উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে বন্যাকবলিত৷ তবে ত্রাণ তৎপরতা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না৷ ফেসবুকে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকেই সরকারকে সেদিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
দৈনিক প্রথম আলো-তে প্রকাশিত ‘পাঁচ জেলায় বন্যার অবনতি: খাবার ও পানির সংকটে বানভাসি মানুষ' শীর্ষক প্রতিবেদনে জামালপুরের বন্যাকবলিত ওসমান গনির মন্তব্য ছাপা হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘১৫ দিন ধরে পানিতে, অথচ একবার কেউ খোঁজ নিল না৷ দিল না একটু ত্রাণ৷'' তাই গত দুই সপ্তাহ ধরে পানিতে নিমজ্জিত ঘরের মধ্যে পরিবার নিয়ে তিনি অর্ধাহারে-অনাহারে বাস করছেন বলে জানিয়েছে পত্রিকাটি৷
এ প্রসঙ্গে ইমরান এইচ সরকার ফেসবুকে একটি মানবিক আবেদন জানিয়েছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চল মারাত্মকভাবে বন্যায় প্লাবিত৷ বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলা৷ ইতোমধ্যেই কয়েক লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে, পানিবন্দি আছে লাখ লাখ মানুষ৷ এখন পর্যন্ত এ সব দুর্গত মানুষের পাশে বড় পরিসরে কেউ দাঁড়িয়েছে, আমার চোখে পরেনি৷ আরো হতাশাজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ নিয়ে কারো কোনো উচ্চবাচ্যও আমার চোখে পরেনি৷ অথচ ঢাকা শহর কিংবা কোনো এলিট অঞ্চলে এর এক শতাংশ মানবিক বিপর্যয় হলে হয়ত দেশে এতক্ষণে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যেত!''
বিনা দোষে ভুগছে বাংলাদেশ
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে বাংলাদেশের তেমন কোনো অবদান নেই৷ তবে এর ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ঘরবাড়ি হারাচ্ছে উপকূলের মানুষ৷ অসময়ে বন্যা, খরা ও লবণাক্ত পানি ফসলের ক্ষতি করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জলবায়ু পরিবর্তন
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ৷ উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে৷ ফলে উপকূলের মানুষ বাসস্থান হারাচ্ছেন৷ অসময়ের বন্যা, খরা ফসলের ক্ষতি করছে৷ মোটের উপর লবণাক্ত পানি চাষ উপযোগী জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে৷
ছবি: dapd
বাড়ছে পানি, বাড়ছে ভোগান্তি
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা অনুযায়ী, ২১০০ সাল নাগাদ যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন হেক্টর জমি প্লাবিত হতে পারে৷ সম্প্রতি সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি পরিমাপ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জলবায়ু উদ্বাস্তু
বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থী বিষয়ক সংগঠন এসিআর-এর মুহাম্মদ আবু মুসা চলতি বছর ডয়চে ভেলেকে জানান, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে৷ আর বাংলাদেশে সংখ্যাটা হবে প্রতি সাতজনে একজন৷ দেশের ১৭ ভাগ এলাকা বিলীন হয়ে যাবে সমুদ্র গর্ভে৷ ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন৷
ছবি: Jewel Samad/AFP/Getty Images
লবণাক্ত পানি
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি সমতল ভূমির আরো ভেতরের দিকে চলে আসছে৷ ফলে লবণাক্ততা বাড়ছে৷ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলে ইতিমধ্যে এ সমস্যা সনাক্ত করা হয়েছে৷ পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: DW
মাছের উৎপাদন কমছে
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাছ উৎপাদনের উপর৷ মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে খাল, বিল, প্লাবনভূমিতে সময় মতো পানি না পৌঁছানোয় দেশীয় মাছের প্রজনন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
ক্ষতির শিকার সুন্দরবন
জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ শীর্ষক ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের নানা কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷ ইতোমধ্যে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহীনের ক্যাম্প মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্প সাগরে হারিয়ে গেছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জার্মানির সহায়তা
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রায় ১১ মিলিয়ন ইউরো বা ১১২ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা দিতে গত বছর এক চুক্তি স্বাক্ষর করে জার্মানি৷ এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের তিনটি উপকূলীয় জেলায় দুর্যোগ সহনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ ২০১২-২০১৭ মেয়াদে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে৷ এসব প্রকল্পের মধ্যে আছে টেকসই রাস্তা-ঘাট, সেতু ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ৷
ছবি: DW
জলবায়ু তহবিল
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দিতে বিভিন্ন সম্মেলনে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক সমাজ৷ তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব সহায়তা পুরোপুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ একইসঙ্গে জলবায়ু তহবিল বণ্টনের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ সব মিলিয়ে এক্ষেত্রে আরো সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
তিনি সবাইকে বন্যাকবলিত দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘#IceBucketChallenge কিংবা #RiceBucketChallenge – এ সব চ্যালেঞ্জ কি আমরা আমাদের বন্যার্ত অসহায় ভাই-বোনদের জন্য করতে পারি না?''
