রাজধানীতেই থাকছে না কার্ড, ন্যায্য মূল্যে পণ্য থাকছে
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৬ মার্চ ২০২২
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মুখে এক কোটি বিশেষ কার্ড বিতরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ সেই কার্ড নিয়ে শুরুতেই দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা৷ তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কার্ড না হলেও ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি চলবে৷
বিজ্ঞাপন
সরকার এক কোটি পরিবারকে টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে চার ধরনের পণ্য দেবে ২০ মার্চ থেকে। ১৫ মার্চ থেকে দেয়ার কথা থাকলেও কার্ড প্রস্তুত না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। তবে এই কার্যক্রম ঢাকা শহরে এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তবে ঢাকায় কার্ড তৈরি সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে টিসিবি। বরিশাল সিটিতেও কার্ড হবে না।
দ্রব্যমূল্যের তুলনা: ২০০৯ বনাম ২০২১
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন ওয়েবসাইটে বিভিন্ন জেলার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রকাশ করে৷ ছবিঘরে ঢাকার একটি বাজারে ২০০৯ ও ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম উল্লেখ করা হয়েছে৷
চাল
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যাচ্ছে ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার এক বাজারে এক কেজি সরু বোরো চালের দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা৷ ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর একই বাজারে ঐ চালের দাম ছিল ৫৭-৭০ টাকা৷ মোটা বোরো চালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২১-২৩ টাকা৷ ২০২১ সালে ছিল ৪৪-৪৭ টাকা৷
ছবি: DW
ডাল
২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মসুর ডালের দাম ছিল ১০৮-১১০ টাকা৷ ২০২১ সালে ১০০-১১০ টাকা৷ আমদানিকৃত মসুর ডালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ১১২-১১৫ টাকা৷২০২১ সালে সেটা কমে হয় ৮৫-৯০ টাকা৷ মুগ ডালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ৮৫-১০০ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বেড়ে হয় ১২০-১২৫ টাকা৷
ছবি: bdnews24.com/T. Ahammed
পেঁয়াজ
এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ছিল ৪০-৪৪ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বেড়ে হয় ৫৫-৬০ টাকা৷ আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৮-৩৪ টাকা৷ ২০২১ সালে ৪৫-৫০ টাকা৷
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan
রসুন
২০০৯ সালে এক কেজি দেশি রসুনের দাম ছিল ৯০-১০৫ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা কম ছিল, ৫০-৭০ টাকা৷ আমদানিকৃত রসুনের এক কেজির দাম ২০০৯ সালে ছিল ৮০-৮৫ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বেড়ে হয় ১১০-১২০ টাকা৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mannan
কাঁচা মরিচ
২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার এক বাজারে এক কেজি কাঁচা মরিচের দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা৷ ঐ একই বাজারে ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর কাঁচা মরিচের দাম ছিল ১২০-১৩০ টাকা৷
ছবি: DW/H.U.R. Swapan
সয়াবিন তেল
২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০-৭৩ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বিক্রি হয়েছে ১৩৮-১৪২ টাকায়৷
ছবি: Gustavo Cuevas/dpa/picture-alliance
চিনি
২০০৯ সালে আমদানিকৃত এক কেজি চিনির দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা৷ ২০২১ সালে ৭৫-৭৭ টাকা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Kalaene
ডিম
২০০৯ সালে দেশি মুরগির ডিম ছিল ৩২-৩৪ টাকা হালি৷ ২০২১ সালে সেটা বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়৷ ফার্মের মুরগির ডিমের (লাল) দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৫-২৬ টাকা৷ ২০২১ সালে ৩৬-৪০ টাকা৷
