মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় শতাধিক হিন্দু রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে-এমনটাই জানিয়েছেন সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা হিন্দু অধিবাসীরা৷ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে পাঁচ শতাধিক হিন্দু নারী-পুরুষ ও শিশু৷
বিজ্ঞাপন
হামলা নির্যাতন এবং হত্যার মুখে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের কুতুপালং হরি মন্দিরের কাছে একটি মুরগির খামারে আশ্রয় নিয়েছেন তারা৷ তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ তারা জানিয়েছেন, ২৭ শে আগস্ট থেকেমিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকিয়াব জেলার মংডুর চিকনছড়ি, ফকিরা বাজার, সাহেব বাজার, পুরান বাজার ও রিক্কা পাড়াসহ কয়েকটি হিন্দু পাড়ায় হামলা ও নির্যাতন চালঅনো হয়৷ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা কুতুপালং গিয়ে পালিয়ে আশা হিন্দুদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ আর আতে নিশ্চিত হয়েছি যে মিয়ানমারে শতাধিক হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে৷''
‘তাদের কারো গায়ে বার্মার সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল না’
মংডুর চিকনছড়ি থেকে এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন বকুল বালা৷ তিনি বললেন, ‘‘আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি পাশেই ফকিরা বাজারে৷ আমার স্বামী অনিরুদ্ধ মেয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন৷ সেখানে আমার স্বামী, মেয়ে এবং আমার নাতিকে মেরে ফেলেছে৷ আমাদের বাড়িতেও হামলা হয়েছে৷ আমাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল৷ পরে আমরা পালিয়ে আসি৷ অনেককেই হত্যা করা হয়েছে৷''
সহিংসতার শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা
02:13
হামলাকারীর মুখোশ পরে এসেছিল বলে জানিয়েছেন চিকনছড়ি থেকে পালিয়ে আসা আরেক ব্যক্তি চিত্তরঞ্জন কর৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু চোখ ছাড়া পুরো শরীর কালো পোশাকে ঢাকা ছিল৷ তারা বার্মিজ এবং মংডুর স্থানীয় ভাষায় কথা বলছিল৷ তাদের কারো গায়ে বার্মার সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল না৷'' তিনি আরও জানান তাদের গ্রামের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে৷ বোমা মারা হয়েছে সেখানে৷ তাদের ধরে নিয়ে মুড়া পাহাড়ে ৭-৮ দিন বন্দি করে রাখা হয়েছিল বলে জানান তিনি৷ পরে সেখান থেকে পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন তারা৷
‘মংডুর হিন্দু পাড়ায় যা ঘটেছে তা যেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেও হার মানিয়েছে’
This browser does not support the audio element.
যেসব হিন্দু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছেন তাদের অধিকাংশই কতুপালং হরি মন্দিরের একটি মুরগির খামারে আশ্রয় নিয়েছেন৷ কিছু স্থানীয় হিন্দুদের বাড়িতেও আশ্রয় পেয়েছেন৷ হরিমন্দিরের সাধারণ সম্পাদক বাবুল শর্মা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এরা নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে প্রবেশ করেছেন৷ আমাদের এলাকায় এসেছেন ৫ দিন আগে৷ প্রায় সবাই পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন৷ স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন এরকম অনেকেই পালিয়ে এসেছেন৷ আমরা স্থানীয়রা তাদের একটি মুরগির খামারে থাকার ব্যবস্থা করেছি৷ কিছু মানুষকে বাড়িতেও আশ্রয় দিয়েছি৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ত্রাণ সহায়তা নেই এখানে৷''
‘আমার স্বামী, মেয়ে আর নাতিকে মেরে ফেলেছে’
This browser does not support the audio element.
রানা দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘ এদের সঙ্গে কথা বলে যা জেনেছি তা থেকে বলতে পারি মংডুর হিন্দু পাড়ায় যা ঘটেছে তা যেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেও হার মানিয়েছে৷ তাদের ওপর চাপাতি, কিরিচ, বন্দুক এবং বোমা দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে৷ প্রথমে বাড়ি ঘেরাও করে তাদের হাত পা চোখ বেঁধে তারপর নির্যাতন চালান হয়েছে৷ পাহাড়ে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে৷''
‘প্রায় সবাই পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন’
This browser does not support the audio element.
তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিশ্চিত হয়েছি পুরান বাজারে ৮৬ জন এবং অন্যান্য এলাকায় আরো ৩৫ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে৷ মোট নিহতের সংখ্যা ১২১ জন৷ সাহেব বাজারে মুসলিম যুবকরা হিন্দুদের উদ্ধার করে পালাতে সহায়তা করেছে৷ নয়তো নিহতের সংখ্যা আরো বাড়ত৷''
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর -এর হিসাব মতে রাখাইনে সেনা নির্যাতন শুরুর পর ২৫শে আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে৷ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যার খবর জানিয়েছে৷
ভুলে যাওয়া শরণার্থীরা: বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা
গত অক্টোবরে মিয়ানমারে দমনপীড়ন শুরুর পর ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন৷ কুতুপালংয়ের মতো জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তাদের অনেকের বাস৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
মিয়ানমার থেকে পালানো
মিয়ানমারে গত অক্টোবরে নয় পুলিশ হত্যার অভিযোগ ওঠে এক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর আবারো দমনপীড়ন শুরু হয়৷ ফলে সত্তর হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করেন সেগুলোর একটি এই কুতুপালং৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
স্বনির্ভরতা দরকার
কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপদ আছে বটে, তবে জীবন সেখানে মোটেই সহজ নয়৷ সেখানে সত্যিকারের কোনো অবকাঠামো নেই, সবই শরণার্থীদের গড়া অস্থায়ী আবাস৷ তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছেন, কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ করেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
শিশুদের খেলা নয়
আশ্রয়শিবিরটির অধিকাংশ এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই৷ কয়েক হাজার শরণার্থী শিশুর খেলোধুলারও কোন ব্যবস্থা নেই৷ ক্যাম্পের লেক থেকে মাটি সংগ্রহ করছে এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
কুঁড়েঘরে বসবাস
কাদা মাটি এবং সহজলভ্য অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করেন শরণার্থীরা, যাতে মাথার উপরে অন্তত ছাদ থাকে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
সেই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সেদেশে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব এবং ভোট দেয়ার অধিকার দিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
বাংলাদেশেও বৈষম্যের শিকার?
বাংলাদেশেও বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা৷ ক্যাম্পে আর জায়গা নেই- বলে বাংলাদেশে জলপথে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে তাদের নৌকাসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা৷ পাশাপাশি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি দুর্গম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, দ্বীপটি বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
নির্জন দ্বীপে সরিয়ে নেয়া
ঠ্যাঙ্গার চর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় কয়েকবছর আগে জেগে ওঠা এক দ্বীপ৷ শুধুমাত্র নৌকায় করে সেখানে যাওয়া যায় এবং চরটিতে অতীতে একাধিকবার জলদস্যু হানা দিয়েছে৷ এক উন্নয়নকর্মী সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে দ্বীপটিতে কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্বীকার করেছেন যে, ঠ্যাঙ্গার চরকে বসবাসের উপযোগী করতে আরো অনেক কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্বীপটিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে৷’’ তবে সরকার অতীতে এরকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি৷ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
ইতিহাস থেকে মোছার চেষ্টা
নিরাপদ আবাসভূমি না থাকায় রোহিঙ্গাদে ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার তাদের অতীত মুছে ফেলতে কাজ করছে৷ দেশটির সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যেখানে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না৷ গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়টি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
9 ছবি1 | 9
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