মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শেষ হয়েছে বলে দাবি করেছে সে দেশের সরকার৷ চার মাস ধরে চলা এ অভিযানকে জাতিসংঘ ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ' এবং ‘আদিবাসী উচ্ছেদ অভিযান' হিসেবে উল্লেখ করেছে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে গত বছরের ৯ অক্টোবর নিরাপত্তা ঘাঁটিতে একটি হামলায় ৯ জন পুলিশ নিহত হওয়ার পর ঐ রাজ্যে নিরাপত্তা অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী৷ ঐ অভিযানের পর থেকে বাংলাদেশে গত চার মাসে ৬৯ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছে বলে ধারণা জাতিসংঘের৷ মিয়ানমারে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং টুন বুধবার এক বিবৃতিতে জানান, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল৷ সেনা অভিযান বন্ধ করা হয়েছে, এছাড়া কারফিউও শিথিল করা হয়েছে৷ কেবল শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে পুলিশ মোতায়েন আছে৷
প্রেসিডেন্টের অফিস বলছে ভিন্ন কথা৷ সেখানকার দুই সিনিয়র কর্মকর্তা এবং তথ্য মন্ত্রী রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে সেনা অভিযান বন্ধের ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন৷ তবে সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সেনাবাহিনী এখনও অবস্থান করছে বলে জানিয়েছেন তারা৷
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি৷
বুধবার রাতে কূটনীতিক এবং জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, অভিযানে কেউ যদি বলপূর্বক কিছু করে থাকে বা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হবে না৷ এদিকে, এই চার মাসে কী ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সে ব্যাপারে আলাদাভাবে দুটি তদন্ত দল গঠন করেছে৷ অং সান সুচি জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে অঙ্গীকার করার পরই দুটি তদন্ত দল গঠন করা হয়৷
অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সেনা অভিযানে দমন, পীড়ন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনায় বিশ্বের সমালোচনার মুখে পড়ে মিয়ানমার সরকার৷ একই সঙ্গে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে৷ অভিযোগ ওঠে দেশটির মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য তেমন কিছুই করেননি শান্তিতে নোবেল জয়ী এই নেত্রী৷ সুচি নেতৃত্বাধীন সরকার অবশ্য সেদেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷
শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছেন এমন গত সপ্তাহে দুই জাতিসংঘ কর্মী রয়টার্সকে জানান, সেনা অভিযানে এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমের মৃত্যু হয়েছে৷ অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট অফিস থেকে বলা হয়েছে, ঐ অভিযানে একশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমের বাস৷ কিন্তু সেখানে তাদের সাথে অবৈধ অভিবাসীদের মতো আচরণ করা হয়৷ মিয়ানমার সরকার তাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী বলে দাবি করে নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায়৷ প্রায়ই ঐ এলাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে৷ ২০১২ সাল থেকে যা চরম রূপ নেয়৷ গত সপ্তাহে পোপ ফ্রান্সিসও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হত্যা করা হচ্ছে, কারণ, তারা তাদের ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচতে চায়৷
৫ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর কথা
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, বিশ্বে এ মুহূর্তে অন্তত ৫ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ কোনো-না-কোনো কারণে দেশছাড়া, অর্থাৎ শরণার্থী৷ তাঁদের নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: Reuters/D. Whiteside
শরণার্থী কারা?