ছবি: Reuters/W. Kurniawan
গরুর মাংস
গরুর মাংসের কেজিপ্রতি দাম ২০০৯ সালে ছিল ২২০-২৩০ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বিক্রি হয়েছে ৫৮০-৬০০ টাকায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Bachmann
খামারের মুরগী
২০০৯ সালে কেজিপ্রতি দাম ছিল ১০০-১১০ টাকা৷ ২০২১ সালে ১৫০-১৬০ টাকা৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Dinh Nam
দেশি রুই
২০০৯ সালে ছিল ১৪০-১৬০ টাকা৷ ২০২১ সালে ২০০-৩০০ টাকা৷ বিস্তারিত জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Mortuza Rashed
পানির দাম
গত ১২ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা৷ ২০০৯ সালে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম ছিল ৫ টাকা ৭৫ পয়সা৷ গত জুলাই থেকে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা দরে দাম দিতে হচ্ছে৷ অর্থাৎ গত ১২ বছরে ইউনিটপ্রতি পানির দাম প্রায় ১০ টাকা বেড়েছে৷ সম্প্রতি চট্টগ্রাম ওয়াসাও আগামী মাস থেকে পানির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে৷
ছবি: AP
বিদ্যুৎ
এ বছরের ২১ জুন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) ও ভোক্তাকণ্ঠ আয়োজিত এক ওয়েবিনারের মূল নিবন্ধে বলা হয়, গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম ১০ বার বেড়েছে৷ পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷ আর খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ৷
ছবি: DW
জ্বালানির দাম বৃদ্ধি
৩ নভেম্বর বুধবার রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়৷ ডিজেলের মোট চাহিদার ৬৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে৷ আর সেচকাজে ব্যবহৃত হয় ১৬ শতাংশ৷ ৪ নভেম্বর ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারপ্রতি তিন টাকা বাড়িয়ে ৬২ টাকা করা হয়৷ আরও বেড়েছে বেসরকারি খাতের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম৷ ১২ কেজির সিলিন্ডারে বেড়েছে ৫৪ টাকা৷
ছবি: Getty Images/P. Walter
মুনাফা সত্ত্বেও বৃদ্ধি
জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সবশেষ ২০১৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল৷ মাঝে ২০১৬ সালে দাম কিছুটা কমানোও হয়েছিল৷ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম যখন কম ছিল তখন তেলের দাম ততটা না কমানোয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সাত বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছিল৷ আর এবার টানা পাঁচ মাস ক্ষতি হওয়ার পর দাম বাড়ানো হলো৷
ছবি: Alastair Grant/AP/picture alliance
ঢাকায় বাসা ভাড়া দ্বিগুন হয়েছে
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বলছে ঢাকায় ২০১০ সালে দুই কক্ষের পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৩০০ টাকা৷ ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ২৪ হাজার ৫৯০ টাকা৷ আধাপাকা (টিন শেড) বাড়ির দুই কক্ষের ভাড়া ২০১০ সালে ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা৷ ২০১৯ সেটা বেড়ে হয় ১৩ হাজার ২০০ টাকা৷ ২০১০ সালে দুই কক্ষের মেসের গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৫০০ টাকা৷ ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ২৩ হাজার ২০০ টাকা৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. uz Zaman
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে
