পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোট রবীন্দ্রময়। তৃণমূল এবং বিজেপি দুই পক্ষই রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরছে শিক্ষিত বাঙালির মন পেতে।
বিজ্ঞাপন
মৃত্যুর এত বছর পরেও তৃণমূল এবং বিজেপির সংকীর্ণ রাজনীতির চক্রে আটকে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নতুন এই বিতর্ক বেড়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বোলপুর সফরকে কেন্দ্র করে।
রোববার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন অমিত শাহ। সেখানে একটি রোড শো-ও করেন তিনি। তার আগে বিশ্বভারতী ঘুরে দেখেন। যান রবীন্দ্রনাথের বাড়ি এবং উপাসনাগৃহে। এরপর বাউল বাসুদেব দাসের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করেন। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্যের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে ঘুরে দেখে সাংবাদিকদের শাহ বলেছেন, সুযোগ পেলে সাত দিনের ছুটি নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাবেন এবং রবীন্দ্রসংগীত শুনবেন। একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথায় রাজনীতি খোঁজার কারণ নেই। কিন্তু ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবহে তা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। আলোচনায় উঠে আসছে আরো বেশ কিছু তথ্য।
খোয়াইয়ের হাট
শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি মানেই লাল মাটির ঢাল আর ইউক্যালিপটাস বনের খোয়াই৷ প্রতি শনিবার সেই খোলা জায়গাতেই বসে হাট৷ নানাবিধ হস্তশিল্পের পসরা নিয়ে এই হাট এখন শান্তিনিকেতনের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কাঁথার কাজ
বীরভূম জেলার এই অঞ্চলের কাঁথার কাজ বেশ বিখ্যাত৷ খোয়াইয়ের হাটের পসরার এক বড় অংশ এই কাঁথার কাজ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
সাঁওতাল নাচ
এক বড় সাঁওতাল বসত আছে শান্তিনিকেতনের লাগোয়া গ্রামগুলিতে৷ সাঁওতালদের নাচও খোয়াই হাটের অন্যতম আকর্ষণ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
হাতে আঁকা ছবি
শান্তিনিকেতনের কলা ভবনের ছাত্র-ছাত্রীরাও কেউ কেউ আসেন তাঁদের হাতে আঁকা ছবির সম্ভার নিয়ে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ঝুটো গয়না
জাঙ্ক জুয়লারি, বা ঝুটো গয়নার জন্যেও শান্তিনিকেতন প্রসিদ্ধ৷ তারও অঢেল আয়োজন থাকে খোয়াইয়ের হাটে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
আদিবাসী শিল্প
তালপাতার ফুল, কুড়নো কাঠের ভাস্কর্য — যার ঐতিহ্য বহু বছরের, সেসব নিয়ে আদিবাসী শিল্পীরা নিজেরাই আসেন এই হাটে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
চট, বেত
চট, বা বেতের ব্যাগ এই অঞ্চলের আরেকটি জনপ্রিয় হস্তশিল্প৷ অনেকেই কিনে নিয়ে যান এই গ্রামজ শৌখিনতা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ডোকরা শিল্প
প্রথাগত ডোকরা শিল্পেও এখন আধুনিক মননের ছোঁয়া৷ নানা ধরনের ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরি হয় ডোকরা রীতিতে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
পোশাকি বাহার
পোশাক তৈরির কাপড় থেকে তৈরি পোশাক, সবই মেলে খোয়াই হাটে৷ সব জামা-কাপড়েই স্থানীয় সূচিশিল্পের উজ্জ্বল অলঙ্করণ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
খুদে শিল্পীর পসরা
নেহাতই কমবয়সি, সদ্য হাত পাকিয়েছে হস্তশিল্পে, কিন্তু তার কাজও সমানভাবে নজর কাড়ে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বাউল গান
হাটের মাঝে জায়গায় জায়গায় বসে বাউল গানের আসর৷ অনেকেই গোল হয়ে ঘিরে বসে শোনেন সেই গান৷ খুশি হয়ে পাঁচ-দশ টাকা সম্মানদক্ষিণা দিয়ে যান৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
খাওয়া দাওয়া
মেলা হবে, কিন্তু ভালো-মন্দ খাওয়ার আয়োজন থাকবে না, তাও কি হয়! খোয়াই হাটেও আছে রকমারি খাবারের সম্ভার৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