উল্লেখ্য, ফেসবুকে অনেকেই ‘রাইস বাকেট চ্যালঞ্জ'-এর ছবি পোস্ট করছেন৷ একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী নিজে কোনো গরিব মানুষকে এক প্যাকেট চাল দিয়ে সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে আরও সাতজনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন৷
যুক্তরাষ্ট্রের ‘আইস বাকেট চ্যালেঞ্জ'-এর মতো করে ভারতে কদিন আগে ‘রাইস বাকেট চ্যালেঞ্জ' শুরু হয়৷ এরপর বাংলাদেশেও সেটা চলছে৷ ৩০ আগস্ট তারিখে আরিফ আর হোসেন নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘‘আসুন শুরু করি #RiceBucketChallenge৷ আমি যাদেরকে নমিনেট করবো; তারা, রাস্তায় সুবিধাবঞ্চিত যে কাউকে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী এক বাকেট/প্যাকেট চাল দিয়ে আসবেন....এসে, সেই ছবি আপলোড দিবেন এবং তারপর আপনি নমিনেট করবেন আপনার পছন্দ মতো ৭ জনকে৷....এই ৭ জন যদি আরও ৭ জনকে নমিনেট করে....আর প্রত্যেকে যদি শুধু ১ কেজি চালও দেয়....আর এভাবে যদি মাত্র ১০টা স্টেইজও পার হয়....তাহলে বিতরণকৃত চালের পরিমাণ কতো দাঁড়াবে জানেন????? কয়েক হাজার কেজি না....কয়েক লক্ষ কেজিও না....২৮ কোটি কেজির বেশি৷''
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্ষম ধান
বাংলাদেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে নানাভাবে৷ কৃষিও রয়েছে এর মধ্যে৷ তবে আশার কথা, এই প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম কিছু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
বাংলাদেশেই উদ্ভব
বাংলাদেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে নানাভাবে৷ কৃষিক্ষেত্রও এর মধ্যে রয়েছে৷ তবে আশার কথা, এই প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম কিছু ধানের জাত উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ব্রি-র মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস৷
ছবি: N.Nanu/AFP/Getty Images
লবণাক্ততা
উপকূলীয় অঞ্চলে যেখানে জমিতে লবণের পরিমাণ বেশি সেখানে রোপা আমন মৌসুমে ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩ ও ব্রি ধান৫৪ – এই চারটি জাত বেশ কার্যকর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বোরো ধান
লবণাক্ত পরিবেশে জন্মানোর জন্য বোরো ধানের জাতের মধ্যে রয়েছে ব্রি ধান৪৭ এবং ব্রি ধান৬১৷
ছবি: CC/Rishwanth Jayaraj
খরা
খরা মোকাবিলায় সক্ষম দুটো উন্নত জাত হলো ব্রি ধান৫৬ এবং ব্রি ধান৫৭ – দুটোই রোপা আমন ধানের জাত৷ ‘‘আরও কিছু নতুন জাত আমাদের হাতে আছে যেগুলো খরায় আরও ভালো করবে,’’ জানিয়েছেন ব্রি মহাপরিচালক৷
ছবি: AP
হঠাৎ বন্যা
ড. বিশ্বাস বলেন, রোপা আমন মৌসুমে আরেকটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন ধান লাগানোর পরে দেখা যায় যে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হঠাৎ করেই পানির নীচে ডুবে যায়৷ ‘‘এই অবস্থা প্রায় সপ্তাহখানেক বা তারও বেশি সময় ধরে থাকে৷ এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রয়েছে ব্রি ধান৫১ ও ব্রি ধান৫২৷’’
ছবি: N.Nanu/AFP/Getty Images
অতি ঠান্ডা, অতি গরম
এই পরিস্থিতির জন্য এখনো কোনো ভালো জাত নেই৷ তবে ব্রি মহাপরিচালক বলেছেন, ‘‘গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলছে এবং আমরা আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে এমন ধানের জাত আমরা হাতে পেয়ে যাব৷’’
ছবি: DW/P. Mani Tewari
প্রচারণা
সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে কৃষকদের ব্রি উদ্ভাবিত এসব জাত সম্পর্কে জানানো হয়৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
আরিফ আর হোসেন-এর উদ্যোগে সাড়া দিয়ে ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসছে৷ রকমারি ডটকম তাদের ফেসবুক পেজে চাল বিতরণের ছবি দিয়ে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে৷ ঐ পেজে লেখা হয়েছে, ‘‘আরিফ রেজা হোসেন ভাই #RiceBucketChallenge ঘোষণা করেছেন৷...আরিফ ভাই এর মনোনয়ন লিস্টে শুধু ব্যক্তিগত আইডিই ছিল৷ কোনো প্রতিষ্ঠানের ভাবনা হয়ত ভাইয়ার মাথায় ছিল না৷ কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ এর আইডিয়ার সাথে আমরা পুরোপুরি একমত৷ অনেকেই হয়ত ব্যাপারটাকে পাগলামি, দুই দিনের খেয়াল, হুজুগ বলবেন৷ আবার অনেকে বলবেন এই আইডিয়া তো প্রথমে অন্য কেউ বা কোথাও জেনারেট হয়েছে৷ তাতে কি? আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো কার্যকর আইডিয়া প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সেটা কি সফলতা না? একটু ভেবে দেখুন, দুই দিনের একটি পরিবর্তন দিয়েই কিন্তু শুরু করতে হয়৷ আর একবার শুরু হলে ব্যাপারটা স্থায়ী না করা পর্যন্ত যে হুজুগে বাঙালি জাতি থামে না, অতীতে কিন্তু এর প্রমাণ অনেক বার পাওয়া গেছে৷''