ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গ্রেপ্তার রসরাজের মুক্তি চেয়েছেন তার মা৷ এক সংবাদ সম্মেলনে দরিদ্র হিন্দু মাছবিক্রেতা রসরাজের মা নমিতা রানী দাস দাবি করেন, তাঁর সন্তান নির্দোষ৷ এর আগে তদন্ত শেষে পুলিশও জানিয়েছে রসরাজ নির্দোষ৷
বিজ্ঞাপন
রসরাজ দাস ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্ট করেছেন – এমন অভিযোগ তুলে গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির এবং বেশ কিছু বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে৷ সেদিনের পরও সেখানে কয়েকবার হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷
অথচ ঘটনার পরই গণমাধ্যমের খবরে রসরাজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়৷ স্থানীয়ভাবে জানা যায়, যে সময় কথিত ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করা হয় তখন রসরাজ নিজের মোবাইল ফোনের কাছে ছিলেন না৷ তখন মোবাইল ছিল বাড়িতে আর তিনি বিলে মাছ ধরছিলেন৷
আরো জানা যায়, লেখাপড়া না জানা রসরাজ ফটোশপে এমন ছবি তৈরি করে ফেসবুকে দিতে পারেন কিনা এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে৷
অবশ্য হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা শুরুর আগেই রসরাজকে আটক করে পুলিশ৷ তারপর তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়৷ নাসিরনগরের হরিণবেড় গ্রামের ৩০ বছর বয়সি জেলে রসরাজ এখনো কারাগারে৷
এদিকে তদন্ত শেষে পুলিশ জানিয়েছে, ধর্ম অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার সঙ্গে রসরাজের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ বরং গত ২১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সংবাদ মাধ্যমকে জানান, জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তি নিজের সাইবার ক্যাফে থেকে রসরাজের ফেসবুক আইডি ‘হ্যাক' করে ‘ধর্মীয় অবমাননার' ছবি পোস্ট করেন৷ ইতিমধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে৷
শুক্রবার ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, রসরাজের মা নমিতা রানী দাস ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তার ছেলেকে ‘নির্দোষ' দাবি করে বলেছেন, রসরাজ লেখাপড়া জানে না; তার পক্ষে ফেইসবুকে কোনো কিছু লেখাও সম্ভব নয়৷
বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব)-এর কার্যালয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপস্থিতিতে নমিতা রানী দাস বলেন, ‘‘আমার ছেলে পড়াশুনা জানে না৷ কোনোদিন ইস্কুলে যায়নি৷ বড় ভাই আর বাবার সঙ্গে বালিঙা বিলে মাছ ধরত৷'' এ সময় তিনি নাসিরনগরের ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি ও হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণও দাবি করেন তিনি৷
নাসিরনগরের হিন্দুরা এখন যেমন আছেন
এক ব্যক্তি ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে- এই অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু জনপদে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ শতাধিক বাড়ি ও বেশ কিছু মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজের বাড়ি-ঘরে হামলা
যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছে তার নাম রসরাজ দাস৷ অভিযোগ ওঠার পরই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তারপরও হামলা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং হবিগঞ্জের মাধবপুরের হিন্দুদের অনেক বাড়ি এবং মন্দিরে৷ নাসিরনগর সদর থেকে ১৬ কিমি. দূরে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে রসরাজের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজ কি সত্যিই ধর্ম অবমাননা করেছে?
২৮শে অক্টোবর রসরাজের ফেসবুক পাতায় ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করা হয় বলে দাবি করা হয়৷ রসরাজ জানিয়েছে, কেউ হ্যাক করে এটি করেছে৷ তারপরও নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবিটি পোস্ট হওয়ায় ক্ষমা চেয়েছেন তিনি৷ তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রসরাজ মাত্র ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে৷ ফলে ফটোশপ করে ছবি ফেসবুকে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে কিনা এই প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Khukon Singha
ফটোশপ করতে জানেন না রসরাজ
এদিকে গ্রেপ্তার করার পর রসরাজকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ৷ নাসিরনগর ঘুরে এসে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ফোর-ফাইভ ক্লাস পাস ঐ যুবকের ফটোশপে কাজ করার মতো দক্ষতা নাই৷ আমরা সরেজমিন তদন্তে ধারণা করছি, একটি সাইবার ক্যাফে থেকে এ কাজ করা হয়েছে৷’’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং মানবাধিকার কর্মীরাও একই কথা বলেছেন৷
ছবি: Khukon Singha
পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়
ধর্ম অবমাননার কথা বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের সময় পুলিশ হামলাকারীদের রুখতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতরা৷
ছবি: Khukon Singha
আবারও হামলা
৩ নভেম্বর আবার হামলা হয় নাসিরনগরে৷ হিন্দুদের বেশ কিছু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া গত কয়েকদিনে গোপালগঞ্জ, রংপুর, বরিশাল, ঠাকুরগাঁওসহ আরো কয়েকটি জায়গায় হিন্দুদের মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি বাড়ি৷
‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে বিক্ষোভ
রসরাজের শাস্তি দাবিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে রোববার বিক্ষোভ-সমাবেশের পরপরই নাসিরনগরে এবং পাশের এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলে পড়ে একদল যুবক৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি৷
ছবি: Khukon Singha
স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতা বহিষ্কার
হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় তিন নেতাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ৷ হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ৷
ছবি: Khukon Singha
চলছে ঘর-বাড়ি ঠিক করার কাজ
পুড়ে যাওয়া ও ভাঙা ঘর-বাড়ি ঠিক করে কোনোমতে মাথা গোঁজার নিশ্চয়তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: Khukon Singha
মন্দিরের বেহাল দশা
এই পুরোহিতের চোখের ভাষা অনেক কিছুই বলে দেয়৷ মন্দিরগুলো কবে যে ঠিক করা হবে, কারো জানা নেই৷
ছবি: Khukon Singha
মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রতিমা
হামলার পর থেকে এখনো মন্দিরগুলোকে ঠিক করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি৷ তাই এই মন্দিরে প্রতিমা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাটিতে৷
ছবি: Khukon Singha
ক্ষতিগ্রস্তরা পাচ্ছেন না ত্রাণ
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৬ হাজার করে টাকা ও টিন দেয়া হয়েছে৷ ক্ষতির তুলনায় তা খুবই কম৷ তবে খোকন সিং ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, বেশিরভাগ পরিবার ছয় হাজার টাকাও পাননি৷ কেউ কেউ এক বান্ডিল টিনের সঙ্গে পেয়েছেন মাত্র তিন হাজার টাকা!