায়কপাখি’ (ক্যানারিজ ইন দ্য কোলমাইন)৷
ছবি: picture-alliance / dpa
মানুষের বন্ধু
ধেড়ে ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, গিরগিটিসদৃশ ব্যাঙ, গোলাপি ব্যাঙ- কত রকমের ব্যাঙ যে আছে বলে শেষ করা মুশকিল৷ প্রকৃতির খাদ্যপ্রবাহে ভূমিকা রাখে প্রত্যেকে৷ ব্যাঙ পোকামাকড় খায়, ব্যাঙকে খায় সাপ, পাখি, এমনকি মানুষও৷ মানুষ কি শুধু খায়? কিছু ব্যাঙের শরীরে এমন কেমিক্যাল রয়েছে যা কিনা মানুষের অনেক জটিল রোগ সারাতে সহায়তা করে৷ ছবির এই ব্যাঙের দেহে তো এমন ধরণের বিষ রয়েছে যা মানুষ বহুবছর তিরের ফলায় ব্যবহার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্যাঙ দেয় রং
অনেক ব্যাঙ বিলুপ্ত হচ্ছে, পাশাপাশি নতুন কিছু খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে৷ গতবছর জার্মানভিত্তিক প্রাণীবিজ্ঞানী আন্দ্রেয়াস হেয়ার্টস পশ্চিম পানামায় খুঁজে পেয়েছিলেন ছবির এই ব্যাঙটিকে৷ অদ্ভুত ধরণের প্রাণী৷ গায়ের রং হলুদ, ধরলে আপনার হাতও হলুদ হয়ে যাবে!
ছবি: picture-alliance/dpa
‘অ্যাম্ফিবিয়ান আর্ক’
উভচর এবং সরিসৃপ প্রাণীদের নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞানীদের বলা হয় ‘হারপেটোলজিস্ট’৷ পিএইচডির ছাত্র আন্দ্রেয়াস হেয়ার্টসও একজন হারপেটোলজিস্ট৷ ‘অ্যাম্ফিবিয়ান আর্ক’ নামের এক প্রকল্পের অধীনে কাজ করছেন ল্যাটিন অ্যামেরিকা অঞ্চলের উভচর এবং সরিসৃপ নিয়ে৷ তাঁদের কাজ হলো, কাইট্রিডে আক্রান্ত হওয়ার আগেই ব্যাঙকে বন থেকে তুলে এনে বাঁচিয়ে রাখা৷
ছবি: Sebastian Lotzkat
পুনরাবিষ্কার
ছয় দশক আগে মনে হয়েছিল চোখ ধাঁধানো রঙে রাঙানো এই ব্যাঙগুলো বুঝি চিরতরে হারিয়ে যাবে৷ হারিয়েই গিয়েছিল প্রায়৷ ২০১১ সালে ইসরায়েলের এক রাস্তায় দেখা গেল এমন একটা ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে৷ সযত্নে ধরে আনা হলো৷ সেই থেকে তাদের খোঁজার চেষ্টা আরো প্রবল হয়েছে৷ পাওয়াও গেছে বেশ কিছু৷ এরা কিন্তু আকার-আকৃতিতে একটুও বদলায় না৷ তাই এদের নাম দেয়া হয়েছে, ‘জীবন্ত ফসিল’৷
ছবি: cc-by-sa-3.0/Mickey Samuni-Blank
ফুসফুসহীন উভচর
এই ব্যাঙগুলোর ফুসফুস বলতে কিছু নেই৷ ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও এলাকার রেইনফরেস্টের খরস্রোতা ঝরনায় এদের বাস৷ পরিবেশ দূষণের কারণে এই ব্যাঙগুলোও এখন বিলুপ্তির পথে৷
ছবি: picture-alliance / dpa
9 ছবি1 | 9
ব্যাঙ দিয়ে যায় চেনা
একবার খুঁজে পেলে, বারোয়িং টোড-কে শনাক্ত করা অথবা পরীক্ষা করা খুব শক্ত নয়৷ বিপদ দেখলে এই ব্যাঙেরা চুপচাপ পড়ে থাকে৷ পেটের সাদা-কালো নকশা প্রত্যেক ব্যাঙের ক্ষেত্রে আলাদা৷ ভেরোনিকা জানালেন, ‘‘পেটের নকশা দেখে আমি বুঝতে পারি, আমি এই ব্যাঙটাকে আগে পরীক্ষা করেছি কিনা৷ দেখতে পারি, ব্যাঙটা বেড়েছে কিনা, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেছে কিনা, তার রং বদলেছে কিনা, পেটে ডিম এসেছে কিনা৷''
উইলো-উইলো রিজার্ভের মূলমন্ত্র হলো, কোনো জীবজন্তুকে তার বাসস্থান থেকে উৎখাত করলে চলবে না৷ অল্প কিছু পরীক্ষা করে ব্যাঙটিকে আবার ছেড়ে দেওয়া হয় ঠিক যেখানে তাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে৷ অতি নিরীহ এই ব্যাঙগুলির পক্ষে এই সংরক্ষিত অরণ্য হলো স্বর্গ! কনসেপসিওনের ব্রিডিং স্টেশন থেকে শিঘ্রই কয়েক ডজন ব্যাঙকে সুদূর ইউরোপে পাঠানো হবে৷
