মিয়ানমার সরকারের একটি তদন্ত প্যানেল রাখাইনে সেনা অভিযানের সময় রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে৷ তবে তারা সেখানে গণহত্যার কোনো প্রমাণ পায়নি৷
বিজ্ঞাপন
সরকার নিযুক্ত ওই প্যানেল সোমবার তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ গ্রামবাসী ও সেনাসদস্যদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে৷
আইসিওই-র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর দমনাভিযানের সময় সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ তারা পেয়েছেন৷ এসব ঘটনার জন্য ‘নানা ভূমিকায়' থাকা লোকজনের মধ্যে সেনা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন এমন সিদ্ধান্তে আসার মতো ‘বাস্তব প্রমাণ' পাওয়া গেছে৷
কোন দেশে কত রোহিঙ্গা
১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মা রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে নিজভূমে অধিকার পাননি রোহিঙ্গা মুসলমানরা৷ সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ১৯৭০ থেকে দেশ ছাড়তে শুরু করেন তারা, এ পর্যন্ত ১৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Yasin
বাংলাদেশ
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন রোহিঙ্গারা; এই সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে পৌঁছে যায় সাত লাখে৷ আর আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা৷
ছবি: Reuters
পাকিস্তান
দুই লাখের মত রোহিঙ্গা বর্তমানে পাকিস্তানে বসবাস করছেন৷ ১৯৪২ সালে বর্মায় সামরিক অভিযানের পর তারা পাকিস্তানে যেতে শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Yasin
থাইল্যান্ড
মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথ হিসেবে রোহিঙ্গারা থ্যাইল্যান্ডকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করত৷ এই দেশটিতে এখন এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Pruksarak
মালয়েশিয়া
ইউএনএইচসিআর এর হিসেব অনুযায়ী ৫৯ হাজার রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় রয়েছেন৷ দেশটি জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী না হওয়ার রোহিঙ্গাদের শরণার্থীদের স্বীকৃতি দেয়নি৷ এখন তারা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/C. Archambault
ভারত
মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে গিয়ে বসবাস করছে৷ সীমান্তপথে ভারতে অনুপ্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গ, জম্মু ও আসামে বসবাস করছেন তারা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Qadri
যুক্তরাষ্ট্র
এশিয়ার দেশগুলোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ হাজারের মত রোহিঙ্গা বসবাস করছে৷ মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার এই জনগোষ্ঠীকে ২০০২ সাল থেকে সেখানে থাকতে দেওয়া হচ্ছে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিকাগোতে বসবাস করে৷
ছবি: DW/A. Islam
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় ১১ হাজার ৯৪১ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী রয়েছে৷ মালয়েশিয়ার মতো ইন্দোনেশিয়াও জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী না হওয়ায় তারা প্রথমে রোহিঙ্গাদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়৷ পরে এদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
নেপাল
নেপালে এখন ২০০ জন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন৷ বাংলাদেশে ও ভারত হয়ে এরা নেপালে চলে যায়৷
ছবি: picture-alliance/abaca/O. Elif Kizil
8 ছবি1 | 8
যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওইসব ঘটনার মধ্যে ‘নিরাপরাধ গ্রামবাসীকে হত্যা ও তাদের বাড়িঘর ধ্বংস' করার ঘটনাও আছে৷ কিন্তু তাদের বিবৃতিতে ৩০টি পুলিশ পোস্টে হামলার জন্য রোহিঙ্গা জঙ্গিদের দায়ী করে ওই হামলাই দমন অভিযানের ‘সূচনা' করেছে মন্তব্য করে পরিস্থিতিকে ‘অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত' বলে বর্ণনা করা হয়৷
তবে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের কথা স্বীকার করলেও গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানায় আইসিওই৷ বলা হয়, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে মুলসমান বা অন্য কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা পরিকল্পনা করে হত্যা বা বিতাড়ন করার যথেষ্ট প্রমাণ আইসিওই পায়নি৷