ইউএনএইচসিআর-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেউ যদি জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী বা কোনো শ্রেণিগত বৈষম্য কিংবা কোনো মতপার্থক্যের কারণে ভীত হয়ে নিজের ঘর বা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, তাহলে তিনি শরণার্থী৷ প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া মানুষদেরও শরণার্থী হিসেবে গণ্য করে ইউএনএইচসিআর৷ ছবির এই শিশু তুরস্কে আশ্রয় নেয়া সিরীয় শরণার্থী৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
সহিংসতার কারণে গৃহহারা
ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন বলছে, এ মুহূর্তে বিশ্বের কমপক্ষে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ সহিংসতার কারণে শরণার্থী৷ সহিংসতা বা বিরোধের কারণে ঘর ছেড়ে নিজের দেশেরই অন্য কোথাও আশ্রয় নেয়া মানুষদেরও রাখা হয়েছে এই হিসেবে৷ ওপরের ছবির মানুষগুলো আফ্রিকার দেশ ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর, সেনাবাহিনীর এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর রুৎশুরু শহরের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হন তাঁরা
ছবি: Getty Images/AFP/J. D. Kannah
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী
অনেকেই অন্য দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন৷ সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় তাদের বেশির ভাগই হয়ে যান শরণার্থী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Schmidt
সংখ্যাধিক্যই বড় সমস্যা
শরণার্থী সমস্যা বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই বড় সংকট হয়ে উঠছে৷ শরণার্থীদের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে যে সংকটের আশু নিরসন দুরূহ হয়ে পড়ছে৷ পরিসংখ্যান বলছে, এ মুহূর্তে মোট শরণার্থীর সংখ্যা স্পেন, ক্যানাডা বা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি!
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoli
আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং সোমালিয়া
২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বের মোট শরণার্থীর শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি ছিল আফগান, সিরীয় এবং সোমালীয়৷ অর্থাৎ এই তিন দেশের মোট শরণার্থী বিশ্বের মোট শরণার্থীর অর্ধেকেরও বেশি৷ ছবিতে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া এক আফগান পরিবার৷
ছবি: Majeed/AFP/Getty Images
স্বদেশেই শরণার্থী
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, অন্য দেশে আশ্রয় নেয়া মানুষের চেয়ে নিজের দেশেই শরণার্থী হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি৷ ২০১৩ সালে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন ১ কোটি ৬৭ লাখ মানুষ, অন্যদিকে নিজের দেশে গৃহহারার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৩ লাখ৷
আশ্রয় শিবিরের বাইরে...
সব শরণার্থী কিন্তু আশ্রয় শিবিরে থাকেন না৷ বরং বিশ্বের মোট শরণার্থীর তিন ভাগের দুইভাগই বাস করছেন আশ্রয় শিবিরের বাইরে৷ শহর বা গ্রামের কোনো ফাঁকা জায়গায়, কিংবা কোনো অ্যাপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকতে দেখা যায় তাঁদের৷
ছবি: Getty Images/AFP/Z. Abubeker
শিশুদের দুর্বিষহ জীবন
মোট শরণার্থীর শতকরা ৪৬ ভাগই শিশু৷ ঘরছাড়া এই শিশুদের জীবনে লেখাপড়া নেই, কোনো সাধ-আহ্লাদও নেই৷ ছবির এই মা, শিশু সিরিয়ার৷ গ্রিসের লেসবসে আশ্রয় নিয়েছে তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Gouliamaki
নির্যাতনের শিকার
৫ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর অন্তত ৩৫ ভাগই কোনো-না-কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার৷ শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকারদের অনেকেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না৷ যু্দ্ধ আর নির্যাতনের আতঙ্ক অনুক্ষণ তাড়া করে তাঁদের!
ছবি: JAMES LAWLER DUGGAN/AFP/GettyImages
শেষ আশ্রয় যুক্তরাষ্ট্র!
সহিংসতা বা বিরোধের কারণে একবার দেশ ছাড়লে খুব কম মানুষই আবার নিজের দেশে ফিরতে চান৷ অথচ যে দেশে থাকতে চান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে দেশ তাঁদের দায়িত্ব নিতে চায় না৷ এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়প্রার্থীদের নতুন কোনো দেশে পাঠানোর চেষ্টা করে ইউএনএইচসিআর৷ তবে খুব কম শরণার্থীই সেই সুযোগ পায়৷ তবে এমন শরণার্থীদের সবচেয়ে বেশি আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ সংখ্যাটা অবশ্য নগন্য, বিশ্বের মোট শরণার্থীর মাত্র ১ শতাংশ!