থেকে যায় সুর
সন্ধে নামলে মেলা ভাঙে৷ যে যার বাড়ি ফেরেন৷ কিন্তু কানে থেকে যায় বাউল গানের সুর৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
12 ছবি1 | 12
শাহের সফরের আগেই তৃণমূল অভিযোগ করেছিল, বিজেপি শাহের বোলপুর সফর নিয়ে যে ব্যানার তৈরি করেছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের ছবি ছোট, শাহের ছবি বড়। শাহকে পশ্চিমবঙ্গে বহিরাগত বলেও কটাক্ষ করা হয়েছিল। শান্তিনিকেতনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনৈতিক প্রচার চালাতে এসেছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছিল রাজ্যের শাসক দলের তরফে।
যে অভিযোগ তৃণমূল তুলেছে, সেই অস্ত্রে তৃণমূলকেই অভিযুক্ত করা যায়। এ বছর রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ২৫ বৈশাখ পালনের সময় বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছিল, তৃণমূলের নির্দেশে পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান চালানো হচ্ছে। দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব না কি এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ২৫ বৈশাখের অনুষ্ঠানে বড় বড় করে লেখা হয়েছে 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়'। যেন দলনেত্রীর অনুপ্রেরণা না থাকলে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করা যেত না। রাজ্যের বিরোধীরা সে সময় একাধিকবার অভিযোগ করেছে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতি করছে তৃণমূল। কয়েক মাস আগে পৌষমেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়া নিয়েও তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। অভিযোগ, তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা পাঁচিল ভাঙতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের আমলে তৈরি দরজাও ভেঙে দিয়েছে। সে সময়েও শান্তিনিকেতনে তৃণমূলের রাজনৈতিক দাদাগিরির অভিযোগ উঠেছিল। অবশ্য ২০১৬তে ভোটে জিতে রাস্তার মোড়ে, ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসংগীত বাজাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা।
শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন
দুই বাংলার সাংস্কৃতিক যোগসূত্রকে আরো শক্তিশালী করতে শান্তিনিকেতনে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ভবন৷ এর জন্য ২৫ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ৷ এখানে ৪৫০ আসনের প্রেক্ষাগৃহসহ একটি সংগ্রহশালা ও পাঠাগারও রয়েছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
শুভ উদ্বোধন
রবীন্দ্রনাথের সার্ধ-শতবর্ষের সময়ই শান্তিনিকেতনে এই ভবন গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন শেখ হাসিনা৷ তখন থেকেই তিনি প্রতীক্ষায় ছিলেন৷ শুক্রবার সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো৷ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে উদ্বোধন হলো বাংলাদেশ ভবনের৷ আশা, ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নতুন অধ্যায় খুলে যাবে এবার৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
আনন্দযজ্ঞ
বাংলাদেশ ভবনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থের সংগ্রহ নিয়ে একটি পাঠাগার তৈরি করা হয়েছে৷ সাধারণের ব্যবহারের করার কথা ভেবেই বাড়িটিতে একটি ক্যাফেটোরিয়াও রাখা হয়েছে৷ গত এপ্রিলের মাঝামাঝি বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর শান্তিনিকেতনে এসে বাড়িটির চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ তদারকি করে গিয়েছিলেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে চাঁদের হাট
বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনের দিন শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা৷ ছিলেন বহু রবীন্দ্র অনুরাগীও৷ এদিনই ছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবর্তন৷