‘‘এসব অপরাধ কোনো ধর্মীয় বা জাতিগত, নৃগোষ্ঠী বা জাতিকে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে গণহত্যা বিবেচিত হওয়ার মত মানসিকতা নিয়ে করা হয়নি৷ সিদ্ধান্তে আসা তো দূরের কথা, এটা নিয়ে বিতর্ক করার মত যথেষ্ট প্রমাণই নেই৷''
তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের একদিন পর মিয়ানমার সরকার ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে ‘একমত' বলে জানান প্রেসিডেন্ট উয়িন মিন্ট৷ তিনি বিশেষ করে বেসামরিক নাগরিক এবং রোহিঙ্গা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে অধিকতর তদন্তের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন৷
প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ৷ তবে দ্বীপটি ঘূর্ণিঝড়প্রবণ হওয়ায় তা রোহিঙ্গাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: DW/A. Islam
মূল ভূখন্ড থেকে দূরে
বিশ বছরেরও কম সময় আগে ভাসান চর জেগে উঠেছিল৷ বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে এটি ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত৷ সেখানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে যেতে চাইছে বাংলাদেশ৷
ছবি: DW/A. Islam
যাওয়া সহজ নয়
ভাসান চরে যেতে সাধারণ মানুষের উপযোগী কোনো বাহন নেই৷ ঐ দ্বীপের কয়েকজন দোকানি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, বর্ষার সময় সাগর উত্তাল থাকায় সাধারণ মাছ ধরার নৌকায় করে ভাসান চরে পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়৷
ছবি: DW/A. Islam
তিন মিটার উঁচু বাঁধ
উঁচু ঢেউ ও বন্যার হাত থেকে ভাসান চরকে বাঁচাতে সরকার ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও তিন মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ করেছে৷ এক দোকানি জানালেন, মাসে দু’বার বাঁধের বাইরের দিকে থাকা বাজার এক মিটার পর্যন্ত ডুবে যায়৷
ছবি: DW/A. Islam
একইরকম ভবন
রোহিঙ্গাদের জন্য ১,৪৪০টি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে৷ প্রতিটি ভবনে ১৬টি ঘর রয়েছে৷ ১২x১৪ ফুটের একেকটি ঘরে একটি পরিবারের অন্তত চার জন সদস্যকে থাকতে হবে৷ ঘূর্ণিঝড়ের সময় ব্যবহারের জন্য ১২০টি চারতলা আশ্রয়কেন্দ্রও নির্মাণ করা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
সৌরশক্তি
ভবনগুলোর জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সেগুলোতে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে৷ এছাড়া প্রয়োজনের সময় ব্যবহারের জন্য দুটি ডিজেল জেনারেটর ও বিশাল এক মাঠে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে৷ খাবার পানির জন্য রয়েছে নলকূপ৷ আরও আছে বৃষ্টির পানি থেকে খাবার পানি পাওয়ার ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/A. Islam
ক্ষয় রোধের ব্যবস্থা
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবিতে ২০০২ সালে প্রথম এই দ্বীপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়৷ এরপর কয়েকবার এটি স্থান পরিবর্তন করেছে৷ ভূমিক্ষয় ঠেকাতে সরকার চরটিতে তিন স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে৷
ছবি: DW/A. Islam
দ্বীপটি কি বাসযোগ্য?
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, দ্বীপটি এখনও বসবাসের উপযোগী নয়৷ তবে আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত মনে করছেন, বাঁধের উচ্চতা যদি সাড়ে ছয় থেকে সাত মিটার করা যায় তাহলে দ্বীপটি বসবাসযোগ্য হতে পারে৷ তবে ভাসান চরে ফসল ফলানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW/A. Islam
রোহিঙ্গাদের ভয়
কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গারা ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাঁদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়া হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাঁরা মারা যেতে পারেন৷ তবে প্রকল্পের প্রধান স্থপতি আহমেদ মুক্তা বলেন, ‘‘চরটি রোহিঙ্গাদের জন্য এক স্বর্গ৷’’
ছবি: DW/A. Islam
রোহিঙ্গারা কি ভাসান চরে যাবেন?
কয়েকটি সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে যে, নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে৷ তবে রোহিঙ্গারা সেখানে না গেলে গৃহহীন বাংলাদেশিদের ভবিষ্যতে সেখানে নিয়ে যাওয়া হতে পারে৷
ছবি: DW/A. Islam
9 ছবি1 | 9
সেখানে রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ এই তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘প্রকৃত অপরাধ ঢাকার চেষ্টা' বলে বর্ণনা করেন৷
বলেন, ‘‘বছরের পর বছর ধরে আমরা নিপীড়িত হচ্ছি৷ আমাদের অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে৷ যদি এসব গণহত্যা না হয় তবে গণহত্যা কাকে বলে?''