এ বছরের জুনে ক্যাব জানায় ২০২০ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ এবং সেবা-সার্ভিসের দাম বেড়েছে ৬.৩১ শতাংশ৷ ২০১৯ সালে এটি ছিল যথাক্রমে ৬.৫০ শতাংশ ও ৬.০৮ শতাংশ৷ ২০১৮ সালে তা ছিল ৬ শতাংশ ও ৫.১৯ শতাংশ৷ ঢাকার ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা-সার্ভিসের মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য ও ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা-সার্ভিসের সংগৃহীত মূল্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ক্যাব৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাথাপিছু আয় বেড়েছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে ২০০৯-২০১০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৮৪৩ মার্কিন ডলার৷ আর সবশেষ হিসাব বলছে, মাথাপিছু আয় এখন ২,৫৫৪ ডলার৷ তবে এই আয়ের সুষম বণ্টন হচ্ছে বলে মনে করেন না অনেক অর্থনীতিবিদ৷ কারণ একদিকে যেমন একদল মানুষ দ্রুত ধনী হচ্ছেন, আবার গরিবের সংখ্যাও বাড়ছে৷ করোনার সময়ে প্রায় সোয়া তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র্য হয়েছেন বলে সম্প্রতি এক জরিপে জানা গেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
18 ছবি1 | 18
টিসিবির মাধ্যমে একটি পরিবারকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুইবার করে সয়াবিন তেল দুই লিটার, চিনি ও মসুর ডাল দুই কেজি এবং পেঁয়াজ কমপক্ষে দুই কেজি কেজি কেনার সুযোগ দেয়া হবে। যাদের কার্ড থাকবে না, তারা কিনতে পারবেন না। তাদের কাছে সয়াবিন তেল ১১০ টাকা লিটার, মসুর ডাল প্রতি কেজি ৬৫ টাকা, চিনি ৫৫ টাকা, পেঁয়াজ কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি করা হবে। সবকিছুর দামই বাজারের চেয়ে কম। বিশেষ করে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকা করে।
‘এখনো সারাদেশে টিসিবির পণ্য পাঠানো হয়নি’
৬ মার্চ থেকে ঢাকা শহরে মোট ১৮৫টি ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি। প্রতিদিন চার ধরনের পণ্য প্রতিটি ট্রাকে থাকছে দুই হাজার ৫০০ কেজি করে। ঢাকা শহরে ১২ লাখ পরিবারকে এই পণ্য দেয়া হচ্ছে। ঢাকার বাইরে পাবে এক কোটির বাকি ৮৮ লাখ পরিবার।
ঢাকার বাইরে করোনার সময় যারা প্রণোদনা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দুই হাজার ৫০০ টাকা পেয়েছেন তারাসহ নিম্নবিত্ত আরো ৬১ লাখ ৫০ হাজার পরিবার কার্ড পাচ্ছে।
কার্ড নিয়ে জটিলতা
টিসিবি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুয়েল আহমেদ জানান, এখানো কেউ টিসিবির কার্ড হাতে পাননি। ঢাকার বাইরে ডিসিদের সমন্বয়ে চেয়ারম্যান, মেম্বাররা এই কার্ড তৈরি করছেন। যারা করোনার সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা পেয়েছেন, তারা এবং আরো যারা নিম্নবিত্ত আছেন, তারাও এই কার্ড পাবেন। তিনি জানান, "দুইটি কার্ড হবে। একটি কার্ড ডিলারদের হাতে থাকবে। আরেকটি উপকার ভোগীদের হাতে। দুইটি কার্ড মিলিয়ে টিসিবির পণ্য দেয়া হবে।”
‘কার্ড পাওয়া গেলে তখন আমরা বুঝবো অনিয়ম হয়েছে কিনা’
তবে ঢাকা শহরে কার্ড না করা হলে আগের মতোই বিশৃঙ্খলা হবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, " আমরা ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাছে তালিকা চেয়েছি। পাবো কিনা জানি না। যদি না পাই তাহলে অমোচনীয় কালি ব্যবহারের প্রস্তাব আছে। জানি না কী হবে। কার্ড না হলে শত শত মানুষ ট্রাকের সামনে লাইন দেবে। সবাইকে দিতে পারবো না।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘এখানো সারাদেশে টিসিবির পণ্য পাঠানো হয়নি। তাই ঢাকার বাইরে কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হচ্ছে।”
তবে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন দাবি করেন, " কার্ড তৈরি হয়ে গেছে। পণ্যও চলে গেছে। কিন্তু পলিথিন ব্যাগের অভাবে কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হচ্ছে।”
এই কার্ড তৈরিতে খুলনাসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চল থেকে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মেম্বার-চেয়ারম্যানরা এই কার্ড দেয়ায় কোথাও কোথাও স্বজন প্রীতি ও লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে।
ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুয়েল আহমেদ বলেন, " এখানো তো কার্ডই পাওয়া যায়নি। কার্ড পাওয়া গেলে তখন আমরা বুঝবো অনিয়ম হয়েছে কিনা। ”
আর টিসিবির মুখপাত্র বলেন, "কার্ডের সাথে টিসিবির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা মেম্বার-চেয়ারম্যনরা করছেন। ডিসি সাহেবরা দেখছেন । তারা বলতে পারবেন। আর ঢাকা শহরে কার্ড করা সম্ভব নয়, কারণ, এখানে অনেক ভাসমান মানুষ আছে।”