ছবি: DW/P. Samanta
কবি ও মুজিবুর
বাংলাদেশ ভবন যে শান্তিনিকেতনের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই৷ বাংলাদেশ ভবনের প্রবেশদ্বারের দুই প্রান্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুরাল’ স্থাপন করা হয়েছে৷ ভেতরেও দেখা মিলবে তাঁদের৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
স্মারক
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসভিত্তিক সংগ্রহশালায় দেখা মিলবে জানা-অজানা কিংবা চেনা অচেনা বস্তুর৷ কিন্তু রবীন্দ্র অনুরাগী মাত্রেই জানেন পদ্মার বোটের প্রতিরূপটির কথা৷ কবিগুরুর জীবনের একটা বিশেষ সময় কেটেছে বাংলাদেশে৷ সেই সব স্মৃতিকে নিয়ে গড়া হয়েছে বাংলাদেশ ভবনের গ্যালারি৷ এখানেই ঠাঁই দেওয়া হয়েছে কবিগুরুর বাংলাদেশে কাটানোর নানা স্মৃতিবাহী স্মারক, ছবি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
পায়ে পায়ে শান্তিনিকেতন
বিশ্বভারতীতে আজকাল পর্যটকদের জন্য প্রায়ই যানজট হয়৷ ব্যক্তিগত গাড়ি বা টোটোর উৎপাতে অনেকেই অতিষ্ঠ হয়ে যান৷ তবে এমন আনন্দঘন মুহূর্তকে ধরে রাখতে কেউ কেউ পায়ে পায়েই বেরিয়ে পড়েছেন৷ পুলিশি নিরাপত্তায় শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন ভবনগুলি আর বিখ্যাত মনীষীদের বাড়িগুলিও দেখে নিয়েছেন তাঁরা৷ ছবিতে অমর্ত্য সেনের বাড়ি ‘প্রতীচী’৷
ছবি: DW/P. Samanta
আলোকিত মঞ্চ
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রথমবার শান্তিনিকেতনে এলেন বিশ্বভারতীর আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ সঙ্গে ছিলেন দুই বাংলার দুই নেত্রী৷ কাজেই তিস্তার জলবণ্টন সমস্যা বা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে কোনো কথাই হয়নি, এটা ভাবা যায় না! বাংলাদেশে এ বছরই সাধারণ নির্বাচন৷ তাই শেখ হাসিনার এই পশ্চিমবঙ্গ সফর বাড়তি তাৎপর্য পাচ্ছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
7 ছবি1 | 7
শাহের সফরে একই ধরনের রাজনীতির অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। শান্তিনিকেতনের একাংশের ছাত্র অভিযোগ করেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর ঘিরে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়, তার জন্য বেশ কিছু ছাত্রকে কার্যত গৃহবন্দি করে রেখেছিল পুলিশ। বিশ্বভারতীর ছাত্র ফাল্গুনী পান সোশ্যাল নেটওয়ার্কে লিখেছেন, তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে বাউলের বাড়িতে অমিত শাহ দুপুরের খাবার খেয়েছেন, তাঁর পরিবারকেও দুইদিন বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। বাজার হাটে পুলিশের সঙ্গে যেতে হয়েছে। এমনিতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোথাও গেলে এ ধরনের প্রোটোকল মানতেই হয়। কিন্তু অভিযোগ উঠছে, শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যের সঙ্গে এ ধরনের প্রোটোকল মেলে না।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শান্তিনিকেতনের এক স্বনামধন্য আশ্রমিক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, এক সময় জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে আসতেন। তাঁরাও দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু শান্তিনিকেতনে তাঁরা কোনো প্রোটোকলের ধার ধারতেন না। তাঁরা আশ্রমিকদের বাড়িতে খেতেন। মেলায় ঘুরতেন। বিশিষ্ট শিল্পী, অধ্যাপকদের বাড়িতে আড্ডা মারতেন। কিন্তু এত প্রোটোকলের বিষয় থাকতো না। ইদানীং প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর নিয়ে যে কাণ্ড চলছে, তা অনভিপ্রেত এবং শান্তিনিকেতনের ঐাতিহ্যের বিরোধী।
তৃণমূল এবং বিজেপি দুই দলই ভোটের সময় শান্তিনিকেতনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে বলে রাজ্যের বহু বিশিষ্ট মানুষের অভিমত। রবীন্দ্রনাথকে এ ভাবে সংকীর্ণ রাজনীতির মধ্যে টেনে আনার বিরোধিতা করছেন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের একাংশ।