সহিংসতার শিকার হয়ে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে যাওয়ার এতদিন পর প্রথমবারের মতো রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে গেলেন অং সান সু চি৷ শান্তিতে নোবেলজয়ী সেখানে গিয়ে সবার প্রতি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের আহ্বান জানান৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার সকালে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিটুয়ে থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে উত্তরের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা মংডুর উদ্দেশ্যে রওনা হন সু চি৷ এর আগে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়৷ যদিও সরকারের এমন বক্তব্যের মধ্যেও রোহিঙ্গাদের প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালানো বন্ধ হয়নি৷
২ টি সামরিক বিমানে ২০ জনের একটি দল নিয়ে স্টেট কাউন্সিলর সু চি রাখাইনে যান৷ মংডুতে উপস্থিত এক রোহিঙ্গা ইমামের বরাত দিয়ে আরাকান প্রজেক্ট মনিটরিং গ্রুপের ক্রিস লিওয়া রয়টার্সকে বলেন, মংডুতে গিয়ে সু চি রাস্তায় জড়ো হওয়া মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন৷ এ সময় তিনি শুধু তিনটি কথা বলেছেন – সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হবে, সরকার তাদের সহায়তা করবে এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করা উচিত নয়৷
সু চির দল এনএলডি ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা ছিল, তিনি রাখাইনে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেবেন৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া বা তাঁদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখার জন্য রাখাইনে যাওয়ার কোনো আগ্রহ তিনি এর আগে দেখাননি৷ এ বছরের আগস্টে রোহিঙ্গাদের উপর সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ একে জাতিসত্ত্বা নিধন উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছে৷ এমন পরিস্থিতিতেই কোনোরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়া রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে গেলেন সু চি৷
রোহিঙ্গা সংকট: কার কী অবস্থান?
হিংসালীলা ও বৈরি মনোভাবের মুখে মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমাজে সহানুভূতি সত্ত্বেও মূলত কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Armangue/AP
বাংলাদেশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Z. H. Chowdhury
ভারত
দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
তুরস্ক
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/K. Ozer
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/Stringer
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেও সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কূটনৈতিক অবস্থান নেয় নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Watson
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
চীন
মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷
ছবি: Reuters/R. Dela Pena
রাশিয়া
চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Bairakov
জাতিসংঘ
জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
এখনো পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা শুরুর বিষয়টিও নিষ্পত্তি হয়নি৷ এরই মধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা রাখাইনে বসবাসের প্রমাণ দেখাতে পারবে, কেবল তাদেরই ফিরিয়ে নেওয়া হবে বলে মন্তব্য এসেছে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে৷ তবে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ রোহিঙ্গার কাছেই নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র৷