কনসেপসিওন বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুচিকিৎসক কার্লোস বারিয়েন্তোস দোনোসো জানালেন, ‘‘প্রাণীগুলি দেশের বাইরে বংশবৃদ্ধি করবে৷ তার ফলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব যে, এখানে ব্যাঙগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হলে, ইউরোপের চিড়িয়াখানায় তারা বেঁচে থাকবে৷''
বারোয়িং টোড-রা যদি তাদের সুদীর্ঘ যাত্রার পর ভিয়েনা, চেস্টার, লাইপজিগ, ডুসেলডর্ফ বা বার্লিনের চিড়িয়াখানায় সস্থ অবস্থায় পৌঁছাতে পারে, তাহলে তারা তাদের নতুন আবাসে ভালোই থাকবে, বলে ধরে নেওয়া যায়৷
জিকা ভাইরাস ছড়ানো মশা মারতে মাছ ও ব্যাঙ
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় জিকা ভাইরাসের ‘ভেক্টর’ প্রতিরোধে নানা ধরনের পন্থা নেওয়া হচ্ছে – তাদের অধিকাংশই প্রকৃতিদত্ত অথবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে সৃষ্ট৷ লক্ষ্য হলো, মশার লার্ভা বা কীট বিনষ্ট করে মশা কমানো৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
মশককীট খেকো মাছ
এল সালভাদর-এর সান দিয়েগো সৈকতে কিশোররা জাম্বো নামের এক ধরনের মোটা স্লিপার মাছ ধরে আনে৷ পরে জল রাখার পিপেয় এই জাম্বো মাছ ছেড়ে দিলে, সেই মাছ মশার লার্ভে বা কীটগুলোকে খেয়ে ফেলে৷ ‘এডিস এজিপ্টাই’ মশার কামড় থেকেই জিকা ভাইরাস ছড়ায়৷ (ছবিতে ব্রাজিল-এর একটি মিষ্টি জলের মাছকে দেখা যাচ্ছে)৷
ছবি: Matheus Volcan
মশা দিয়ে মশা মারা
জিকা ভাইরাস মায়ের পেটের ভ্রুণে মাইক্রোসেফালি রোগের অবতারণা ঘটায়, যা থেকে নবজাতকের মস্তক ও মস্তিষ্কের বিকাশ স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট হয়৷ নয়ত জিকা ভাইরাসের জ্বর প্রাণঘাতী নয়৷ কলম্বিয়া আর ব্রাজিলেই জিকা ভাইরাসের প্রকোপ আপাতত সবচেয়ে বেশি৷ কলম্বিয়ার আন্তিয়োকিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মশকদের মধ্যে ওলবাখিয়া নামের একটি জীবাণু ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, যার ফলে এডিস মশা মানুষকে সংক্রমিত করতে পারবে না৷
ছবি: Imago
মশাখেকো ব্যাঙ
যেখানে বিপদ, সেখানেই ব্যবসা ফাঁদার সুযোগ ও সম্ভাবনা৷ তাই আর্জেন্টিনায় সাত ডলার দরে ব্যাঙ বিক্রি হচ্ছে – সেই ব্যাঙ নাকি মশার বংশ ধ্বংস করে মানুষজনকে এডিস আর জিকার হাত থেকে বাঁচাবে৷ এ কাজে ব্যাঙ নাকি মশা তাড়ানোর ক্রিমের চেয়ে বেশি কার্যকর৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE/P. Oxford
অরগ্যানিক কীটনাশক
‘এডিস এজিপ্টাই’ মশা শুধু জিকা নয়, ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস ও চিকুঙ্গুনিয়া জ্বরের ভাইরাসও বহন করে৷ এই মশার কীট ধ্বংসের জন্য পেরুতে কোকো, ইউকা, অ্যাসপারাগাস আর আলু মিশিয়ে একটি ‘বায়োলার্ভিসাইড’ বা অরগ্যানিক কীটনাশক তৈরি করা হচ্ছে৷
ছবি: AP
তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে মশার প্রজনন ক্ষমতা রোধ
ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে৷ মূল ধারণাটা হলো, মশকদের উপর রশ্মি বিকিরণের ফলে পুরুষ মশারা নিষ্ফলা হয়ে পড়বে, কাজেই নারী মশারা ডিম পাড়তে পারবে না৷
ছবি: Kerry Skyring
ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানো
এককালে গোয়ালঘরে যা করা হতো, জিকা-ডেঙ্গুর তাড়নায় সেই পুরনো পদ্ধতিই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন অধিকাংশ দেশেই ডিডিটি ছড়ানো নিষিদ্ধ৷ মুশকিল এই যে, ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানো গেলেও, মশার ডিম ও কীট অক্ষত থেকে যায়৷