‘রজব আলি খুনের পর আর গ্রামে থাকতে পারিনি’
১০ অক্টোবর ২০১২১৯৫২ সালের ১০ই মার্চ বাগেরহাট জেলার সরই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মেহেরুন্নেসা মীরা৷ পিতা তাসের উদ্দীন শেখ এবং মা হাজেরা বেগম৷ বাবা ছিলেন গ্রামের কৃষক৷ অভাব অনটনের সংসারে বড় হন মীরা৷ লেখাপড়ার সুযোগ পাননি তিনি৷ বরং স্থানীয় যাত্রাদলে যোগ দেন কিশোরী মীরা৷ যাত্রাদলে অভিনয় করে অর্থ উপার্জন করে সংসারে খরচ দিতেন৷ কিন্তু ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে যাত্রামালা বন্ধ হয়ে যায়৷
এসময় তিনি কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজে সম্পৃক্ত হন সে সম্পর্কে মীরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শেখ মুজিবের ভাষণের পর এলাকার স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা সবাই আলোচনা করতো৷ আমি সেখানে যেতাম, শুনতাম৷ ওরা আমাকে বলতো, তুমি মূর্খ মানুষ৷ এগুলো তুমি কী বুঝবা? আমি বলতাম, হ্যাঁ, আমি বুঝি না কিন্তু আবার তোমাদের চাইতে বেশিও বুঝি৷ তারপর যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের গ্রামে পাক বাহিনী এবং রাজাকাররা ঘোরাঘুরি করতে শুরু করে৷ একদিন আমি হেঁটে যাচ্ছি তো দেখি একদল পাক সেনা যাচ্ছে৷ সেজন্য সবাইকে দেখি দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে৷ আমি বললাম, দৌড়াও কেন৷ ওরা আমাদের কী করবে? ওরাও মানুষ, আমরাও মানুষ৷ তো আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাক সেনারা জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী? নাম বললাম৷ তখন জিজ্ঞেস করে তুমি কি মুসলমান? আমিও ছোটতে এক বিহারির বাড়িতে কাজ করতাম বলে কিছু উর্দু বলতে পারতাম৷ তো বললাম, মুসলমান না তো কী? আমি তো মুসলমান৷ এরপর দেখি এক রিকশাওয়ালাকে তারা মারবে৷ তখন আমি বললাম, ঐ লোক তো মুসলমান৷ দেখো না সুন্নাতি দাড়ি আছে৷ আমার কথা শুনে তাকে আর মারলো না৷ বরং তাকে ছেড়ে দিল৷''
এছাড়া মীরার মা ওয়াপদা কলোনির এক কর্মকর্তার বাড়িতে কাজ করতেন৷ সেই কলোনিতে পাকসেনা ও রাজাকারদের আসা-যাওয়া ছিল৷ ফলে মীরার সাথে তাদের দেখা হতো৷ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম খোকন এই সুযোগটাকে কাজে লাগান৷ তিনি মীরাকে পাকসেনাদের হামলা, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচার-অনাচারের কথা বোঝান৷ ফলে মীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে থাকেন৷ পাকসেনাদের ও রাজাকারদের খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন৷ এ বিষয়ে মীরা জানান, ‘‘আমি অনেক সময় ভিক্ষুক সেজেও পাক সেনাদের শিবিরে যেতাম৷ ওদের কাছে গিয়ে খেতে চাইতাম৷ কিছু কথা বলতাম৷ ওরা একজন কাজের মহিলা জোগাড় করে দিতে বলে৷ তো আমাদের এলাকার বৃদ্ধ মহিলাকে সেখানে কাজের জন্য দিয়েছিলাম৷ তার কাছেও যেতাম এবং গল্প করতাম৷ আর সেসব খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতাম৷''
তবে মীরার দেওয়া তথ্য অনুসারে মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় রাজাকার রজব আলিকে হত্যা করা পর, মেহেরুন্নেসা মীরার পক্ষে আর এলাকায় অবস্থান করা সম্ভব হয়নি৷ কারণ এই ঘটনার জন্য পাক সেনা ও রাজাকাররা মীরাকে সন্দেহ করতে থাকে৷
মীরার ভাষায়, ‘‘রজব আলি কোন সময় বের হয়ে যায়, আর কোন সময় বাসায় ঢোঁকে এ তথ্য দেওয়ার পর আমাদের এখানকার এক হিন্দু ছেলে কেষ্ট তাকে গুলি করে মারে৷ এরপর আমি আর গ্রামে থাকতে পারিনি৷ কারণ তারা আমাকে সন্দেহ করল যে, এই মেয়ে ছাড়া এসব খবর আর কেউ পেতে পারে না৷ ফলে তারা আমার বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের উপর চাপ দিতে থাকে৷ এমনকি আমার বাবার উপর অত্যাচার করতে থাকে৷ তখন আমাদের গ্রামের এক দারোগা সাহেবের ছেলে সিরাজুল হক আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে নিয়ে যায়৷ এরপর মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে বিভিন্ন কাজের ধরণ শিখিয়ে দেয়৷ সেই অনুসারে আমি কাজ করতে থাকি৷ অনেক সময় আমার হাতে ছাপানো লিফলেট দিয়ে দিয়েছে৷ আমি সেগুলো নিয়ে ফকির বেশে সাধনার মোড়ে গিয়ে কাগজগুলো চুপ করে ফেলে দিয়ে অন্য রিকশা নিয়ে চলে যেতাম খাদ্দার মোড়৷ আবার সেখান থেকে কলেজে গিয়ে কিছু কাগজ ফেলে দিয়ে চলে যেতাম গোপালঘাটি৷ তখন অন্ধকার হয়ে আসতো৷ আমি ঘাটে গিয়ে মাঝিকে আকাশ বলে ডাকতাম৷ সে বুঝতো যে মাঝিকে ডাকছি৷ সে তখন আমাকে নদীর ওপারে পৌঁছে দিত৷ আমি তখন হাঁটতে হাঁটতে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে চলে যেতাম৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